সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

বায়োফ্লক পদ্ধতি, স্টেপ বাই স্টেপ

বায়োফ্লক ট্যাঙ্ক
বায়োফ্লক ট্যাঙ্ক

বায়োফ্লক সিস্টেম চালু করার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পানি প্রস্তুত করা। কারণ যথাযথভাবে পানি প্রস্তুত করতে না পারলে পুরো বিনিয়োগই জলে যাবে। যদিও পানি প্রস্তুতের আগে ট্যাঙ্ক নির্মাণ, এয়ারেশন পাম্প স্থাপনসহ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণ একেবারেই শুরুর দিকের কাজ। ট্যাঙ্ক স্থাপনের বিষয়ে আরেকটি আলাদা পোস্ট রয়েছে। পড়ে দেখতে পারে।


যেভাবে পানি প্রস্তুত করতে হবে

বায়োফ্লক সিস্টেমে ট্যাঙ্কের পানি প্রস্তুত করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু মাত্রা জানাটা জরুরি। কোন উপাদান কী পরিমানে দিতে হবে এবং ফ্লক প্রস্তুতের জন্য ন্যূনতম কতোদিন সময় লাগে এসব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। নিচে পুরো পদ্ধতিটি ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হলো:

নিচে বর্ণিত চারটি ধাপ ভালোভাবে খেয়াল করুন
প্রথমেই নির্মিত ট্যাঙ্ক বা কৃত্রিম পুকুরটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন
ট্যাঙ্কের ৫০% পরিমান পানি দিয়ে ভরতে হবে
এবার পাম্প দিয়ে এয়ারেশন শুরু করুন
লবণ, কোকো ৩ এবং প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করুন
বায়োফ্লক স্টার্টার

ট্যাঙ্ক পরিষ্কার
বায়োফ্লক কালচার সিস্টেমের জন্য পানি প্রস্তুতের আগে ট্যাঙ্কটি ভালোভাবে পরিষ্কার করা জরুরি। নতুন নির্মাণ করা ট্যাঙ্ক হোক বা আগে মাছ চাষের জন্য ব্যবহৃত ট্যাঙ্ক হোক উভয়ক্ষেত্রেই পরিষ্কার করা দরকার। এটা না করলে ট্যাঙ্কে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে যেতে পারে। যা পরবর্তীতে পুরো সিস্টেম দূষিত ও বিপজ্জনক করে তুলতে পারে।

ট্যাঙ্কে পানি ভরা
ট্যাঙ্কের ধারণক্ষমতা প্রায় ৫০% পানি দিয়ে ভরুন।  ৩৫-৫০% ভরলেই চলে। একদম বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ভরতে হবে। এক্ষেত্রে শ্যালো টিউবওয়েল বা ডিপ টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করা সবচেয়ে নিরাপদ। অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে ট্যাঙ্ক ভরতে হবে। কোনোক্রমেই নদী, পুকুর, খাল-বিলের বা কোনো ট্যাঙ্কের জমানো ব্যবহার করবেন না। তবে উল্লেখিত পরিমানের বেশি পানি ট্যাঙ্কে ভরবেন না। কারণ প্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর জন্য একটি পরিবেশ দরকার। যেটি এ পরিমাপের মধ্যে পাওয়া যায়।

এয়ারেশন
এবার এয়ারেশন পাম্প চালু করুন। মাইক্রো অর্গানিজম কালচার শুরু করার আগে পানিতে প্রচুর অক্সিজেন মেশানো দরকার। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে কিন্তু ২৪ ঘণ্টা এয়ারেশন দরকার হয়। এ কারণে দেখা যায় এ পদ্ধতিতে এয়ারেশন পাম্প চালাতে গিয়ে শুধু বিদ্যুৎ বিলের পেছনেই মোটা অংকের টাকা খরচ হয়ে যায়। তবে আপনার সিস্টেম যদি ছোট বা মাঝারি আকারের হয় সেক্ষেত্রে সোলার পাম্প বা সৌর বিদ্যুৎ চালিত পাম্প ব্যবহার করতে পারেন। এয়ারেশন পাম্প এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে।

লবণ, কোকো ৩ ও প্রোবায়োটিক
বায়োফ্লক সিস্টেমের জন্য পানি প্রস্তুতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এটি। কারণ এখনই শুরু হবে অণুজীব কালচার। ১০ হাজার লিটার পানির জন্য ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হবে। লবণ পানির টিডিএস (টোটাল ডিজলভড সলিড) বা দ্রবীভূত মোট কঠিন বস্তুর মাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করে। পাশাপাশি মাছেদের যেকোনো ধকল কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। কোনোভাবেই আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করবেন না। সবচেয়ে ভালো সরাসরি সামুদ্রিক লবণ ব্যবহার করা।

এরপর প্রয়োগ করুন কোকো ৩ বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। এটি চুনও হতে পারে। সাধারণত ১০ হাজার লিটার পানিতে ১.৫ কেজি কোকো ৩ দিতে হয়।

এরপর প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে। প্রোবায়োটিক আসলে উপকারী ব্যাকটেরিয়া। এটি পানিতে বিদ্যমান বিভিন্ন বর্জ্যকে মাছের খাবার উপযোগী প্রোটিনে রূপান্তরিত করে। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির প্রোবায়োটিক পাওয়া যায়। কতোখানি প্রয়োগ করতে সে মাত্রা কোম্পানির প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে। সে অনুযায়ী প্রয়োগ করুন।

বায়োফ্লক স্টার্টার
একেক ধরনের প্রোবায়োটিকের জন্য একেক স্টার্টার পাওয়া যায়। এগুলো বাজারে খোঁজ করলে পেতে পারেন। অথবা নিজেই বাড়িতে বানিয়ে নিতে পারেন। গমের কুঁড়া এবং ঝোলাগুড় বা চিটাগুড় অথবা চিনি মিশিয়ে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা ফার্মেন্ট করতে হবে অর্থাৎ পচাতে হবে। ফার্মেন্টেড বস্তুটি ট্যাঙ্কের পানিতে সমানভাবে ছড়িয়ে দিন।

পানি প্রস্তুত হয়েছে বুঝবেন কীভাবে
উপরের ধাপগুলো অনুসরণ করার পর তিন থেকে সাত দিন এয়ারেটর পাম্প চালু রাখুন। এ সময়ের মধ্যে ফ্লক তৈরি হয়ে যাবে। এটি আপনি খালি চোখে পানির রঙ দেখেই বুঝতে পারবেন। ট্যাঙ্কে যথেষ্ট সূর্যের আলো পড়লে ৩-৭ দিনের মধ্যে পানি সবুজ রঙ ধারণ করবে। সূর্যের আলো কম পেলে বাদামি রঙের হতে পারে। মূলত শৈবাল জন্মানোর কারণেই পানির রঙ সবুজ হয়। আর সূর্যের আলো না পেলে সবুজ শৈবাল জন্মায় না। শুধুই থাকে ব্যাকটেরিয়া।

বায়োফ্লক তৈরির সময় ও পরিমান নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর। পানিতে যথেষ্ট অক্সিজেন ও পরিমিত দ্রবীভূত সলিড থাকতে হবে। এয়ারেশন ঠিকঠাক না হলে ট্যাঙ্কের অক্সিজেনশূন্য এলাকায় কোনো অণুজীব বা ফ্লক জন্মাবে না। ফলে সেখানে প্রচুর অ্যামোনিয়া ও মিথেন তৈরি হবে। যা মাছের জন্য খুবই বিষাক্ত। এয়ারেশন ঠিকমতো রাখতে পাম্প দিয়ে ট্যাঙ্কে (বড় ট্যাঙ্ক হলে) স্রোত তৈরি করতে পারলে ভালো। সিস্টেম বেশি বড় হলে পাম্পটি মাঝে মধ্যে স্থান পরিবর্তন করিয়ে বসানো দরকার। তাতে ট্যাঙ্কের পানিতে সলিড উপাদানগুলো এক জায়গায় জমে থাকতে পারবে না।

এছাড়া বায়োফ্লকের উৎপাদন প্রাকৃতিক আলো, তাপমাত্রা, পানির পিএইচ মাত্রা, টিডিএস এসবের ওপর নির্ভর করে।

বায়োফ্লক সিস্টেমে যখন নিয়মিত কার্বোহাউড্রেট যেমন, চিনি বা ঝোলাগুড় প্রয়োগ করা হয় তখন প্রচুর স্লাজ বা গাদ তৈরি হয়। অতিরিক্ত গাদ হওয়া ঠেকাতে নিয়মিত প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে এসব গাদ থেকে বায়োফ্লক উৎপাদনের প্রক্রিয়া দ্রুততর হবে। আর যদি সিস্টেম অনেক বড় হয় তাহলে নিচে বসানো পাইপ দিয়ে কিছু পানি বের করে দিতে হবে তাতে গাদ বেরিয়ে যাবে।

কার্বন সোর্সের ব্যালেন্স
মাছ ছাড়ার পর ট্যাঙ্কে অ্যামোনিয়ার পরিমান মাত্রা ছাড়ানো প্রতিরোধ করতে নিয়মিত কার্বোহাইড্রেট প্রয়োগ করতে হবে। কার্বোহাইড্রেট ছাড়া ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি হবে না। একই সঙ্গে কার্বন ছাড়া ব্যাকটেরিয়ার অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াও হয় না। এ প্রক্রিয়াতেই তারা অ্যামোনিয়া থেকে আমিষ তৈরি করে এবং পানির গুনাগুন ঠিক রাখে।

এর জন্য নিয়মতি নির্দিষ্ট মাত্রায় কার্বোহাইড্রেট ও আমিষ সমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করতে হবে। এ ধরনের খাবার মিশ্রণে কার্বন ও নাইট্রোজেনের আদর্শ অনুপাত হলো ১০:১। বেশিরভাগ জাতের চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের জন্য উপযুক্ত কার্বন-নাইট্রোজেন অনুপাত ৯:১ অথবা ১০:১। তবে ১২:১ এবং ১৫:১ মাত্রাতেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।

কার্বোহাইড্রেটের উৎস হিসেবে যেসব বস্তুতে সাধারণ চিনি রয়েছে এবং সহজেই ভেঙে যায় (রাসায়নিক পরিবর্তন) সেগুলো ব্যবহার করাই ভালো। এক্ষেত্রে চিটাগুড়, কাসাভা, চিনি বা গুড় অথবা চাল বা গমের আটা ব্যবহার করা যেতে পারে। চিনি ব্যবহার করলে প্রতি ১০ হাজার লিটার পানির জন্য ১.৫ কেজি নিতে হবে।

মাছের ঘনত্ব যদি বেশি থাকে এবং বেশি পরিমানে খাবার দেয়া হয় তাহলে অ্যামোনিয়ার পরিমান অতিরিক্ত বেড়ে যেতে পারে। তখন উপরের প্রক্রিয়াটি অর্থাৎ কার্বন-নাইট্রোজেন ১০:১ অনুপাতে বারবার প্রয়োগ করতে হবে। বায়োফ্লক সিস্টেমে এই ব্যালেন্সিংটাই সবচেয়ে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

বায়োফ্লক মনিটরিং

ট্যাঙ্কে কী পরিমান ফ্লক আছে এটি নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সিস্টেমের পানি প্রস্তুত ও মাছ ছাড়ার সময় সাধারণত ট্যাঙ্কের পানি সবুজ রঙ ধারণ করে। কারণ এসময় খুব দ্রুত শৈবাল তৈরি হয়। অবশ্য এর জন্য ট্যাঙ্কটি অবশ্যই উন্মুক্ত স্থানে হতে হবে অর্থাৎ সূর্যের আলো পড়তে পারতে হবে। ধীরে ধীরে পানি বাদামি রঙ ধারণ করবে। কারণ মাছে যখন খাবার দেওয়া শুরু হবে তখন ব্যাকটেরিয়ার পরিমান দ্রুত বাড়বে। শৈবালের চেয়ে ব্যাকটেরিয়ার পরিমান বেড়ে যাওয়ার কারণেই তখন পানি বাদামি দেখাবে। এ পরিবর্তনটি তেলাপিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দ্রুত হয়। কারণ তেলাপিয়াকে চিংড়ির চেয়ে বেশি খাবার দিতে হয়।
বায়োফ্লক পরিমাপ করার পাত্র
বায়োফ্লক পরিমাপ
বায়োফ্লকের পরিমান দেখার সহজ একটা উপায় হলো বিশেষ ধরনের একটি কোণ আকৃতির পাত্রে ট্যাঙ্কের পানির কয়েকটি স্যাম্পল (নমুনা) রাখা। ১৫-২৫ সেন্টিমিটার গভীরতা থেকে পানির নমুনা নিতে হয়। এরপর এটি ওই পাত্রে ২০ মিনিট রেখে দিতে হবে। এতে কঠিন বস্তুগুলো নিচে জমে গিয়ে উপরে শুধু জীবন্ত অণুজীব আর ফ্লক থাকবে।

পানির পিএইচ (PH) মাপতে পারলে ভালো। এবং পিএইচ বেশি কমে গেলে সামান্য পরিমানে সোডিয়াম বাই কার্বোনেট বা বেকিং সোডা (NaHCO3) প্রয়োগ করতে হবে।

বায়োফ্লক সিস্টেমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রোটিন তৈরি হয় এবং কার্বনঃনাইট্রোজেন ব্যালেন্স তৈরি হয় বলে এ সিস্টেমে অনেক বেশি পরিমান মাছ চাষ করা যায়।  প্রতি ঘনমিটারে ১৫০-২৫০টি চিংড়ি এবং ২০০-৩০০টি তেলাপিয়া পালন করা সম্ভব। এর চেয়ে বেশি না করাই ভালো। যারা নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষ শুরু করতে চান তারা অবশ্যই প্রথমে তেলাপিয়া, শিং ও মাগুর মাছ দিয়ে চাষ শুরু করবেন। এ পদ্ধতিতে মাছ অন্য যেকোনো পদ্ধতির চেয়ে দ্রুত বাড়ে। কারণ অন্যান্য পদ্ধতির মতো এখানেও ট্যাঙ্কে বাড়তি খাবার বা পিলেট দেয়া হয়। মাছ এ পিলেট খায়, আর অতিরিক্ত পিলেট রিসাইকেল হয়ে আমিষ অণুজীবে পরিণত হয়। আর ট্যাঙ্কে যে বিপুল পরিমান বায়োফ্লক জন্মে সেটি সব সময় খেতে থাকে। ফলে মাছের বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয়।

আরো পড়ুন:

Post a Comment

0 Comments