বাংলাদেশের মানুষ খরগোশের মাংস খেতে অভ্যস্ত নয়। আবার অনেকের কিছু ভুল ধারণাও আছে। ধর্মী ও সামাজিক সংস্কারও আছে। তবে ইদানীং দেশে খরগোশের বাণিজ্যিক খামার বাড়ছে। অনেক রেস্টুরেন্টে এখন খরগোশের মাংসের কাবার বিক্রি করা হয়। ঢাকাতে তো শুধু খরগোশের কাবার বিক্রি করে এমন রেস্টুরেন্টও হয়েছে। তার মানুষ ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এটিই একটি বড় আশার কথা। দেশে বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
খরগোশ পালন কেন করবেন?
বাজারে পশুখাদ্যের অত্যধিক দাম, শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুতের বাড়তি দাম ইত্যাদি মিলিয়ে এখন পশুপালন প্রায় কঠিন হয়ে উঠেছে। আর নিত্যপণ্যের বাজারে। অস্থিরতার কারণেও পশুর বাজার ওঠানামা করছে। এই পরিস্থিতিতে খরগোশ পালন কম খরচে, কম শ্রমে এবং অত্যন্ত কম সময়ে একটি লাভজনক উদ্যোগ হতে পারে।
খরগোশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এখানে তুলে ধরলাম:
১. অল্প জায়গায় অল্প খাদ্য এবং বিনিয়োগে খরগোশ পালন করা যায়।
২. খরগোশের মাংসের প্রোটিন, এনার্জি, খনিজ এবং ভিটামিনের পরিমাণ অন্যান্য মাংসের চেয়ে বেশি এবং কোলেস্টেরল ফ্যাট ও সোডিয়াম কম থাকে।
৩. এদের মাংস সুস্বাদু ও সহজে হজম হয়
৪. সব ধর্মের মানুষ খেতে পারে। অর্থাৎ খরগোশের মাংস খেতে সামাজিক বা ধর্মীয় কোনো বাধা নেই।
৫. খরগোশ দ্রুতবর্ধনশীল এবং একটি স্ত্রী খরগোশ প্রতিবারে ২-৮টি বাচ্চা দেয়।
৬. এরা নিম্ন মানের খাবার খেয়ে অধিক পুষ্টিসম্পন্ন মাংস উৎপাদন করে।
অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় খরগোশ পালন বেশ সহজ। এদের খাদ্য এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয়বহুল নয় এবং সহজপ্রাপ্য। বাড়ি নারীরা বা ছেলে-মেয়েরা কাজ ও পড়াশোনার ফাঁকে সহজেই খরগোশের পরিচর্যা করতে পারে।
খরগোশের প্রজাতি:
বড় ওজন বিশিষ্ট জাত (৪ থেকে ৬ কেজি )
• হোয়াইট জায়ান্ট
• গ্রে জায়ান্ট
• ফ্লেমিশ জায়ান্ট
মাঝারী ওজন বিশিষ্টজাত
• নিউজিল্যান্ড হোয়াইট
• নিউজিল্যান্ড রেড
• ক্যালিফোর্নিয়ান
হালকা জাত
• সোভিয়েট চিনচিলা
• ডাচ্
অল্পবয়স্ক খরগোশের মাংস বেশি বয়স্ক খরগোশের মাংসের তুলনায় উন্নতমানের। আবার স্ত্রী খরগোশের মাংসের তুলনায় পুরুষ খরগোশের মাংস তুলনামূলক উন্নত মানের হয়। এর বড় কারণ স্ত্রী খরগোশ সাধারণত প্রতি মাসে বাচ্চা দেয়। ঘন ঘন প্রজননের কারণে এদের শরীরে যথেষ্ট পুষ্টি মজুত হতে পারে না।
খরগোশের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাংসে কোলেস্টেরল এবং চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং প্রোটিন বা আমিষের পরিমাণ কমে যায়। স্ত্রী খরগোশের মাংসে লিপিড, ফ্যাট এবং কোলস্টেরল বেশি থাকে।
খরগোশ পালনের সুবিধা:
১. খরগোশ দ্রুত বাড়ে। শরীরেও যেমন বাড়ে, সংখ্যাও এরা দ্রুত বাড়ে।
২. এক মাস পরপর এক সাথে ২-৮ টি বাচ্চা দেয়।
৩. অল্প জায়গায় ও অল্প খাদ্যে পারিবারিকভাবে পালন করা যায়। অল্প খরচে অধিক উৎপাদন সম্ভব।
৪. খরগোশের মাংস অধিক পুষ্টি গুণসম্পনড়ব। সব ধর্মের মানুষই এর মাংস খেতে পারে।
৫. মাংস উৎপাদনের দিক থেকে পোল্ট্রির পরেই খরগোশের স্থান।
৬. রান্না ঘরের উচ্ছিষ্টাংশ, বাড়ির পাশের ঘাস ও লতা-পাতা খাইয়েই এদের পালন করা সম্ভব।
৭. পারিবারের লোকজনই যত্ন নিতে পারে। ফলে আলাদা করে শ্রমিক রাখার দরকার হয় না।
খরগোশ পালন পদ্ধতি
বাড়ির আঙিনা বা ছাদে অল্প জায়গায় অল্প বিনিয়োগ করে ছোট আকারের শেড তৈরি করে খরগোশ পালন করা যায়।
দুটি পদ্ধতিতে খরগোশ পালন করা যায়
১. গভীর লিটার পদ্ধতি
এই পদ্ধতিটি কম সংখ্যক খরগোশ পালনের জন্য উপযোগী। কংক্রিটের মেঝে হওয়া উচিত। না হলে এরা খুঁড়ে গর্ত বানিয়ে ফেলবে। মেঝের উপর ৪-৫ ইঞ্চি পুরু করে তুষ, ধানের খড় অথবা কাঠের ছিলকা ইত্যাদি ছড়িয়ে দিতে হবে।
এই পদ্ধতিতে এক সাথে ৩০টির বেশি খরগোশ পালন করা ঠিক নয়। পুরুষ খরগোশ আলাদা ঘরে রাখা উচিত। অবশ্য এভাবে প্রতিপালন করলে কিছু ঝুঁকি আছে: খরগোশ সহজে রোগাক্রান্ত হতে পারে। তাছাড়া খরগোশকে সামলানোও খুব অসুবিধা হয়।
আমাদের দেশে সাধারণত পরিবহনযোগ্য নেটের খাঁচা বা কাঠের বাক্স খরগোশ প্রতিপালনের জন্য ব্যবহার করা হয়। খামারিরা দিনের বেলায় ঘরের বাইরে এবং রাতে ঘরের ভেতরে আনতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো কোনো এলাকাতে পুরুষ এবং স্ত্রী খরগোশ একত্রে রাখা হয়। কিন্তু বাচ্চা দেওয়ার পর বাচ্চাসহ স্ত্রী খরগোশকে আলাদা করে ফেলতে হবে। আবার কোনো কোনো এলাকায় স্ত্রী এবং পুরুষ খরগোশকে সবসময় আলাদা রাখা হয়। কেবল প্রজননের সময় পুরুষ খরগোশকে স্ত্রী খরগোশের কাছে দেওয়া হয়।
২. খাঁচা পদ্ধতি
বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালনের জন্য লোহার পাত দিয়ে তৈরি ৩-৪ তাকবিশিষ্ট খাঁচা বেশি উপযোগী। প্রতিটি তাকে খরগোশের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা রেখে খোপ তৈরি করতে হবে।
খাঁচাতে খরগোশের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা:
ক. প্রাপ্তয়বস্ক পুরুষ খরগোশের জন্য ৪ বর্গফুট
খ. প্রাপ্তবয়স্ক মা খরগোশের জন্য ৬ বর্গফুট (প্রসূতি ঘরসহ)
গ. বাচ্চা খরগোশের জন্য ১.৫ বর্গফুট
প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশের খাঁচা ১.৫ ফুট লম্বা, ১.৫ ফুট চওড়া এবং ১.৫ ফুট উঁচু হওয়া উচিত। এতে বাড়ন্ত দুটি খরগোশ পালন করা যাবে।
বড় আকারের খরগোশের জন্য ৩ ফুট লম্বা, ১.৫ ফুট চওড়া এবং ১.৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট খাঁচা উপযোগী।
২০ ফুট লম্বা, ১৩ ফুট প্রস্থ ও ১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁশের বা পাকা ঘরে প্রায় ১৫০-২০০টি খরগোশ খাঁচায় লালন পালন করা যায়।
খাঁচার মাপ
খরগোশের ওজন যত কেজি হবে খাঁচার তলদেশও তত বর্গফুট হতে হবে। ৬টি খরগোশের জন্য খাঁচার মাপ নিচে দেওয়া হলো :
* কাঠামো (ফ্রেম) : দৈর্ঘ্য ৯ হাত x ১/৫ হাত থেকে ২ হাত, মেঝে ১৬ কেজি তারের জাল ৯ হাত x ১/৫ হাত।
* দেয়াল : পাতলা ও শক্ত কাঠের তক্তা দিয়ে করতে হবে।
* ছাদ : তারের জাল দিয়ে তৈরি করতে হবে।
* স্ত্রী খরগোশের খাঁচায় একটি ছোট নেট বক্স দিতে হবে। এবং এর মাপ হবে ১ফুটx১ফুট, উচ্চ ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি হবে।
* বাক্সের একপাশ এবং উপরের অংশ খোলা রাখতে হবে।
প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশের খাঁচা
১.৫ ফুট লম্বা, ১.৫ ফুট চওড়া এবং ১.৫ ফুট উচু হওয়া উচিত। এটা একটা বড় খরগোশ বা বড় হচ্ছে সেরকম দুটোর জন্য উপযুক্ত।
বড় হচ্ছে এমন খরগোশের খাঁচা
লম্বা ------- ৩ ফুট
চওড়া ------- ১.৫ ফুট
উচ্চতা ------ ১.৫ ফুট
প্রজননের জন্য খাঁচা
বড় হচ্ছে এমন খরগোশদের প্রজননের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু খাঁচার তলা এবং পাশগুলো ১.৫ ইঞ্চি/১.৫ইঞ্চির ওয়েল্ড-মেশ দিয়ে বানানো উচিত- যাতে ছোট খরগোশগুলো বেরিয়ে আসতে না পারে।
মেটার্নিটি বাক্সের পরিমাপ
কিন্ডলিং বা বাচ্চা প্রসবের সময় নিরাপদ ও শান্ত পরিবেশ থাকা জরুরি। নেস্ট বাক্স গ্যালভানাইজড লোহা বা কাঠ দিয়ে বানানো যায় এবং সাইজটা এমন হওয়া উচিৎ যাতে ছোট ছোট নবজাতক খরগোশগুলোকে খাঁচার ভেতরে রাখা যায়।
দৈর্ঘ্য ------- ৪০ সে.মি.
প্রস্থ ------ ৩০ সে.মি.
উচ্চতা ------ ২৫ সে.মি.
দরজা -------- ১৫ সে.মি.
নবজাতক বাচ্চাগুলোর জন্য আলাদা বাক্স থাকতে হবে। সেখানে নরম কিছু বিছিয়ে দিতে হবে। তবে ধুলা বা ছাই ওড়ে এমন কিছু কোনোভাবেই দেওয়া যাবে না। এতে বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
বাচ্চাদের বাক্সটি এমন স্থানে রাখতে হবে যেন সেখান থেকে বেরিয়ে মা খরগোশটি হাঁটািহাঁটি নড়াচড়া করতে পারে। আবার বাচ্চাগুলো যেন তাদের বাক্স থেকে পড়ে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
উঠানে খরগোশ পালনের খাঁচা
উঠানে খরগোশ পালনের খাঁচা মেঝে থেকে ৩ – ৪ ফুট উপরে বানানো উচিত। খাঁচার তলাটা পানি নিরোধক হওয়া উচিত। যাতে বৃষ্টিবাদলের সময় নিচ থেকে ভিজে না ওঠে।
খাবার এবং পানির পাত্র
খরগোশের খাবার এবং পানির পাত্র সাধারণত গ্যালভানাইজড লোহার হয়। খাবারের পাত্রের আকার ইংরেজি জে- অক্ষরের মতো বানানো হয় এবং সেটি খাঁচার বাইরে লাগানো হয়ে থাকে। বিনিয়োগ কমানোর জন্য খাবার এবং পানি কাপেও দেওয়া যেতে পারে।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
বয়স ও প্রজাতি ভেদে খরগোশের খাদ্য গ্রহণ ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হয়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশের খাদ্যে পুষ্টির জন্য ক্রুড প্রোটিন ১৭-১৮%, আঁশ ১৪%, খনিজ পদার্থ ৭% ও বিপাকীয় শক্তি ২৭০০ কিলোক্যালরি/ কেজি হওয়া প্রয়োজন।
খাদ্যে পরিমাণ
প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশের জন্য প্রতিদিন ১৩০-১৪৫ গ্রাম, দুগ্ধবতী খরগোশের জন্য প্রতিদিন ২৫০-৩০০ গ্রাম ও বাড়ন্ত খরগোশের জন্য প্রতিদিন ৯০ গ্রাম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
খাদ্যের ধরন
খরগোশ সম্পূর্ণ তৃণভোজী প্রাণী। শাকসবজি, লতাপাতা এবং মূল জাতীয় শস্যই এদের প্রধান খাদ্য। তবে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করতে চাইলে পাশাপাশি দানাদার খাদ্যও দিতে হবে।
খাদ্য
সবুজ শাকসবজি: ঋতু ভিত্তিক সবজি, পালং শাক, গাজর, মুলা, শশা, শাকের উচ্ছিষ্টাংশ, সবুজ ঘাস ইত্যাদি।
দানাদার খাদ্য: চাল, গম, ভুট্টা, তৈলবীজ ইত্যাদি।
তবে, বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালনের জন্য ব্রয়লার মুরগির জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্য খরগোশের রেশন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
নিচের চিত্রে প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশের খাদ্য তালিকা দেওয়া হলো:
প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্য উপকরণ পরিমাণ (গ্রাম)
ভুট্টাদানা/গম ভাঙা: ৪৫.০
গমের ভুসি: ৩৫.০
তিলের খৈল: ১২.০
সয়াবিন: ৭.১০
লবণ: ০.৫০
ভিটামিন প্রিমিক্স: ০.২৫
মিথিওনিন: ০.১৫
খরগোশের দৈনিক খাদ্য চাহিদা
খরগোশের ধরন আনুমানিক দৈহিক ওজন (কেজি) দানাদার (গ্রাম) সবুজ কচি ঘাস ও শাকসবজি (গ্রাম)
পুরুষ খরগোশ ৪-৫ ১৭৫ ২০০
স্ত্রী খরগোশ ৪-৫ ১৫০ ২০০
দুগ্ধবতী স্ত্রী খরগোশ ৪-৫ ২৫০ ২৫০
দুধবিহীন স্ত্রী খরগোশ ৪-৫ ১৫০ ২০০
দুধ ছাড়ানো বাচ্চা (৬ সপ্তাহ) ০.৬-০.৭ ৫০ ১০০
খরগোশকে খাবার খাওয়ানোর নিয়ম
১. নতুন খরগোশ কিনলে খরগোশটি কী ধরনের খাবার খায় তা জেনে কেনার আগের ১/২ সপ্তাহ যে ধরনের খাবার খেয়েছে সে ধরনের খাবার দিতে হবে। পরে আস্তে আস্তে অন্য খাবারের অভ্যাস করতে হবে।
২. কম করে কিন্তু বারে বারে, কমপক্ষে দিনে ৩ বার খাবার দিতে হবে।
৩. পরিষ্কার ও তাজা খাবার দিতে হবে।
৪. আগের না খাওয়া খাবার সরিয়ে ফেলতে হবে।
৫. বিভিন্ন ধরনের খাদ্যে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।
৬. শুকনা খাদ্য দিতে হবে।
৭. প্রতিদিন একই সময়ে খাবার দিতে হবে।
৮. হঠাৎ করে খাবার পরিবর্তন করা যাবে না।
প্রজনন
১. স্ত্রী ও পুরুষ খরগোশ আলাদা থাকবে।
২. প্রজননের সময় স্ত্রী খরগোশটিকে পুরুষ খরগোশের খাঁচায় ১০/১৫ মিনিট রাখতে হবে।
৩. গর্ভধারণ নিশ্চিত করার জন্য পরের দিন আবার একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
৪. বছরে ৫/৬ বার বাচ্চা নেয়ার হিসাব ধরে প্রজনন প্রোগ্রাম তৈরি করতে হবে। এতে বাচ্চা বড় ও সুস্থ হবে এবং মৃত্যুর হারও অনেক কমে যাবে।
প্রজননের জন্য খরগোশ নির্বাচন
১. সবচেয়ে বেশি ওজন বিশিষ্ট খরগোশ নির্বাচন করতে হবে।
২. কোনো প্রকার অসুস্থ খরগোশকে প্রজনন করানো যাবে না।
৩. দুই থেকে তিন মাসের বিরতিতে মাদি খরগোশকে জন্মদান করানোর জন্য নির্বাচন করতে হবে।
৪. সাধারণত ৬/৭ টি মাদি খরগোশের জন্য ১টি পুরুষ খরগোশ ব্যবহার করা হয়।
৫. ১টি পুরুষ খরগোশকে সপ্তাহে ৩/৪ বারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না।
স্ত্রী খরগোশের রজঃমতী বা গরম হওয়ার লক্ষণ
খরগোশের কোনো বিশেষ রজঃচক্র নেই। যখনই স্ত্রী খরগোশ সঙ্গম করতে দেয় তখনই সে রজঃমতী। কখনো কখনো স্ত্রী খরগোশের যোনিদ্বারে অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চার হয়। সামনে পুরুষ খরগোশ রাখা হলে স্ত্রীটি পিঠ নীচু করে পেছন উঁচু করে দেয়। স্ত্রীটি যদি গরম না হয়, তাহলে খাঁচার কোণে চলে যায় এবং পুরুষটিকে আক্রমণ করে।
প্রজনন সম্পর্কিত তথ্য
• পুরুষ : স্ত্রীর অনুপাত---------------------১:১০
• প্রথম মেটিং এর বয়স-------৫-৬ মাস (পুরুষ খরগোশের জন্য একবছর যাতে বাচ্চার সংখ্যা বেশি পাওয়া যায়)
• মেটিং-এর সময় স্ত্রী খরগোশের শারীরিক ওজন---------------২.২৫-২.৫ কেজি
• গর্ভকাল----------------------------------------------------২৮-৩১ দিন
• দুধ ছাড়ানোর সময়-----------------------------------------------৬ সপ্তাহ
• বাচ্চা হওয়ার পর আবার মেটিং-এর সময়----------বাচ্চা হওয়ার ৬ সপ্তাহ পরে বা দুধ ছাড়ানোর পরে
• বিক্রীর বয়স-----------------------------------------------------১২সপ্তাহ
• বিক্রীর সময়ের ওজন-----------------------------------------প্রায় ২ কেজি বা তার বেশি
স্ত্রী খরগোশ কামোদ্রেকের লক্ষণ দেখালে তাকে পুরুষ খরগোষের খাঁচায় নিয়ে যাওয়া হয়। গর্ভধারণের ঠিক সময় হলে সে সঙ্গমের জন্য লেজ উঁচু করে। সফল মেটিংয়ের পর পুরুষ একদিকে এলিয়ে পড়ে এবং বিশেষ ধরনের আওয়াজ করে। মেটিংয়ের জন্য একটি পুরুষ খরগোশকে সপ্তাহে ৩/৪ দিনের বেশি ব্যবহার করা উচিৎ না। একইভাবে একটা পুরুষ খরগোশকে ব্রিডিংয়ের জন্য দিনে ২/৩ বারের বেশি ব্যবহার করা অনুচিত। ব্রিডিংয়ে ব্যবহৃত পুরুষ খরগোশকে যথেষ্ট বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাদ্য দিতে হবে।
একটা খামারে প্রতি ১০টি স্ত্রীর জন্য একটি করে পুরুষ খরগোশ থাকা দরকার। একটি বা দুটি বাড়তি পুরুষ খরগোশও খামারে রাখা যেতে পারে যাতে ব্রিডিংয়ের জন্য রাখা কোনো পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা কোনো কারণে অনাগ্রহ দেখালে তাদের ব্যবহার করা যায়।
খরগোশের গর্ভকাল ২৮ থেকে ৩০ দিন। মেটিংয়ের ১২ থেকে ১৪ দিন পরে স্ত্রী খরগোশের পেটে হাত দিয়ে গর্ভাবস্থা বোঝা যায়। পেছনের দুই পায়ের মধ্যবর্তী পেটে অনুভব করতে হবে। যদি একটা গোল পিণ্ড অনুভত হয়, বুঝতে হবে খরগোশটি গর্ভবতী।
যেসব খরগোশ মেটিংয়ের ১২/১৪ দিন পরেও গর্ভবতী হয়নি, তাদের আবার মেটিংয়ের জন্য পুরুষ খরগোশের কাছে পাঠানো হয়। যদি কোনো স্ত্রী খরগোশ পরপর তিনবার মেটিংয়ের পরও গর্ভধারণ না করে, তাহলে তাকে খামার থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
মেটিংয়ের ২৫ দিন পরে গর্ভবতী খরগোশের ওজন সাধারণতঃ ৫০০–৭০০ গ্রাম বেড়ে যায়। খরগোশটিকে তুললেই বাড়তি ওজন বোঝা যায়। এই সময় স্ত্রী খরগোশকে মেটিং করতে দিলে কোনো আগ্রহ দেখায় না।
গর্ভবতী খরগোশের যত্ন
গর্ভ নিরুপণ হওয়ার পর গর্ভবতীদের বাড়তি ১০০–১৫০ গ্রাম খাদ্য দেওয়া উচিৎ। মেটিংয়ের ২৫ দিন পরে গর্ভবতী খরগোশকে কিন্ডলিং খাঁচায় সরানো হয়। প্রত্যাশিত মেটিংয়ের দিনের ৫ দিন আগে নবজাতকের জন্য তৈরি করা বাক্সটি কিন্ডলিং বাক্স বা মেটার্নিটি বাক্সের মধ্যে রেখে দিতে হবে। বাচ্চার বাক্সে বেডিংয়ের জন্য শুকনো নারকেলের ছোবরা বা ধানের খড় বিছিয়ে দিতে হবে।
গর্ভবতী খরগোশ প্রসবের দুইদিন আগে নিজের পেটের লোম তুলে বাচ্চাদের জন্য বাসা বানায়। এই সময়ে খরগোশকে বিরক্ত করতে নেই এবংবাইরের লোককে খাঁচার সামনে যেতে দিতে নেই।
সাধারণতঃ বাচ্চা হয় খুব সকালে। বাচ্চা হওয়ার প্রক্রিয়া ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়। বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা বাক্সটি খুব সকালে উঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। কোনো মরা বাচ্চা থাকলে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে ফেলতে হবে। বাচ্চার বাক্স পরীক্ষা করার সময় মা খরগোশ খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাই মাকে আগে বাক্স থেকে সরিয়ে দিতে হয়।
নবজাত খরগোশের যত্ন ও সামলানো
জন্মের সময় নবজাত বাচ্চার চোখ বন্ধ থাকে এবং গায়ে কোনো লোম থাকে না। সব বাচ্চা সাধারণতঃ মায়ের বানানো বিছানায় শোয়া থাকে। সাধারণতঃ মা, দিনে একবার, খুব সকালে বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়। যদি মাকে জোর করে বাচ্চাদের দুধ খাওয়াতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়, দুধ আসবে না। যেসব বাচ্চা যথেষ্ট পরিমাণে মায়ের দুধ পায়, তাদের চামড়া চকচকে হয়। কিন্তু যারা মায়ের দুধ যথেষ্ট পায় না তাদের চামড়া শুকনো, কোঁচকানো থাকে, শরীরের তাপমাত্রা কম থাকে এবং তারা অলস হয়।
সৎমাকে দিয়ে খাওয়ানো
সাধারণতঃ স্ত্রী খরগোশের স্তনে ৮ থেকে ১২ টি বোঁটা (নিপল) থাকে। বাচ্চার সংখ্যা বোঁটর চেয়ে বেশি হলে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হয়। এ ছাড়া মায়ের মৃত্যু, মায়ের দ্বারা যত্নের অভাব, ছোট বাচ্চাদের খাঁচা থেকে পড়ে যাওয়ার ফলে মাকে চিনতে না পারা- এসবের কারণে ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য সৎ মা ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাচ্চাদের সৎ মায়ের কাছে সরানোর সময় যেসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে
• যেসব বাচ্চাকে সরাতে হবে তাদের বয়স এবং সৎ মায়ের বাচ্চাদের বয়সের তফাৎ ৪৮ ঘণ্টার বেশি হওয়া যাবে না।
• তিনটির বেশি বাচ্চা পরিবর্তন বা সৎ মাকে দেওয়া যাবে না।
বাচ্চার দুধ ছাড়ানো
বাচ্চা খরগোশদের জন্মের পর তিন সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের নির্দিষ্ট বাক্সে থাকতে দিতে হবে। তিন সপ্তাহ পর মেটার্নিটি খাঁচা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। বাচ্চাদের বুকের দুধ ছাড়ানো ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ বয়সে হতে পারে। বুকের দুধ ছাড়ানোর সময় মাকে আগে মেটার্নিটি খাঁচা থেকে সরিয়ে দিতে হবে। বাচ্চাদের ১-২ সপ্তাহ একই খাঁচায় রাখা যাবে। তারপর লিঙ্গ পরীক্ষা করে আলাদা খাঁচায় রাখতে হবে। বুকের দুধ ছাড়ানো খরগোশদের খাবার হঠাৎ করে পরিবর্তন করা যাবে না।
বাচ্চাদের মধ্য মৃত্যুর হার কমানো
জীবনের প্রথম ১৫ দিন বাচ্চা খরগোশেরা মায়ের অধীনে থাকে। এই সময়ে মা বা সৎ মায়ের বুকের দুধই বাচ্চাদের একমাত্র খাবার। এই সময় বাচ্চার মৃত্যু হয় প্রধানতঃ মা বা সৎ মায়ের জন্যই। ১৫ দিন বয়সের পর বাচ্চা ওদের জন্য দেওয়া পানি ও খাবার নিতে পারে। এই সময়ে রোগের সম্ভাবনা বেশী। তাই মা এবং বাচ্চাদের জন্য পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে দেওয়া উচিত। খরগোশদের জল দেবার ২০ মিনিট আগে লিটার প্রতি ১ মিলি লিটার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড মেলানো হয়।
খরগোশের রোগ ও প্রতিকার
সতর্কতাঃ
১. বাচ্চা জন্ম দেয়ার জন্য একটি ছোট নেস্ট বক্স অথবা কিছু পরিষ্কার খড়কুটা দিতে হবে।
২. বাচ্চা জন্ম দেয়ার জন্য শান্ত ও পরিছন্ন পরিবেশের দরকার হয়।
৩. জন্মের পর কোন মরা বাচ্চা থাকলে তা সরিয়ে নিতে হবে।
৪. জন্মের পর ১ মাস মায়ের সাথে বাচ্চা থাকবে।
৫. ১ মাস পর মা থেকে আলাদা করে একসাথে রেখে আরও ২ মাস পালার পর খাওয়ার উপযুক্ত হবে।
৬. বাচ্চার গায়ে হাত দিয়ে আদর করা ঠিক না। কারণ এতে বাচ্চার শরীরে অন্য গন্ধ হয় এবং মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে পারে।
৭. খরগোশের ঘর, খাঁচা, খাদ্য ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
৮. খাঁচা, নেস্ট বক্স পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে অনেকক্ষণ রোদে রাখতে হবে।
৯. পরিষ্কার খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দিতে হবে।
১০. পিঁপড়া, ইঁদুর, ছুঁচো, শিয়াল ইত্যাদির আক্রমণ থেকে খরগোশকে রক্ষা করতে হবে।
মিক্সোমাটোসিস (Myxomatosis)
এটি খরগোশের একটি প্রাণনাশক রোগ৷ আঙ্গোরা, ফ্লেমিস রাবিট, জ্যাক রাবিট ইত্যাদি প্রজাতির খরগোশের এই রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে বেশী৷ এই ভাইরাস পক্স ভাইরাস শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত৷ রোগগ্রস্ত অবস্থায় খরগোশের প্রজনন ঘটালে মুখ, নাক, ঠোঁট, কান, চোখের পাতা ইত্যাদি অঙ্গে ইডেমা হয়৷ কান দেহ থেকে ঝুলে পড়তে পারে৷ কখনও কখনও শ্বাসকষ্ট হয়৷
চিকিৎসা এই রোগের জন্য নির্দিষ্ট কোন ঔষধ নেই৷ রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়৷ সেফালেক্সিন বা এনরোফ্লক্সাসিন জলের সাথে মিশিয়ে খরগোশকে খাওয়ানো যেতে পারে৷
প্রতিরোধ ব্যবস্থা- অসুস্থ খরগোশকে মেরে ফেলে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে৷
ফর্মালিন বা ৩ শতাংশ সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড দিয়ে খরগোশের খামার জীবাণুমুক্ত করতে হবে৷
প্রতিষেধক টীকা পাওয়া গেলে খরগোশকে টীকা দিতে হবে৷
সালমোনেল্লেসিস (Salmonellosis)
সালমোনেল্লা টাইফিমুরিয়াম নামক ব্যাকটেরিয়া এই রোগের কারণ৷ এই রোগে খরগোশের দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় ও পাতলা পায়খানা হয়৷ গর্ভবতী খরগোশের গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ এই রোগে খরগোশের মৃত্যুহার অনেক বেশী৷
চিকিত্সা-এনরোফ্লক্সাসিন বা সেফালোক্সিন বা সিপ্রোফ্লক্সাসিন নামক আন্টিবায়োটিক খাওয়ালে ভাল ফল পাওয়া যায়৷
প্রতিরোধ ব্যবস্থা- খরগোশের খামার পরিষ্কার রাখতে হবে৷
দুষিত জল বা খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করতে হবে৷
মৃত খরগোশেকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে৷
খরগোশের খামারটিকে ভালভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে৷
পরজীবী ঘটিত রোগ (Parasitic diseases)
হেপাটিক কক্সিডিওসিস (Hepatic Coccidiosis)
আইমেরিয়া স্টাইডি নামক পরজীবী এই রোগের কারণ৷ সাধারণত কম বয়স্ক খরগোশের এই রোগ হয়৷
চিকিত্সা- সালফাকুইনক্সালিন ডেরিভেটিভ এই রোগের খুব ভাল ঔষধ৷ খাদ্যে শতকরা ০.০২৫ ভাগ হিসাবে ও পানীয় জলের শতকরা ০.০৪ ভাগ হিসাবে এই ঔষধ খরগোশটিকে খাওয়ালে খুব ভাল ফল পাওয়া যায়৷
ইন্টেসটিনাল কক্সিডিওসিস (Intestinal Coccidiosis)
আইমেরিয়া সিকিওলা, আইমেরিয়া ফ্লাভেসেনস, আইমেরিয়া ইন্টেসটিনালিস, আইমেরিয়া ইরেসিডুয়া, আইমেরিয়া ম্যাগনা, আইমেরিয়া মোডিয়া, আইমেরিয়া পারফোরানস, আইমেরিয় পিরিফর্মিস- এই আটটি প্রজাতির আইমেরিয়া ইন্টেসটিনাল কক্সিডিওসিসের কারণ৷
লক্ষণ- এই রোগের প্রধান কয়েকটি লক্ষণ হল পাতলা পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসবে, ক্ষুধামন্দাভাব, পেট ফুলে থাকবে এবং চকলেট রঙের মলত্যাগ করবে৷
প্রতিরোধ ব্যবস্থা- খরগোশের খামার মিয়মিতভাবে জীবানুমুক্ত করতে হবে৷
খাবার ও জলের পাত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে৷
খাদ্যে কক্সিডিওসিস রোধকারী ঔষধ মেশাতে হবে৷
*যেকোন সমস্যায় রেজিস্টারড ভেটেরিনারিয়ান এর পরামর্শ নিন।
অসুস্থ খরগোশের লক্ষণ/উপসর্গ
অসুস্থ খরগোশের চোখ ফ্যাকাসে,
কান খাড়া থাকে না,
লোম শুষ্ক ও রুক্ষ দেখায়, খাদ্য ও পানি পানে অনীহা প্রকাশ করে,
দৌড়াদৌড়ি কম করে,
শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যায়।
0 Comments