সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

যে কোনো আকৃতির জমি পরিমাপের সূত্র ও পদ্ধতি


জমিজমা নিয়ে ঝামেলা এড়াতে বা বসতবাড়ি, বিভিন্ন খামার বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে জমির মাপ জানা খুব জরুরি হয়ে পড়ে । দরকারের সময় সার্ভেয়ার বা আমিন পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাই নিজের জানা থাকলে ক্ষতি কী! আর এটা কিন্তু কঠিন কাজ নয়। কয়েকটি জ্যামিতির সূত্র জানলে সহজেই আপনি একজন সহযোগীকে নিয়ে যে কোনো আকার বা আকৃতির জমি মাপতে পারবেন।

জমি পরিমাপের ক্ষেত্রে যে চেইন বা শিকলটি ব্যবহার করা হয় সেটির নাম গান্টার্স চেইন। ইংরেজ বিজ্ঞানী গানটার জরিপ কাজ সহজ করার জন্য এই শিকল উদ্ভাবন  করেন। এই শিকলের হিসাবটা হলো: এটির দৈর্ঘ্য ২২ গজ বা ৬৬ ফুট। এতে মোট ১০০ টি লিংক রয়েছে। প্রতিটি লিংকের দৈর্ঘ্য ৭.৯২ ইঞ্চি। লিংকের সঙ্গে মিটার, গজ বা শতক, কাঠাসহ অন্যান্য এককের সম্পর্ক আরেকটি ব্লগে বিস্তারিত বলা হয়েছে।

জমি পরিমাপের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো শতাংশ ধরে পরিমাপ করা। গান্টার্স চেইনের ১০০০ বর্গলিংক = ১ শতাংশ ধরা হয়। সাধারণত জমি বর্গাকৃতি বা আয়তাকার হলে খুব সহজেই এ পদ্ধতিতে জমি মাপা যায়। তবে আপনি গজ ফিতা ব্যবহার করে বা হাতের হিসাবেও জমি পরিমাপ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সূত্রটি একটু আলাদা হবে। নিচে গান্টার্স চেইনের মাধ্যমে এক শতক জমি পরিমাপের নিয়ম দেখানো হলো:
সুষম আয়তাকার জমির ক্ষেত্রফল

উপরের ছবিটিতে (চিত্র ১) দেখা যাচ্ছে জমিটি আয়তাকার। অর্থাৎ একটি আয়তক্ষেত্রের মতো এর বিপরীতব বাহুগুলো সমান। ধরা যাক দৈর্ঘ্য ৫০ লিংক, প্রস্থ ২০ লিংক। এখন এ আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সূত্র হলো= দৈর্ঘ্য * প্রস্থ। তাহলে ছবির জমিটির ক্ষেত্রফল হবে= ৫০*২০= ১০০০ বর্গলিংক হয়। আর আমরা জানি ১০০০ বর্গলিংক = ১ শতক।  এভাবে নির্ণয় করা ক্ষেত্রফল ১০০০ এর বেশি হলে বা কম হলে সেই সংখ্যাকে ১০০০ দিয়ে ভাগ করলেই কিন্তু আমরা শতকের পরিমান পেয়ে যাবো।

বর্গফুটের হিসাব দিয়ে জমি পরিমাপ
আপনার কাছে গান্টার্স চেইন না থাকলে কী করবেন। এর সহজ সমাধান হচ্ছে, সাধারণ ফিতা বা টেপ এমনকি হাতের মাপ দিয়েও জমি পরিমাপ করা যায়। তবে সবার হাত সমান নয় একারণে হাত দিয়ে মাপলে নির্ভুল পরিমাপ পাওয়া যাবে না, তবে একটা ধারণা পাবেন। বর্গফুটের হিসাবে জমি পরিমাপ করতে চাইলে জানা থাকতে হবে যে,  ১ শতাংশ= ৪৩৫.৬ বর্গফুট।

উপরের ছবিকেই (চিত্র ১) আমরা উদাহরণ হিসেবে নিয়ে লিংকের স্থলে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের একক হিসেবে ফুট কল্পনা করি। তাহলে জমিটির দৈর্ঘ্য পাওয়া গেল ৫০ ফুট এবং প্রস্থ ২০ ফুট। এবার এটির ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের সূত্র কিন্তু একই থাকলো। তাহলে জমিটির ক্ষেত্রফল= দৈর্ঘ্য*প্রস্থ= ৫০*২০=১০০০ বর্গফুট। যেহেতু  ৪৩৫.৬ বর্গফুট= ১ শতাংশ, সেহেতু প্রাপ্ত মানটিকে ৪৩৫.৬  দিয়ে ভাগ করলেই আমরা শতাংশে হিসাব পেয়ে যাবো। তাহলে ১০০০ বর্গফুট ÷ ৪৩৫.৬ বর্গফুট = ২.৩ শতাংশ (প্রায়) জমি।

একই সূত্র ব্যবহার করে গজ এবং হাত পদ্ধতিতেও জমির পরিমাপ বের করা যায়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে: ১ শতাংশ = ১৯৩.৬০ বর্গহাত বা ৪৮.৪০ বর্গগজ। এখান থেকে সরাসরি কাঠার হিসেব বের করতে চাইলে মনে রাখতে হবে: ১ কাঠা = ১.৬৫ শতক বা ৭২০ বর্গফুট ।

অনেকে জমির আকৃতি নিখুঁত আয়তক্ষেত্র বা বর্গক্ষেত্র না হলে দুই দৈর্ঘ্য ও দুই প্রস্থের হিসাব গড় করে এরপর ক্ষেত্রফল বের করেন। এভাবে জমির সঠিক পরিমাপ বের করা যায় না। জমির যদি অসম আকৃতির হয় সেক্ষেত্রে আপনাকে নিচের পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে:
পঞ্চভূজাকৃতি জমির পরিমাপ

উপরের ছবির মতো (চিত্র ২) পঞ্চভূজ আকৃতির জমি হলে সেটির সঠিক পরিমান বের করা একটু ঝামেলার কাজ। এর জন্য একটু জ্যামিতির জ্ঞান থাকাটা জরুরি।

এর জন্য পুরো জমিটিকে খাতায় এঁকে ডট রেখা টেনে তিনটি ত্রিভূজে ভাগ করে নিন। ধরা যাক এখানে তিনটি ত্রিভূজ হলো: ABD, BCD এবং AED। প্রত্যেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য ছবিতে দেওয়া আছে। এখন আমরা প্রত্যেকটি ত্রিভূজের ক্ষেত্রফল আলাদা করে বের করার জন্য নিচের সূত্র ব্যবহার করবো।

প্রথমেই প্রত্যেকটি ত্রিভূজের পরিসীমার অর্ধেক বের করি। পরিসীমার অর্ধেক নির্ণয়ের সূত্র হলো: তিনটি বাহুর যোগফল ÷ ২। এই পরিসীমার অর্ধেক থেকে ত্রিভূজটির ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের সূত্র হলো:

ধরি,  ABD ত্রিভূজের তিনটি বাহু a, b ও c । পরিসীমার অর্ধেককে আমরা s দিয়ে প্রকাশ করি। তাহলে ABD ত্রিভূজের ক্ষেত্রফল= sqrt{s(s-a)(s-b)(s-c)}। অর্থাৎ দ্বিতীয় বন্ধনীর ভেতরের মানের বর্গমূল করলেই ত্রিভূজের ক্ষেত্রফল বের হয়ে আসবে।

তাহলে সূত্র অনুযায়ী, ABD এর পরিসীমার অর্ধেক s = (a+b+c) ÷ ২=(৩+৪+৫) ÷ ২ = ৬

ত্রিভূজটির ক্ষেত্রফল = sqrt{s(s-a)(s-b)(s-c)} = sqrt{৬(৬-৩)(৬-৪)(৬-৫)}= ৬

একইভাবে, BCD এর ক্ষেত্রফল ৪.৪৭ এবং AED এর ক্ষেত্রফল ৩.৮।

এবার মোট ক্ষেত্রফল= ৬+৪.৪৭+৩.৮= ১৪.২৭

দৈর্ঘ্য প্রস্থের পরিমাপে আপনি আপনার সুবিধামতো একক ব্যবহার করতে পারেন। লিংক, হাত, ফুট, গজ বা মিটার যে কোনোটি ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রাপ্ত ক্ষেত্রফলটিকে শতক বা কাঠায় রূপান্তরিত করতে উপরে দেওয়া নির্দিষ্ট সূত্র ব্যবহার করতে হবে। যেমন: ১০০০ বর্গলিংক = ১ শতাংশ, ৪৩৫.৬ বর্গফুট= ১ শতাংশ ইত্যিাদি।
অসম আকৃতির জমির পরিমাপ

এখন জমিটি যদি উপরের চিত্রের মতো (চিত্র ৩) অসম আকৃতির হয় তাহলে আমরা এই সূত্র ব্যবহার করবো। প্রথমে জমিটিকে প্রস্থ বরাবর রেখা টেনে সমান ভাগে ভাগ করবো। চিত্রে PQRS জমিটিকে  a, b, c, d, e, f ও g রেখা টেনে সমান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি রেখা থেকে আরেকটি রেখা দূরত্ব সমান, ধরি সেটি t । এবার এই জমির ক্ষেত্রফল বের করার সূত্রটি হলো:

ক্ষেত্রফল= S/3[A + 2B + 4C]

এখানে
A = প্রথম ও শেষ রেখাটির দৈর্ঘ্যের যোগফল (a + g)
B = বিজোড় রেখাগুলোর যোগফল (c + e + g)
C = জোড় রেখাগুলোর যোগফল (b + d + f)
S = রেখাগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব অর্থাৎ t এর দৈর্ঘ্য
অসম আকৃতির জমির পরিমাপের সূত্র

আবার জমির আকৃতি যদি উপরের চিত্রের মতো (চিত্র ৪) হয় সেক্ষেত্রে কিন্তু আলাদা সূত্র ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রেও জমিটিকে সমান দূরত্বে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। প্রথমে লম্বালম্বি দুই শীর্ষের দূরত্ব বের করতে হবে। এরপর যতোভাগ করতে চাই লম্বালম্বি দূরত্বটিকে ততো দিয়ে ভাগ করলেই প্রত্যেকটি ভাগের মধ্যবর্তী দূরত্বটি পেয়ে যাবো। যেমন, উপরের চিত্রে AB এর দৈর্ঘ্যকে ৬ দিয়ে ভাগ করে প্রত্যেকটি ভাগের দৈর্ঘ্য অর্থাৎ AC, CD, DE, EF, FG এর সংক্ষিপ্ততম দূরত্বটি কিন্তু সমান।

ধরা যাক, AB রেখার দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট এবং প্রত্যেকটি ভাগের মধ্যবর্তী সংক্ষিপ্ততম দূরত্ব ১০ ফুট।

বিভক্তকারী প্রত্যেকটি রেখার দৈর্ঘ্য মনে করি, C = ১৫ ফুট, D = ১০ ফুট, E = ১৫ ফুট, F = ২৫ ফুট, G= ২০ ফুট।

বিভক্তকারী রেখাগুলোর মোট দৈর্ঘ্য= C + D + E + F + G= ১৫+১০+১৫+২৫+২০= ৮৫ ফুট

মোট ক্ষেত্রফল= বিভক্তকারী রেখাগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব * বিভক্তকারী রেখাগুলোর মোট দৈর্ঘ্য
= ১০ ফুট * ৮৫ ফুট
= ৮৫০ বর্গফুট বা  ৮৫০ ÷ ৪৩৫.৬ = ১.৯৫ বা প্রায় ২ শতাংশ।

আরো পড়ুন:
জমিজমার দলিলপত্র ও পরিভাষা
ভূমি পরিমাপের বিভিন্ন এককের মধ্যে সম্পর্ক
জমির আধুনিক দলিল লেখার নিয়ম

Post a Comment

3 Comments