সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

একটি সরল বায়োফ্লক সিস্টেম: শিং, মাগুর, কৈ চাষ পদ্ধতি

catfish in biofloc system-BFT

বায়োফ্লক (Biofloc) পদ্ধতিতে মাছ চাষ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা আগের তিনটি লেখাতেই করা হয়েছে। সুতরাং সেদিকে আর না গিয়ে এবার আমরা সরাসরি দেখবো বায়োফ্লক (Biofloc) পদ্ধতিতে মাছ চাষের একটি প্রজেক্ট কীভাবে শুরু করা যায়।

একটি বায়োফ্লক (Biofloc) সিস্টেমের জন্য যা যা প্রয়োজন মোটা দাগে বলতে গেলে সেগুলো হলো: একটি পানির ট্যাংক, স্বচ্ছ ত্রিপোল, প্রোবায়োটিক (Probiotic), মোলাসেস বা চিটাগুড়, সামুদ্রিক লবণ, এরেটর মেশিন, পানিতে বিভিন্ন গ্যাস ও রাসায়নিকের অনুপাত পরিমাপের কিছু যন্ত্রপাতি বা কিট।

শুরুতেই আসা যাক প্রোবায়োটিক (Probiotic) এর কথা। প্রোবায়োটিক (Probiotic) হলো উপকারী ব্যাকটেরিয়া। পুকুরে বা চৌবাচ্চায় বায়োফ্লক (Biofloc) স্টার্টার হিসেবে কাজ করে এই প্রোবায়োটিক (Probiotic)। এটি নিজে তৈরি করা যায়। আবার বাজারেও পাওয়া যায়। যারা প্রথম শুরু করতে যাচ্ছেন তাদের নিজে প্রোবায়োটিক (Probiotic) বানানো গবেষণায় সময় নষ্ট না করে বাজার থেকে কেনাই ভালো। 

বাজার থেকে কেনা প্রোবায়েটিক সরাসরি পুকুরে বা আপনার সিস্টেমের চৌবাচ্চায় প্রয়োগ করা যাবে না। তাতে কাজ হবে না। এটিকে আগে অ্যাকটিভ বা সক্রিয় করে নিতে হবে। 

প্রোবায়োটিক (Probiotic) অ্যাকটিভ করার উপায়

আপনার ট্যাংকের ধারণক্ষমতা যদি হয় ৫০০০ লিটার তাহলে, ২০ লিটারের একটি বালতিতে ১০-১৫ লিটার পানি নিয়ে তাতে ২০০ গ্রাম চিটাগুড় ও ১০০ গ্রাম প্রোবায়োটিক (Probiotic) ভালো করে মেশান। এই মিশ্রণে টানা তিন দিন ২৪ ঘণ্টা এরেশন (aeration) চালিয়ে রাখতে হবে। অক্সিজেনের অভাব পড়লে কিন্তু প্রোবায়োটিক (Probiotic) ঠিকঠাক অ্যাকটিভ হবে না। দৈনিক অন্তত দুই বেলা লাঠি দিয়ে মিশ্রণটি ঘেঁটে দিতে হবে যাতে ব্যাকটেরিয়া তলানিতে জমে না যায়।

একই সময়ে আপনার কালচার ট্যাংকে অর্ধেক পরিমান পানি ভরুন। প্রতি ১ হাজার লিটার পানির জন্য ১ কেজি চিটাগুড় এবং ১ কেজি লবণ মিশিয়ে এরেশনে রাখুন। লবণটি অবশ্যই আয়োডিন মুক্ত হতে হবে। এর জন্য  আয়োডিন ছাড়া সামুদ্রিক লবণ ব্যবহার করাই ভালো।

অর্থাৎ কালচার ট্যাংক (যে ট্যাংকে মাছ চাষ হবে) যদি হয় ৫ হাজার লিটার তাহলে ২৫০০ লিটার পানি ভরতে হবে। আর তার জন্য চিটগুড় লাগবে ২.৫ বা আড়াই কেজি এবং লবণ লাগবে আড়াই কেজি। লবণ দেওয়ার উপকারিতা হলো, লবণযুক্ত পানিতে মাছ ছাড়লে মাছের ধকল সহ্য করার ক্ষমতা তৈরি হয়। পাশাপাশি বায়োফ্লক (Biofloc) এর নাইট্রিফিকেশনও দ্রুত হয়। অনেকে সেই সঙ্গে চুন বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটও দেন। এটিও সামান্য পরিমানে দিলে ভালো। না দিলে সমস্যা নেই।

প্রোবায়োটিক (Probiotic) এবং কালচার ট্যাংক দুটোকেই টানা তিন দিন এরেশনে (aeration) রাখতে হবে। তিন দিন পর অ্যাকটিভ প্রোকায়োটিকগুলো কালচার ট্যাংকের চার পাশে পানিতে ঢেলে দিতে হবে। প্রোবায়োটিক (Probiotic) মেশানোর পর কালচার ট্যাংকের পানি আরো তিন দিন এরেশনে রাখতে হবে।

অর্থাৎ প্রোবায়োটিক অ্যাকটিভ করা এবং কালচার ট্যাংকে ঢেলে দেওয়ার পর কালচার ট্যাংকের পানি প্রস্তুত করা মিলিয়ে ৬ দিন পার হলো। এবার ট্যাংকে মাছ ছাড়া যেতে পারে। তবে তখনো কিন্তু বায়োফ্লক (Biofloc) তৈরি হওয়ার শুরু হয়নি। ফ্লক তৈরি শুরু হবে এর ২-৬ দিন পর থেকে। 

অনেকে আবার মাছ ছাড়ার আগে বা পরে । অ্যান্টিবায়োটিক দিতে বলেন। এটি কখনোই করবেন না। তাহলে ট্যাংকের প্রোবায়োটিক (Probiotic) মরে যাবে। ফলে ফ্লক তৈরি একেবারে নাও হতে পারে। আবার হলেও অনেক দেরিতে হবে। ততোদিনে নাইট্রোজেন কার্বন ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে সব মাছ মারা যেতে পারে।

এখানে একটা বিষয় জেনে রাখা ভালো, এ পদ্ধতিতে কাদার মাছ চাষ করা ভালো। পানির নিম্ন বা মধ্যস্তর থেকে খাদ্য গ্রহণ করে এমন মাছ সাধারণত এ পদ্ধতিতে চাষ করা ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু বর্ণিত এ পদ্ধতিতে ফ্লক শুরু হওয়ার আগেই মাছ ছাড়া হচ্ছে তার মানে কালচার ট্যাংকে তখনো অ্যামোনিয়া ও নাইট্রাইটের মতো বিষাক্ত গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করার মতো ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। ফলে এ সময় তেলাপিয়া, চিংড়ি বা পাঙ্গাস জাতীয় মাছ ফ্লক তৈরি হওয়ার আগে প্রথম ২-৬ দিনের মধ্যে বিষক্রিয়ায় মারা যেতে পারে। কিন্তু কৈ, শিং, মাগুর জাতীয় মাছ কাদার ভেতরে থেকে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে এরা প্রাকৃতিকভাবেই অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট এমনকি মিথেনের মতো বিষাক্ত গ্যাসও নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে।

যাইহোক, প্রতি ঘনমিটারে ১০০-৩০০ এর বেশি পোনা ছাড়া যাবে না। অনেকে বেশি পোনা ছাড়েন, তারপর কোনো কারণ ছাড়াই মরতে শুরু করে। কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে ডিও, টিডিএস এটা ওটার সমস্যা খুঁজতে হাঁতড়াতে থাকেন। ছোট ট্যাংকের মধ্যে বেশি পোনা ছাড়লে মরার সম্ভাবনাই বেশি। সেটা ছোট পোনাই হোক আর বড়। কারণ ছোট ট্যাংকে অক্সিজেন সরবরাহ ভালোভাবে করা যায় না, বা অনেকে ছোট পাম্প বসিয়ে রাখেন। তাছাড়া ট্যাংকের তুলনায় মাছ বেশি হলে খাবার বেশি দেওয়ার কারণে অতিরিক্ত খাবার বেশি জমে যায়, সেই সঙ্গে তলানিতে জমতে থাকে মাছে অতিরিক্ত মল। এলে ট্যাংকের তলায় স্লাজ জমে প্রচুর অ্যামোনিয়া ও নাইট্রাইট গ্যাস তৈরি হয়। অন্যদিকে অক্সিজেন সরবরাহও যথেষ্ট না থাকার কারণে দ্রুতই মাছ মারা যায়।

অর্থাৎ যারা প্রথম শুরু করতে চান তাদের যতোটা সম্ভব কম মাছ ছাড়াই ভালো। প্রথমেই লাভের চিন্তা না করে অভিজ্ঞতার জন্য প্রজেক্ট করে বিনিয়োগের টাকা তুলে আনার চিন্তা করাই ভালো।

খাবার (ফিড) দেওয়ার নিয়ম

বায়োফ্লক (Biofloc) পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধাই হচ্ছে এতে খাবার খরচ প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়। এর কারণে হলো সরবরাহ করা খাবারের অতিরিক্ত অংশ যেটি ট্যাংকে জমে যাবে সেটি এবং মাছের মল ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজায়ারা ব্যবহার করে বংশবৃদ্ধি করে যে ফ্লক তৈরি করবে সেটি আবার মাছেরাই খাবে। এই ফ্লক দারুণ প্রোটিন সমৃদ্ধ। ফলে মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাবে এই ফ্লক। তার ফলে বাড়তি আমিষ জাতীয় খাদ্য সরবরাহ অনেক করতে হয়।

উপরে বর্ণিত সিস্টেমে মাছ ছাড়ার ২-৩ দিন খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে। শুরুর দিকে দৈনিক ৩-৪ চার খাবার দিতে হবে। খুব সকাল থেকে শুরু করে গোধূলী পর্যন্ত অর্থাৎ অন্ধকার নামার আগে পর্যন্ত নিয়মিত বিরতিতে খাবার দিতে হবে। তবে শিং মাগুর মাছ নিশাচর। এরা রাতে খাবার খেতে পছন্দ করে। এদের রাতে খাবার দেওয়াই ভালো। 

এভাবে এক মাস খাবার দিতে হবে। এরপর থেকে খাবার কমিয়ে দিনে ২ বার দিতে হবে, সকাল ও বিকাল। কারণ ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে ফ্লক তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। মাছেরা ফ্লক খেতে শুরু করবে।  এসময়টাতে পূর্ণ মনোযোগ থাকা উচিত ফ্লকের ওপর। তবে হঠাৎ করে খাবার কমিয়ে দেওয়া যাবে না। এটা ধীরে ধীরে (এক সপ্তাহে) কমিয়ে দুই বারে আনতে হবে।

বডিওয়েটের হিসাবে খাবার দেওয়া ভালো। তবে ওসব হিসাব-নিকাশে যেতে না চাইলে সহজ একটা হিসাবও আছে। প্রথম একমাস দিন চার বার খাবার দিতে হবে। খাবার দিন সময় নিয়ে। যখন দেখবেন মাছেরা আর খাবার খাচ্ছে না। অতিরিক্ত খাবার পানিতে ভাসছে। তখন খাবার দেওয়া বন্ধ করুন এবং অতিরিক্ত খাবার নেট নিয়ে ছেঁকে তুলে নিন। 

এর জন্য ভাসমান খাবার ব্যবহার করা ভালো। মাছের ফিড বিক্রেতার কাছে গিয়ে মাছের বয়স বললেই আপনাকে সেই মাপের খাবার দেবে।

এবার আসা যাক অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট এবং পিএইচ নিয়ন্ত্রণের কথায়। মাছ ছাড়ার প্রথম এক সপ্তাহ ফ্লক তৈরি না হওয়ার কারণে কোনোকিছু নিয়ন্ত্রণে না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। খাবার দেওয়ার শুরুর পর থেকেই কার্বোহাইড্রেড (কার্বন-নাইট্রেট ব্যালেন্স-এর জন্য) দিতে হবে। খাবারের ৫০% মোলাসেস বা চিটাগুড় দিতে হবে। অর্থাৎ এক কেজি খাবার দিলে ৫০০ গ্রাম মোলাসেসও দিতে হবে।

যেসব কারণ ফ্লক তৈরি নাও হতে পারে
কিছু হাইজিন বা জৈবনিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিলে ট্যাংকে আশানুরূপ বায়োফ্লক (Biofloc) তৈরি নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে পুরো প্রজেক্টটিই বরবাদ হয়ে যেতে পারে। সব ঠিকঠাক অনুসরণ করার পরও যদি দেখা যায় ট্যাংকে যথেষ্ট ফ্লক তৈরি হচ্ছে না তাহলে এসব বিষয় যাচাই করে দেখতে হবে:

ক. প্রোবায়োটিক (Probiotic) মানসম্পন্ন ছিল কিনা

খ. পানিতে প্রচুর অক্সিজেন মিশ্রিত না থাকলে ফ্লক তৈরি হবে না। অর্থাৎ এরেশন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা দেখতে হবে

গ. বাইরে থেকে ক্ষতিকর জীবাণু কালচার ট্যাংকে প্রবেশ করে থাকতে পারে। এটি হতে পারে ধুলোবালি, পশুপাখি বা মানুষের আনাগোনা, নোংরা জিনিসপত্র ব্যবহার করা ইত্যাদি কারণে

ঘ. ক্লোরিনযুক্ত পানি ব্যবহার করা। যারা পৌর এলাকায় থাকেন এবং সাপ্লাই পানি ব্যবহার করেন তাদের জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্লোরিন কিন্তু মারাত্মক জীবাণুনাশক রাসায়নিক। সাপ্লাই পানি পরিশোধনের সময় প্রচুর ক্লোরিন দেওয়া হয়। তাই ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা ভালো। তা না পেলে অ্যান্টিক্লোরিন প্রয়োগ করে পানির পিএইচ নিউট্রাল করে নিতে হবে।

ঙ. আয়োডিনযু্ক্ত লবণ ব্যবহার করা যাবে। আয়োডিন ক্লোরিনের মতোই জীবাণুনাশক। অর্থাৎ এরা ব্যাকটেরিয়া (এখানে প্রোবায়োটিক (Probiotic)) মেরে ফেলে। এ কারণে বাজার থেকে সামুদ্রিক লবণ কিনতে হবে। ট্যানারিতে এ লবণ ব্যবহার করা হয়।

চ. কংক্রিটের ট্যাংক হলে নতুন সিমেন্ট থেকেও বিষক্রিয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে পানির পিএইচ অনেক বেড়ে যায়। এটি শোধন করার জন্য কলাগাছ বা গোবর পানি দিয়ে ট্যাংকটি পচিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ১৫-২০ দিন পচিয়ে ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে পানি নিতে হবে। বেশি সাবধানতার জন্য আবার পিএইচ মেপে নেওয়া যেতে পারে।
কংক্রিট ট্যাংকের এ ধরনের সমস্যা এড়াতে ট্যাংক বানানোর পর ইপক্সি রঙ করে নেওয়া যেতে পারে। বা পলিথিন বিছিয়ে নিলেও চলে।

গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার:
ডিজলভড অক্সিজেন বা পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান (DO)
টোটাল ডিজলভ সলিড বা পানিতে দ্রবীভূত কঠিন বস্তু (TDS)
পানির অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব (Water Acidity or Alkalinity): পিএইচ (pH)
অ্যামোনিয়া (Amonia- NH4)
পানির তাপমাত্রা (Temparature)
কার্বন-নাইট্রোজেন অনুপাত (C:N ratio)

বিভিন্ন প্যারামিটারের আদর্শ মান নিচে টেবিলে দেওয়া হলো:
biofloc system parameters standard value table

নিচে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

ডিও: পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমপক্ষে ৪ এমজি/লিটার বা থাকতে হবে। এবং স্যাচুরেশন হবে ৬০%। মাছ, চিংড়ি, অনুজীব (ফ্লক) এর বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট অক্সিজেন অত্যন্ত জরুরি।

তাপমাত্রা: উষ্ণমণ্ডলীয় মৎস্য প্রজাতির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো ২৮-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর নিচে হলে মাছ বা চিংড়ির পাশাপাশি ফ্লক তৈরি ও বৃদ্ধিও ব্যাহত হবে। ২০ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা হলে কিন্তু বায়োফ্লক (Biofloc) লাভজনক করা সম্ভব হবে না।

পিএইচ: আদর্শ মাত্রা হলো ৬.৮-৮.০। বায়োফ্লক (Biofloc) সিস্টেমের জন্য পিএইচ ৭-এর নিচে হলেও স্বাভাবিক ধরে নিতে হবে। তবে এর কম হলে নাইট্রিফিকেশন প্রসেস ব্যাহত হতে পারে। অর্থাৎ নাইট্রাইট মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

স্যালাইনিটি (লবণাক্ততা): এটি কোন প্রজাতির মাছ বা চিংড়ি চাষ করবো সেটির ওপর নির্ভর করে। যেমন, চিংড়ির মধ্যে যদি লোনা পানির গলদা চিংড়ি হয় তাহলে সে মোতাবেক স্যালাইনিটি লাগবে। বায়োফ্লক (Biofloc) সিস্টেমে কৃত্রিমভাবে স্যালাইনিটি তৈরি করা যায, সেটির মাত্রা ০-৫০ পিপিটির মধ্যে রাখা সম্ভব।

টিএএন (TAN): টোটাল অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন বা সংক্ষেপে অ্যামোনিয়ার পরিমান বলা যেতে পারে। বায়োফ্লক (Biofloc) -এ এটির আদর্শ মাত্রা হলো ১ এমজি/লিটার এর চেয়ে কম। অ্যামোনিয়ার বিষাক্ততা কিন্তু পিএইচ- এর ওপর অনেকখানি নির্ভর করে।

নাইট্রাইট: এটির আদর্শ মাত্রা ১ এমজি/লিটার- এর চেয়ে কম। বায়োফ্লক (Biofloc)ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্যারামিটার কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। এটির দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। এটি নির্ভর করে ফিডে প্রোটিনের মাত্রা, স্যালাইনিটি এবং ক্ষারত্বের ওপর। এ কারণে কম প্রোটিনযুক্ত ফিড দেওয়া নিরাপদ।

নাইট্রেট: এটির আদর্শ মাত্রা হলো ০.৫-২০ এমজি/লিটার। এই মাত্রার মধ্যে নাইট্রেট সাধারণত মাছ বা চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর নয়। ফলে এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

অর্থোফসফেট: এর আদর্শ মাত্রাও নাইট্রেটের মতো। ফলে এটি নিয়েও চিন্তার কিছু নেই।

অ্যালকালিনিটি বা ক্ষারত্ব: এটির মাত্রা ১০০ এমজি/লিটারের বেশি থাকা ভালো। উচ্চমাত্রার ক্ষারত্ব ব্যাকটেরিয়ার অক্সিজেন গ্রহণ সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং নাইট্রিফিকেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

থিতানো কঠিনবস্তু বা সেটলিং সলিডস (এসএস): চিংড়ির জন্য এর আদর্শ মাত্রা হলো ৫-১৫ এমএল/লিটার। তেলাপিয়া পোনার জন্য ৫-২০ এমএল/লিটার, কিছুটা বড় ও বড় তেলাপিয়ার জন্য ২০-৫০ এমএল/লিটার। এসএস পরিমাপের জন্য ইমহফ কোণ ব্যবহার করা ভালো। এসএস বেশি হলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে পারে এবং মাছের ফুলকায় জ্যাম লেগে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারে।

মোট দ্রবীভূত কঠিনবস্তু (টিএসএস) বা টিডিএস: এটি ৫০০ এমজি/লিটার- এর মধ্যে রাখা ভালো। অনেকে ১০০০ এর উপরে রাখার পরামর্শ দেন। আসলে টিডিএস নিয়ে এতো চিন্তার কোনো কারণ নেই। বায়োফ্লক (Biofloc) সিস্টেমে টিডিএসের প্রভাব ও গুরুত্ব কতোখানি সেটি কিন্তু এখনো পরিষ্কার নয়। এটি বেড়ে গেলে এসএস- এর মতোই অক্সিজেনের মাত্রা এবং মাছের ফুলকা জ্যাম হয়ে যেতে পারে। 

কার্বন-নাইট্রোজেন অনুপাত: এটির ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। অনেকে বলেন এর অনুপাত ১০:১ রাখা ভালো। আবার কেউ বলেন ১২-১৮:১। আসল কথা হলো, যতো কার্বোহাইড্রেট দেবেন তার দশ ভাগের একভাগ প্রোটিন দিতে হবে। এক্ষেত্রে ফিড সিলেকশনের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। বেশি প্রোটিনযুক্তা ফিড ব্যবহার করা যাবে না।
kits for biofloc system-BFT
বায়োফ্লক প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় কিট

সবচেয়ে বড় কথা হলো, বায়োফ্লক (Biofloc) সিস্টেমের নজর রাখা উচিত ডিও, অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট এসবের মাত্রার ওপর। তাছাড়া অতিরিক্ত খাবার দেওয়া ও যথেষ্ট ফ্লক না থাকা এবং নাইট্রিফিকেশন না হওয়ার কারণে ট্যাংকের তলে স্লাজ বা গাদ জমে যায়। এতে কিন্তু দ্রুত অ্যামোনিয়ার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, বিপরীতে কমে যাবে ডিও মাত্রা। এ কারণে মাঝেমধ্যেই ট্যাংকের তলদেশ পরীক্ষা করতে হবে। অতিরিক্ত গাদ জমে গেলে ঘেঁটে দেওয়ার দরকার। প্রয়োজন হলে নিচের পানি বের করে দিয়ে সমপরিমান সাধারণ পানি যোগ করতে হবে। 

আবার বাংলাদেশে অনেক অঞ্চলে টিউবওয়েল বা অগভীর নলকূপের পানিতে প্রচুর আয়রন উঠে আসে। এ কারণে গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করা ভালো।

টিপস
লবণের সঙ্গে টিডিএসের একটা সম্পর্ক আছে। সাধারণ লবণ দিলে টিডিএসের মান বাড়তে পারে। কিন্তু সেই সঙ্গে স্যালাইনিটিও বাড়বে। আর স্যালাইনিটি আর টিডিএস সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। টিডিএস বলতে অন্য অনেক রাসায়নিকের দ্রবণ বুঝায়। 
কোনো কারণে টিডিএস, অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট বা নাইট্রাইট ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয় তাহলে সহজ উপায় হলো বেশিরভাগ পানি বের করে দিয়ে সমপরিমান নতুন ফ্রেশ পানি ঢুকানো। 
অতিরিক্ত স্লাজ জমে যাওয়ার কারণেও অ্যামোনিয়া, টিডিএস বা অন্যান্য ক্ষতিকর বিষয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এ সমস্যা এড়ানোর উপায় হলো স্লাজ বেড়ে গেলে বের করে দেওয়া। এরপর সমপরিমান ফ্রেশ পানি ঢুকানো।

আরো পড়ুন:

Post a Comment

0 Comments