সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

বাড়িতে কম খরচে আলু ও পেঁয়াজ সংরক্ষণ পদ্ধতি, পরে বেশি দাম নিশ্চিত

potato and onion storage at home

বাংলাদেশের অধিকাংশ আলু জমি থেকেই বিক্রি করে দেন। মৌসুমে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ আলু বাজারে প্রবেশ করায় দাম পড়ে যায়। কৃষকেরা দাম পান না। প্রায় প্রতিবছরই কৃষকদের আহাজারি শোনা যায়, তাঁরা খরচের টাকাই তুলতে পারেননি।

একই অবস্থা পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও। জমি থেকে সংগ্রহ করে মহাজনের ট্রাকে ভরে দেন কৃষকেরা। তাতে তাঁরা তো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেনই, সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ ভোক্তারাও। এখনো আমাদের আলু, পেঁয়াজের মতো উচ্চ ফলনশীল ও উৎপাদনশীল দুটি ফসলে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর দেশে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এখন আলুর দামও আকাশচুম্বি। জীবনে কেউ কি কখনো ভেবেছে আলু কিনতে হবে ৬০-৭০ টাকা কেজি। আর পেঁয়াজ এখন একশ পেরিয়ে গেছে।

দুটিই কাঁচা ফসল। এমনিতে রেখে দিলে পচে যেতে পারে, পোকা ধরতে পারে। আবার ওজনেও কমে যায়। এ ছাড়া এ দুটি ফসলের ফলন অনেক বেশি হয়, ফলে এগুলো সংরক্ষণ করা পরিশ্রম ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। এ ছাড়া আলু ও পেঁয়াজ দুটিই মূলত মধ্যবর্তী ফসল। অর্থাৎ কৃষকের মূল ফসল বোনার আগের সময়টাতে এগুলো চাষ করে থাকেন। ফলে তাকে আলু বা পেঁয়াজ বিক্রি করে মূল ফসল আবাদের খরচ জোগাড় করতে হয়। এ কারণেও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না।

তবে ভালো দাম পেতে হলে অবশ্যই অন্তত কিছুদিন সংরক্ষণের একটা উপায় বের করতেই হবে। এটি করতে না পারলে কৃষকেরা বছর বছর এভাবে মার খেতেই থাকবে। মাঝখান থেকে টাকা বানাবে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। সামান্য কিছু খরচ আর বুদ্ধি খাটালেই এটি কৃষকেরা তাঁদের বাড়িতে বা যৌথভাবে তাঁদের ফসল সংরক্ষণ করতে পারেন। সেটি নিয়ে নিচে আলোচনা করা হয়েছে:

আলু সংরক্ষণ

দীর্ঘ সময় আলু রাখার জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য একমাত্র উপায় হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজ। এ জন্য ৮০ কেজির বস্তা প্রতি সাধারণত ৩০০ টাকা খরচ হয়। 

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো হিমাগারের সংকট। দেশে হিমাগার আছে ৩৫০ বা এর কিছু কমবেশি হবে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয় সে তুলনায় হিমাগারের সংখ্যা নগণ্য।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১ কোটি  ৩ লাখ টন আলু উৎপাদন  হয়েছিল। খাবার হিসেবে চাহিদার পরিমাণ ৬০-৭০ লাখ টন। আর বীজ হিসেবে প্রয়োজন প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টন। কিছু আলু রপ্তানি হয়।

মৌসুমে দাম না পাওয়ায় অনেকে খাটের নিচে কিংবা ঘরের মেঝেতে আলু স্তূপ করে রাখেন। এতে আলুর শতকরা ২০-৩০ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক আলু শুকে গিয়ে ওজন কমে যায়, রং খারাপ হয়ে যায়।

অথচ সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করেই আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব। এর জন্য খরচ অনেক কম। বস্তাপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা মাত্র। বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি ‘অহিমায়িত ঘর’ ব্যবহার করেও আলু গুদামজাত করা যায়। 

আলু সংরক্ষণের অহিমায়িত ঘর

ছায়াযুক্ত স্থানে বাঁশ বা কাঠের মাচার ওপর বানানো ঘরের ছাউনি হবে টিনের এবং চারদিকে থাকবে বাঁশের বেড়া। মাত্র এক শতাংশ জমিতে বানানো ঘরে ১৪-১৬ টন আলু রাখা যায়। একা সম্ভব না হলে কয়েকজন মিলেও এরকম ঘর তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। 

সংরক্ষণের প্রস্তুতি

আলু সংরক্ষণের পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক সময়ে সংগ্রহ। পরিপক্ব হওয়ার পর আলু তুলতে হবে। পরিপক্ব হয়ে গেলে আলু তোলার ৭-৮ দিন আগে গোড়া থেকে গাছ কেটে ফেলতে হবে।  কিংবা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আলু তোলা ঠিক নয়। আবার প্রখর রোদেও ঠিক নয়। এতে ব্ল্যাকহার্ট রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাজার থেকে বিশেষ করে বড় আলু কিনলে ভেতরে শুকিয়ে যাওয়া কালো অংশ দেখা যায়। এটিই আলুর ব্ল্যাকহার্ট রোগ।

তাই ভালো আবহাওয়া দেখে সকালবেলা আলু তোলা উত্তম। লাঙল কিংবা কোদালে আলু কেটে না যায়, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। তোলা শেষে বস্তাভরে দ্রুত বাড়ি নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো কারণে জমিতে রাখতেই যদি হয়, তাহলে ছায়াযুক্ত স্থানে বিছিয়ে শুকনো খড়-কুটা কিংবা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।

বস্তায় ঢোকানোর সময় আলু যেন আঘাত না পায়, সেজন্য বাঁশের বা অ্যালুমিনিয়াম বা লোহার বদলে প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা উত্তম। বাড়িতে এনে স্বাভাবিক বাতাস চলাচল করে, এমন শুকনো এবং ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা দরকার। রাখার সময় বেশি উঁচু থেকে ফেলা যাবে না।

সংরক্ষণের আগে আলু ছাল শক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য ঘরের খোলামেলা ঠান্ডা জায়গা নির্বাচন করতে হবে। মেঝেতে চট বিছিয়ে ১ ফুট পরিমাণ উঁচু করে আলু স্তূপ করে রাখতে হয়। এর ওপরে পাতলা কাপড় দিয়ে ৫-৭ দিন ঢেকে রাখতে হবে।তাহলেই ছাল শক্ত হয়ে যাবে। নাড়াচাড়ায় ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না। পাশাপাশি গায়ে ক্ষত থাকলে তা সেরে যাবে। পোকার আক্রমণ হতেও পাবে রক্ষা। 

সংরক্ষণের আগে খুব ছোট, আঘাতপ্রাপ্ত, কাটা, ফাটা, ক্ষত, সবুজ রংয়ের এবং রোগ বা পোকায় আক্রান্ত আলুগুলো বাদ দিয়ে ছোট, মাঝারি এবং বড় আকারের আলু আলাদাভাবে বাছাই করতে হয়। ছোট বড় সব আলু মিশিয়ে রাখা টিক নয়। আর খেয়াল রাখতে হবে আলু যেন ভেজা না থাকে। অবশ্যই ছায়াতে শুকিয়ে নিতে হবে। একটুও ভেজা থাকা চলবে না।

সংরক্ষণের ঘর তৈরি

আলুর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং বায়ু চলাচল করতে পারে এমন ঘর তৈরি করতে হবে। খড়-কুটা, ছন, গোলপাতা এসবের ছাউনি এবং বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে বানাতে হবে। মাটি থেকে একটু উঁচুতে মাঁচা তৈরি করতে হবে। মাচায় স্তূপ করে আলু সংরক্ষণ করতে হবে।প্রতি স্তূপের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১ মিটার এবং প্রশস্ত (অর্থাৎ দৈর্ঘ্য-প্রস্থ) হবে ২ মিটার। 

তাক বানিয়েও আলু রাখা যায়। বাঁশ বা বেতের ঝুড়ি, ডোল এসবেও রাখা যাবে। নিজেদের থাকার ঘরে মাচায় বা তাক বানিয়ে, এমনকি চৌকির নিচে শুকনো বালুর ওপর আলু রাখা যাবে।

পোকা থেকে রক্ষা পেতে

পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালির শুকনো পাতা গুঁড়া করে স্তূপে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। কোনো কীটনাশক প্রয়োগ করবেন না। প্রতি ১৫ দিন পরপর আলুর অবস্থা দেখে নিতে হবে। দুর্গন্ধ বের হলে বুঝতে হবে আলুর পচন ধরেছে। পচা আলু সরিয়ে ফেলতে হবে। এর আশপাশের ভেজা আলু থাকলে হালকা রোদে শুকিয়ে আবার গুদামে রাখতে হবে। ইঁদুর কিংবা অন্য কোনো ক্ষতিকর প্রাণী দেখা গেলে দমন করতে হবে।

এছাড়া রোগ কিংবা পোকায় আক্রান্ত আলু দেখামাত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। বেশি দিন রাখতে চাইলে মাঝে মাঝে আলু ওপরে-নিচে উল্টেপাল্টে দিতে হয়।

এ পদ্ধতিতে ৪ মাস পর্যন্ত আলু রাখা সম্ভব।

পেঁয়াজ সংরক্ষণ পদ্ধতি

আলু মতো পেঁয়াজও সংরক্ষণ করে পরবর্তী বেশি দামে বিক্রি করা যায়। বরং আলুর চেয়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণ আরও সহজ। পেঁয়াজ সংগ্রহ থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত ধাপগুলো নিচে বর্ণনা করা হয়েছে:

মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ

মাঠের ৬০-৭০ শতাংশ পেঁয়াজের গাছ ভেঙে পড়লে বুঝবেন এবার পেঁয়াজ তোলার সময় হয়েছে। সংরক্ষণের জন্য কখনোই আগাম অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলবেন না। এই পেঁয়াজে বেশি পানি থাকার কারণে ব্যাক্টেরিয়া/ছত্রাকজনিত রোগ দেখে দেয়। এছাড়া রেখে দিলে কয়েক দিনের মধ্যে পাতা গজায় (বাল্ব থেকে অংকুরোদগম)। 

আবার বেশি দেরিতে পেঁয়াজ সংগ্রহ করলেও সমস্যা আছে। তখন বাল্বের খোসা পড়ে গিয়ে সংরক্ষণাগারে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। এতে পেঁয়াজের রং নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তুলতে দেরি করলে আগাম বৃষ্টিতে পেঁয়াজ ভিজে যেতে পারে। ভেজা পেঁয়াজ স্টোরে রাখলে অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়।

জমি থেকে তোলা পেঁয়াজ শুকানো

আমাদের দেশের কৃষকেরা সাধারণ কোনো ফসল সংরক্ষণের আগে কিউরিং বোঝেন না। কিউরিং হলো ধীর গতিতে ফসল শুকানোর পদ্ধতি।

জমি থেকে তুলে আনা টাটকা পেঁয়াজ অনেক রসালো এবং এতে চিনির পরিমাণ বেশি থাকে। গায়ে থাকে পাতলা আবরণ। কিন্তু যখন কিউরিং করা হয়, তখন চামড়া শুকে কাগজের মতো শক্ত হয়। চিনির স্থলে থাকে তীব্র স্বাদ ও গন্ধযুক্ত কেমিকেল। আর পেঁয়াজের গলা শুকে এঁটে আসে ফলে আর্দ্রতা আর বের হতে পারে না, জীবাণুও আক্রমণ করতে পারে না।

বাণিজ্যিকভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য সাধারণ ছয় মাস ধরে মৃদু গরম পরিবেশের মধ্যে কিউরিং করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ঠান্ডা করে রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রার পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়।  

তবে গবেষণায় দেখা গেছে, মৃদু গরম ও শুষ্ক স্থানে একমাস রেখে কিউরিং করলেও পেঁয়াজ অনেক দিন ভালো থাকে।

কিউরিং

কড়া রোদের দিনে জমি থেকে পেঁয়াজ তোলার পর পাতাসহ ৫-৭ দিন হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে শুকাতে হবে। আগাম বৃষ্টিতে পেঁয়াজ ভিজে গেলে দ্রুত শুকানোর ব্যবস্থা করতে হয়। প্রয়োজনে ফ্যানের বাতাসে শুকাতে হবে। 

পেঁয়াজ সরাসরি রোদে শুকালে ব্যাপক ক্ষতি হয়। শুকানোর পর পেঁয়াজের ৪-৫% ওজন কমে যায়। এতে পেঁয়াজ শক্ত ও আঁটোসাঁটো হয় এবং পেঁয়াজের গলা সংকুচিত হয়ে ছত্রাক এবং ব্যাক্টেরিয়া প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিউরিং এর ফলে শ্বসনের হারও কমে যায়। 

যথেষ্ট কিউরিং না হলে পেঁয়াজে রোগ আক্রমণ করবে। কিউরিং করার কারণে পাতা শুকিয়ে গাছের বৃদ্ধিকে বাধাদানকারী হরমোন পেঁয়াজে (কন্দ) প্রবেশ করে, এতে পেঁয়াজের সুপ্ততার মেয়াদ বেড়ে যায়। অর্থাৎ পেঁয়াজ আর দ্রুত গজায় না।

পেঁয়াজের সংরক্ষণক্ষমতা বৃদ্ধি ও গুণগতমান বজায় রাখার জন্যই পেঁয়াজ পাতাসহ শুকাতে হবে। হালকা ছায়ায় শুকানোর কারণে পেঁয়াজের রং উজ্জ্বল হয়। পেঁয়াজ শুকানোর পর বাল্বের ওপরের গলা ২.০-২.৫ সে. মি (সর্বোচ্চ ১ ইঞ্চি) রেখে পাতা কেটে দিতে হবে। পরে বাল্বের মূল কেটে পরিষ্কার করে পেঁয়াজ স্টোরে সংরক্ষণ করতে হবে। 

রোগ আক্রান্ত, থেঁতলানো, গলা মোটা, বোল্টার (ফুলকা বের হওয়া), পচা, ক্ষত ইত্যাদি আছে এমন এবং জোড়া লাগানো পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য নেওয়া যাবে না। খুবই ছোট/বড় বাল্ব সংরক্ষণের জন্য এক সঙ্গে না রাখাই ভালো।

মনে রাখতে হবে, নাড়াচাড়া বা পরিবহনের সময় পেঁয়াজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি দ্রুত গজিয়ে যাবে। পচে নষ্টও হয়ে যেতে পারে। পেঁয়াজ পরিবহনে চটের বস্তা, নাইলনের বস্তা ও প্লাস্টিক ক্রেট (Crate, বেশিরভাগ মানুষ বলেন ক্যারেট!) ব্যবহার করা ভালো।ছিদ্রযুক্ত ব্যাগ ব্যবহার করলে বাতাস চলাচলের মাধ্যমে পেঁয়াজ ভালো থাকে।

স্টোরেজে গজানো বন্ধ করতে হরমোন/রেডিয়েশনের ব্যবহার

স্টোরে পেঁয়াজের অংকুরোদগম বন্ধ করার জন্য ফসল সংগ্রহের ১৫-২০ দিন আগে বিভিন্ন প্রকার হরমোন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে ম্যালেইক হাইড্রাজাইডই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।

এ ধরনের বৃদ্ধি প্রতিরোধী হরমোন ব্যবহারের মাধ্যমে সংরক্ষণকৃত পেঁয়াজের কোষ বিভাজন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অংকুরোদগম ক্ষমতা হ্রাস পায়। মাঠের শতকরা ১০ ভাগ পেঁয়াজ গাছ ভেঙে পড়লে প্রতি লিটার পানিতে ২৫০০-৩০০০ মি. গ্রাম ম্যালেইক হাইড্রাজাইডের দ্রবণ তৈরি করে স্প্রে করতে হবে।

তবে হরমোনকে পানিতে মেশানোর আগে অ্যালকোহলে দ্রবীভূত করে নিতে হয়। হরমোনের দ্রবণে আঠা জাতীয় পদার্থ (যেমন, স্টার্চ বা ভাতের মাড়) মিশিয়ে স্প্রে করা ভালো। 

অনেক সময় গামা রেডিয়েশনের মাধ্যমে অংকুরোদগম বিলম্বিত করে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি করা হয়।

সংরক্ষণ ব্যবস্থা

বিশ্বে সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয়। ১. কোল্ডস্টোরেজ (তাপমাত্রা ০-২/৪  ডিগ্রি সেলসিয়াস ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৫-৭০%); ২. অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ/হিট স্টোরেজ (সাধারণ তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৫-৭০%) এবং ৩. কন্ট্রোল্ড অ্যাটমোসফিয়ার স্টোরেজ (অক্সিজেন ১-২%, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ৩% ও তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস)।

বাংলাদেশের মতো গরম অঞ্চলের দেশে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করাই সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি। এটিকে বলে অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ (Ambient storage) বা হিট স্টোরেজ (Heat storage)।

অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজে ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা পেঁয়াজে অংকুরোদগম/মূল উৎপাদনকারী হরমোন (সাইটোকাইনিন) উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। 

প্রচলিত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ

আমাদের দেশে অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ হয় সাধারণত বাঁশের তৈরি ঘর। বাঁশ দিয়ে এক বা দুই স্তর বিশিষ্ট মাচা তৈরি করা হয়। পেঁয়াজের মাচা বাঁশের বানা/বাতা দিয়ে তৈরি করা হয়। স্টোর ঘরের চাল বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। খড়, অ্যাসবেসটস বা টিনের চালা হতে পারে। তবে টিনের চালা গরম হয় বেশি, তাই এড়ানোই ভালো। 

তাছাড়া পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থার জন্য পেঁয়াজের মাচার চারিদিক থেকে ভেন্টিলেটরের বা ছোট জানালার ব্যবস্থা করতে হয়।

বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা না থাকলে অরিরিক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে গুদামজাত রোগ ব্ল্যাক মোল্ড/গ্রেমোল্ড এবং নরম পচা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে। 

টিন দিয়ে ঘর বানালে পেঁয়াজের স্তূপের পুরুত্ব ৩০ সেমি. (১২ ইঞ্চি) এবং খড় বা অ্যাসবেসটস দিয়ে নির্মিত সংরক্ষণাগারে পেঁয়াজের স্তূপের পুরুত্ব ৩৭ সেমি. (১৫ ইঞ্চি) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো। দৈনন্দিন রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য প্লাস্টিক বা বাঁশের তৈরি র্যাকে ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) পুরুত্বে সংরক্ষণ কর যায়।     

স্টোরেজ থেকে ১৫-২০ দিন পরপর পচা, গজানো এবং রোগাক্রান্ত পেঁয়াজ আলাদা করতে হবে। মাঝেমধ্যে বাছাই না করলে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

পেঁয়াজ যতোদিন সংরক্ষণ করা হবে ততো ওজন কমতে থাকবে। আবহাওয়াজনিত কারণে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বছর থেকে বছর পার্থক্য হতে পারে। 

কৃষকপর্যায়ে ৪০০-৫০০ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিস্তর বিশিষ্ট একটি অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ তৈরি করতে প্রায় ৩-৩.৫ লাখ টাকা লাগতে পারে। এ ধরনের স্টোর প্রায় ২০-৩০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।

এয়ার ফ্লো মেশিন

এ পদ্ধতিতে একটি সেমিপাকা ঘরের মেঝেতে মাত্র ১০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১০ ফুট প্রস্থের একটি বাঁশের মাচা ও ইটের দেওয়াল তৈরি করে তার মাঝে ২০-২২ হাজার টাকা মূল্যের একটি এয়ার-ফ্লো মেশিন বসিয়ে প্রায় ৩০০ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়।

এয়ার ফ্লো মেশিন ব্যবহার করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে পচন ধরবে না। এ ছাড়া পেঁয়াজের ওজন ১০ থেকে ১২ শতাংশের বেশি কমবে না। ফলে প্রচলিত পদ্ধতিতে পেঁয়াজের ঘাটতির প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ কমানো যাবে।

মেশিনটি আর কিছুই নয়, এটি আসলে একটি ফ্যান লাগানো সিলিন্ডার বা ড্রাম। এটি পেঁয়াজের স্তূপের মাঝখানে রাখা হয়।

এয়ার-ফ্লো মেশিনটি বাইরের বাতাস টেনে পেঁয়াজের স্তূপের নিচে নিয়ে যাবে। পরে সেই বাতাস পেয়াজের স্তূপ ভেদ করে ওপরে উঠে আসবে। ফলে পেঁয়াজের নিচের এবং ভেতরের গরম সম্পূর্ণ কমে যাবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা মেশিনটি চালু রাখতে হয়। এতে পেঁয়াজের স্তূপের ভেতর থেকে তাপমাত্রা বেরিয়ে যাবে এবং পেয়াজের পচন রোধ হবে।

ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয়। মাত্র ১ হর্স পাওয়ারের মোটর লাগিয়ে ফ্যান বানিয়ে এই মেশিন তৈরি করা যায়। এ ধরনের এয়ার-ফ্লো মেশিন তৈরি করতে ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ পড়ার কথা নয়। আর একটি মেশিন ১০ বছর পর্যন্ত চালানো যাবে।

Post a Comment

0 Comments