সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি, কৌশল এবং ধারণা

গরু মোটাতাজাকরণ

গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ বলতে কী বোঝায়? গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ একটি উৎপাদন কৌশল যেখানে পশুর সাধারণ কার্যকলাপ কমিয়ে আনা হয় বা একেবারে বন্ধ করা হয়। যেমন: দুধ দেওয়া, বাচ্চা দেওয়া, ষাঁড় গরুকে প্রজননে ব্যবহার করা, হালচাষ ইত্যাদি কাজ থেকে তাদের অবসর দিয়ে শুধু পর্যাপ্ত খাওয়ানো হয়।  এতে অল্প সময়ের মধ্যে পশু বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠে। আর মাংস বা কোরবানির বাজারে এই পশুর ব্যাপক চাহিদা থাকে।

গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প সরকার আগে শুধু গ্রামেগঞ্জে প্রাণিসম্পদ বিভাগের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করতে গ্রহণ করতো। কিন্তু এটি এখন এতোটাই লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে যে শহরে এবং মফস্বলেও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে, প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। 

গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ আগে শুধু দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য একটি কার্যকরী হাতিয়ার বলে মনে করা হতো। কিন্তু এখানে এখন পয়সাওয়ালারা আসছে। বিশেষ করে বিদেশ ফেরত বা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এই খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছেন। 

গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ মূলত মাত্র ৯০ দিনের প্রকল্প। সুষম প্রোটিন, উচ্চ ক্যালরি যুক্ত খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ গরুর লাইভ ওজন দ্রুত বাড়াতে সহায়তা করে। ফলে মাত্র তিন মাসের মধ্যে বেশ ভালো দামে একটি গরু বিক্রি করা যায়। কোরবানির সময় তো এখন বহু মানুষের বিনিয়োগের খাত হয়ে উঠেছে এটি।

মোটাতাজাকরণের জন্য গবাদিপশু বাছাই

গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ করার জন্য আপনার একমাত্র কাজ হচ্ছে পশুকে পর্যাপ্ত খাওয়ানো। তবে এখানে পশু বাছাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাছাইয়ে ভুল করলে কিন্তু লাভ করা যাবে না।

বাছাইয়ে দুটি বিকল্প আছে: হয় আপনি নিজের পাল/খামার থেকে গবাদিপশু নেবেন, অথবা হাট থেকে বা গ্রামের অন্য কৃষকদের কাছ থেকে গবাদিপশু কিনবেন। আবারও বলি, যদি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসা শুরু করার আগেই আপনি ক্ষতির মুখে পড়বেন।

গবাদিপশু কেনার সময় বাজারমূল্যের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন জাতের এবং লিঙ্গের গরুর চাহিদার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বাজারে কোন গরুর মাংসের চাহিদা বেশি, গত কয়েকটি কোরবানির হাটে কোন ধরনের গরু বেশি বিক্রি হয়েছে এসব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে গবাদিপশুর জাত, লিঙ্গ, শরীরের অবস্থা এবং বয়স খেয়াল রাখতে হবে। এর কারণ হল বিভিন্ন ধরনের গবাদিপশুর মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন।

দেশে কিন্তু নির্দিষ্ট মৌসুমে গবাদিপশুর দাম কম থাকে। বিশেষ করে দেখবেন বর্ষা মৌসুমে যখন মাঠেঘাটে খাবারের সংকট থাকে তখন গরুর দাম কমে। যখন দাম অনুকূলে থাকে তখন গরু কিনতে হবে। এর জন্য আগে থেকেই নগদ টাকা প্রস্তুত রাখুন।

এলাকা বিবেচনা

গবাদিপশু পালনের বিষয়টি খাদ্য সরবরাহ, খাদ্যের মান এবং পরিমাণের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। সঠিক ফিড জানা থাকলে দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এটা জানা কথা। প্রোটিন, খনিজ, ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট এবং চর্বির সরবরাহ যথেষ্ট আছে এমন ঘাসের চারণভূমি, শস্য (গম, ভুট্টা, ডাল ইত্যাদি) এবং খড় বা হে পাওয়া যায় কি না খোঁজ নিয়ে দেখুন। 

এলাকায় ফিড পাওয়া গেলে ভালো।  ধানের খড়, ভুট্টা, কাঁচা ঘাস, চালের কুঁড়া এবং ঝোলাগুড়ের (মোলাসেস) মতো খাদ্য উপাদানগুলো প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় কি না নিশ্চিত হয়ে নিন। সারা বছর খাওয়ানো এমন ঘাসের জমি বা চারণ ভূমি থাকতে হবে।

ভালো মানের ফিডার স্টক আপনার প্রতিবেশী, পশুরখাদ্যের বাজার এবং বাণিজ্যিক খামার থেকে হয়তো পেতে পারেন। তবে যেগুলো আপনার জন্য সহজলভ্য সেগুলোর দিকেই নজর রাখুন।

আবাসন

সঠিক আবাসন এবং তাকে আরাম দেওয়ার মতো সরঞ্জামাদি আছে এমন একটি শেড গবাদিপশুর মাংস বৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেডের সঙ্গে গরুর হাঁটাচলার জন্য খোলা জায়গা থাকলে সবচে ভালো হয়। গবাদিপশুকে প্রচণ্ড গরম বা ঠান্ডা থেকে রক্ষা করতে হবে। ছায়াযুক্ত স্থানে শেড হওয়া জরুরি।

শেড হালকা দেশীয় উপকরণ দিয়েই তৈরি করা যায়। আপনি বাঁশ এবং খড়ের ছাউনি দিয়েই করতে পারেন। অবশ্য টাকা থাকলে পাকা শেড বানানো যেতেই পারে। তাতে গরু গোবর ও মূত্র ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। খড় জাতীয় জিনিসের চালা দিতে পারলে গরুকে চরম (গরম/শীত) আবহাওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। শেডে প্রতিটি গরুর জন্য কমপক্ষে ৪ X ৭ ফুট জায়গা রাখতে হবে।

মোটাতাজাকরণ গবাদিপশু নির্বাচন

গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ থেকে ভালো আয় নিশ্চিত করতে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত:

১. বয়স: অল্পবয়সী গরুকে মোটাতাজা করতে বেশি দিন খাওয়াতে হয়। খাদ্য রক্ষণাবেক্ষণ, বৃদ্ধি এবং গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে একটু বয়স্ক গরু কম সময়ের মধ্যে মোটাতাজা করা যায়।  মোটাতাজাকরণের জন্য গবাদিপশুর বয়স ২ থেকে ৩ বছর হওয়া ভালো।  ষাঁড় মোটাতাজাকরণের জন্য উপযুক্ত।  ১.৫ - ২ বছর বয়সের একটি ষাঁড় বাছুর কেনা ভালো।

২. ওজন বাড়ানো: দ্রুত ওজন বাড়াতে এবং খামারে সহজে হ্যান্ডল করার জন্য গাভী বা ষাঁড়ের তুলনায় স্টিয়ার (কাস্টেটেড বা বলদ গরু) বেছে নেওয়া ভালো।

৩. স্বভাব: সক্রিয় তবে শান্ত স্বভাবের বলদ সাধারণত দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সহজেই মোটা হয়। অস্থির, স্নায়বিক উত্তেজনায় ভোগা এবং অস্বাভাবিক আচরণের গবাদিপশু শুধুই ক্যালরি অপচয় করে।

৪. গঠন: বিভিন্ন অঙ্গের আকার এবং ধরন দেখে একটি গরুর অবস্থা অনেকখানি বোঝা যায়। বেশি খেতে পারে, ব্যাপক রুচি ও ক্ষুধা, বিশাল বুকের বেড়, উঁচু স্পষ্ট পাঁজর এবং চওড়া, ভরাট বুকের গরু নিঃসন্দেহে ভালো ফল দিবে।

৫. জাত: উন্নত জাতের গরুর দেশীয় জাতের তুলনায় কম খাদ্যে দ্রুত ওজন বাড়ে। আজকাল ফ্রিজিয়ান ষাঁড় পালনের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে কোরবানির বাজারের জন্য সিন্ধি, শাহীওয়াল এবং দেশি শঙ্কর জাত বেছে নেওয়াই ভালো। এসব গরু দেখতে সুন্দর।

তবে চাইলে নিচের বিদেশি জাতগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

    ক. ব্রাহমা: মাংসের জন্য সেরা গরু। ব্রাহমার রোগ এবং তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। অনেক দেশেই মাংসের জন্য এই গরু পালন জনপ্রিয় হচ্ছে। দেশেও সরকারি উদ্যোগে কিছু জায়গায় পাইলট প্রকল্প চলছে।

   খ. ওঙ্গোল বা মেলোর: মেলোরের রঙ সাদা, তবে ষাঁড়ের মাথা, ঘাড় এবং কুঁজে গাঢ় ধূসর হতে পারে।  এটিও ভালো। তবে দেশে এখনো পালন শুরু হয়নি।

   গ. ইন্দো-ব্রাজিল: রঙ হালকা থেকে রূপালী ধূসর হয়। ইন্দো-ব্রাজিল এবং জেবুর উৎপত্তি ব্রাজিল থেকে। এই গরু আকারে বিশাল। শিংগুলো পেছনের দিকে বাঁকানো।

 ৬. প্রাণীর স্বাস্থ্যের অবস্থা: একটি সুস্থ প্রাণী সজাগ, উজ্জ্বল চোখ;  মসৃণ লোম এবং মুখ ভেজা বা ঘামা থাকবে। 

খাদ্য এবং পুষ্টি

গরু মোটাতাজাকরণের জন্য সেরা খাদ্য কী? বার্লি গবাদিপশুদের খাওয়ানোর জন্য সর্বোত্তম শস্য, তবে গম, ভুট্টা এবং ওট ব্যবহার করা যেতে পারে। গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের জন্য ওটস নিজেই একটি আদর্শ শস্য নয় তবে অন্যান্য শস্যের সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে। খড় বা সাইলেজ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের গবাদিপশুকে সঠিক পরিমাণ এবং প্রকারের খাদ্য সরবরাহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসার সাফল্য নির্ভর করে গবাদিপশুর ওজন বাড়ানো এবং উন্নতমানের মাংস তৈরির ওপর।

অনেক দেশে মোটাতাজাকরণ গবাদিপশু স্টক ফিড বিক্রির যেসব কোম্পানি আছে তারা ৯০ দিনের কোর্স ফিড লট বিক্রি করে।  স্টক ফিড হলো উচ্চ ক্যালরির চর্বিযুক্ত খাবার,  মোটাতাজাকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পুষ্টি উপাদান রয়েছে। 

আপনি চাইলে বাড়িতেই মোটাতাজাকরণ ফিড তৈরি করতে পারেন। 

একটি পশু প্রতিদিন কী পরিমাণ খাবে সেটি নির্ভর করে তার লাইভ ওয়েট (ওজন) এবং বয়সের মতো বিষয়ের ওপর। তবে

সাধারণত, একটি গরু গড়ে প্রতিদিন ৮ থেকে ১৫ কেজি খাবার খায়। আর প্রতিদিন একটি বলদ তার লাইভ ওয়েটের ৩.৪% খায়।  ৩৫০ কেজি  লাইভ ওয়েট হওয়া পর্যন্ত একটি গরুর গড়ে দৈনিক ওজন বাড়ে (ওয়েট গেইন) প্রায় ১.৬ কেজি।

মোটাতাজাকরণের জন্য খাদ্য (রেশন):

ইউরিয়া ও ঝোলাগুড় মেশানো খাদ্য মোটাতাজাকরণের জন্য দারুণ উপকারী। এই আইটেমগুলো দুটি উপায়ে সরবরাহ করা যেতে পারে:

১) খড়ের সাথে মিশ্রিত করে এবং ২) কনসেনট্রেটের (ভুট্টা বা অন্যান্য খাদ্য উপাদান) সাথে মিশ্রিত করে।

খড়ের সাথে ইউরিয়ার সংমিশ্রণে গবাদিপশুর খাদ্য তৈরি:

১. প্রথমে একটি বড় ঝুড়ি কাদা দিয়ে ভালো করে লেপে রোদে শুকিয়ে নিন।

২. একটি বালতিতে ২০ লিটার পানি নিন

৩. সেই পানিতে প্রায় ১ কেজি ইউরিয়া মেশান

৪. ঝুড়িতে অল্প পরিমাণ ছোট ছোট করে কাটা খড় রাখুন। তার উপর ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রে করুন। এভাবে স্তরে খড় সাজান। ইউরিয়ার দ্রবণ পুরোটি ব্যবহার করুন।

৫. ঝুড়ি এইভাবে খড় দিয়ে পূর্ণ করুন।

৬. ঝুড়ি পলিথিন দিয়ে ভালো করে ঢাকুন। এরপর মুখটি ভালো করে বায়ুরুদ্ধ করে বাঁধুন।

৭. ১০ থেকে ১২ দিন পর ঝুড়ি থেকে খড় বের করে রোদে শুকানোর জন্য পরিষ্কার জায়গায় রাখুন।

 ৮. রোদে শুকানোর পর খড় খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত হবে।

৯. গরুকে দৈনিক ৩ কেজি করে খেতে দিন।

১০. প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ঝোলাগুড় খড়ের সাথে মিশিয়ে খেতে দিন। তাহলে গরু মজা করে খাবে।

মোটাতাজা গবাদিপশু বাজারজাতকরণ

কেনার ছয় মাস পরে, গরুর ওজন আনুমানিক ২৭৫ থেকে ৩২৫ কেজি হলে তবেই গরু বাজারে তুলতে হবে। এই হিসাব ষাঁড় বাচ্চার জন্য। বয়স্ক গরু কিনলে ৯০ দিনের মধ্যে মোটামুটি এমন ওজন পেয়ে যাওয়ার কথা।

গবাদিপশুর পরিবহনের আগে এবং পরিবহন চলাকালীন  ভালোভাবে দক্ষ হাতে হ্যান্ডলিং না করার কারণে গুরুতর আঘাত বা এমনকি পশুর মৃত্যুও হতে পারে। গবাদিপশু পরিবহনের ক্ষেত্রে ট্রাকের পাটাতনে পর্যাপ্ত বিছানা (খড় বা অন্য কিছু) এবং নড়াচড়া করার জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে কি না লক্ষ্য করুন। ওভারলোডিং করবেন না। পরিবহনের সময় অবশ্যই  অতিরিক্ত খাওয়ানো এড়িয়ে চলুন।

মার্কেটিং টিপস:

গবাদিপশুর বর্তমান বাজারমূল্য সম্পর্কে সচেতন হোন।

প্রতি কিলো লাইভ ওজনের প্রচলিত মূল্যের ভিত্তিতে পশুর দাম ধরে বিক্রি করার চেষ্টা করুন। বিক্রির আগে পশুর ওজন জেনে নিন।

বেচার উপযুক্ত হয়েছে এমন গরুই শুধু বিক্রি করুন। কিছু গরুর যথেষ্ট ওজন না হলে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করুন।

কখনোই অসুস্থ পশু বিক্রি বা বাজারজাত করবেন না। এটি অনৈতিক এবং বেআইনি।

আরও পড়ুন:

গরু মোটাতাজাকরণের বিস্তারিত পদ্ধতি

গরু মোটাতাজারকণ প্রশিক্ষণ গাইড | পিডিএফ বই

দুধেল গাভী, বাছুর ও মোটাতাজাকরণ ষাঁড়ের জন্য খাবারের সহজ হিসাব

Post a Comment

0 Comments