খনা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারী। তিনি নিজের ও কৃষকদের বহুদিনের অভিজ্ঞতাগুলো ছড়া কেটে বা শ্লোকের মতো করে বর্ণনা করতেন। তাঁর শ্লোক ও ভবিষ্যদ্বাণীগুলোই খনার বচন নামে বহুল পরিচিত। এসব পড়লেই বোঝা যায়, এই অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের হাজার বছরের অভিজ্ঞতাই এসব বচনে উল্লেখ করা আছে।
আনুমানিক ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খনা ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কিংবদন্তি আছে, তিনি বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গের অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতের দেউলিয়া গ্রামে। একদিন শ্বশুর বরাহ এবং স্বামী মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পড়লে, খনা এ সমস্যার সমাধান দিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
গণনা করে খনার দেওয়া পূর্বাভাসে রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতো বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন। খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। অসংখ্য খনার বচন যুগ যুগ ধরে গ্রাম-বাংলার জনজীবনের সঙ্গে মিশে আছে।
খনার বচনগুলো ৪ ভাগে বিভক্ত:
১) কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার
২) কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান
৩) আবহাওয়া জ্ঞান
৪) শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ
সর্বাধিক জনপ্রিয় খনার ৯৬টি বচন নিচে দেওয়া হলো:
১.
চিনিস বা না চিনিস
খুঁজে দেখে গরু কিনিস।
২.
যদি বর্ষে পৌষে,
কড়ি হয় তুষে।
৩.
গরু ছাগলের মুখে বিষ।
চারা না খায় রাখিস দিশ।
৪.
বেল খেয়ে খায় পানি,
জির বলে মইলাম আমি।
৫.
পুত্র ভাগ্যে যশ
কন্যা ভাগ্যে লক্ষ্মী।
৬.
চৈত্রে দিয়া মাটি
বৈশাখে কর পরিপাটি।
৭.
জ্যৈষ্ঠে খরা, আষাঢ়ে ভরা
শস্যের ভার সহে না ধরা।
৮.
ভাদ্রের চারি, আশ্বিনের চারি
কলাই করি যত পারি।
৯.
আউশ ধানের চাষ
লাগে তিন মাস।
১০.
সকাল শোয় সকাল ওঠে
তার কড়ি না বৈদ্য লুটে।
১১.
যে চাষা খায় পেট ভরে
গরুর পানে চায় না ফিরে
গরু না পায় ঘাস পানি
ফলন নাই তার হয়রানি।
১২.
দিনের মেঘে ধান,
রাতের মেঘে পান।
১৩.
বার বছরে ফলে তাল,
যদি না লাগে গরু নাল।
১৪.
সকল গাছ কাটিকুটি
কাঁঠাল গাছে দেই মাটি।
১৫.
একে তে নাচুনী বুড়ি,
তার উপর ঢোলের বারি।
১৬.
দশে মিলে করি কাজ
হারি জিতি নাহি লাজ।
১৭.
যা করিবে বান্দা তা-ই পাইবে।
সুই চুরি করিলে কুড়াল হারাইবে।
১৮.
যাও পাখি বলো তারে
সে যেন ভুলেনা মোরে।
১৯.
ফুল তুলিয়া রুমাল দিলাম যতন করি রাখিও।
আমার কথা মনে ফইল্লে রুমাল খুলি দেখিও।
২০.
মেয়ে নষ্ট ঘাটে,
ছেলে নষ্ট হাটে।
২১.
খালি পেটে পানি খায়
যার যার বুঝে খায়।
২২.
তেলা মাথায় ঢালো তেল,
শুকনো মাথায় ভাঙ্গ বেল।
২৩.
সাত পুরুষে কুমাড়ের ঝি,
সরা দেইখা কয়, এইটা কি?
২৪.
আষাঢ় মাসে বান্ধে আইল
তবে খায় বহু শাইল।
২৫.
নিজের বেলায় আটিঁগাটি,
পরের বেলায় চিমটি কাটি।
২৬.
না পাইয়া পাইছে ধন;
বাপে পুতে কীর্তন।
২৭.
যে না শোনে খনার বচন
সংসারে তার চির পচন।
২৮.
বাঁশ মরে ফুলত,
মানুষ মরে ভুলত।
২৯.
সুপারীতে গোবর, বাশে মাটি
অফলা নারিকেল শিকর কাটি।
৩০.
তাল বাড়ে ঝোঁপে
খেজুর বাড়ে কোপে।
৩১.
চাষী আর চষা মাটি
এ দু’য়ে হয় দেশ খাঁটি।
৩২.
গাই পালে মেয়ে
দুধ পড়ে বেয়ে।
৩৩.
সোমে ও বুধে না দিও হাত
ধার করিয়া খাইও ভাত।
৩৪.
পুকুরে তে পানি নাই, পাতা কেনো ভাসে
যার কথা মনে করি সেই কেনো হাসে?
৩৫.
গাঙ দেখলে মুত আসে
নাঙ দেখলে হাস আসে (নাঙ মানে – স্বামী)
৩৬.
ছায়া ভালো ছাতার তল,
বল ভালো নিজের বল।
৩৭.
খনা বলে শুনে যাও
নারিকেল মুলে চিটা দাও
গাছ হয় তাজা মোটা
তাড়াতাড়ি ধরে গোটা।
৩৮.
ভাত দেবার মুরোদ নাই,
কিল দেবার গোসাঁই।
৩৯.
পারেনা ল ফালাইতে
উইঠা থাকে বিয়ান রাইতে।
৪০.
আখ আদা রুই
এই তিন চৈতে রুই।
৪১.
পটল বুনলে ফাগুনে
ফলন বাড়ে দ্বিগুণে।
৪২.
খনা বলে চাষার পো
শরতের শেষে সরিষা রো।
৪৩.
সূর্যের চেয়ে বালি গরম!!
নদীর চেয়ে প্যাক ঠান্ডা!!
৪৪.
যদি থাকে বন্ধুরে মন
গাং সাঁতরাইতে কতক্ষণ।
৪৫.
ঘরের কোনে মরিচ গাছ লাল মরিচ ধরে,
তোমার কথা মনে হলে চোখের পানি পড়ে!
৪৬.
খনা ডেকে বলে যান
রোদে ধান ছায়ায় পান।
৪৭.
হাত বিশ করি ফাঁক
আম কাঁঠাল পুঁতে রাখ।
৪৮.
সমানে সমানে দোস্তি
সমানে সমানে কুস্তি।
৪৯.
হোলা গোশশা অইলে বাশশা,
মাইয়া গোশশা অইলে বেইশশা।
৫০.
কী করো শ্বশুর মিছে খেটে
ফাল্গুনে এঁটে পোত কেটে
বেড়ে যাবে ঝাড়কি ঝাড়
কলা বইতে ভাংগে ঘাড়।
৫১.
উঠান ভরা লাউ শসা
ঘরে তার লক্ষীর দশা।
৫২.
যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্যি রাজা পুণ্যি দেশ।
৫৩.
হইবো পুতে ডাকবো বাপ
তয় পুরবো মনর থাপ।
৫৪.
সবল গরু, গভীর চাষ
তাতে পুরে চাষার আশ।
৫৫.
ডাঙ্গা নিড়ান বান্ধন আলি
তাতে দিও নানা শালি।
৫৬.
ডাকে পাখী, না ছাড়ে বাসা,
খনা বলে, সেই তো ঊষা।
৫৭.
অঙ্কস্য বামা গতি।
৫৮.
কাঁচা রোপা শুকায়
ভুঁইয়ে ধান ভুঁইয়ে লুটায়।
৫৯.
কিল আর তেল পড়লেই গেল।
৬০.
যদি বর্ষে গাল্গুনে
চিনা কাউন দ্বিগুনে।
৬১.
শাল সত্তর, আসন আশি
জাম বলে পাছেই আছি।
তাল বলে যদি পাই কাত
বার বছরে ফলে একরাত।
৬২.
দিনে রোদ রাতে জল
দিন দিন বাড়ে ধানের বল।
৬৩.
মাঘ মাসে বর্ষে দেবা
রাজ্য ছেড়ে প্রজার সেবা।
৬৪.
ঘন সরিষা বিরল তিল।
ডেঙ্গে ডেঙ্গে কাপাস।।
এমন করে বুনবি শন।
না লাগে বাতাস।।
৬৫.
সেচ দিয়ে করে চাষ,
তার সবজি বার মাস।
৬৬.
ক্ষেত আর পুত।
যত্ন বিনে যমদূত।।
৬৭.
ফল খেয়ে জল খায়
জম বলে আয় আয়।
৬৮.
কাল ধানের ধলা পিঠা,
মা’র চেয়ে মাসি মিঠা।
৬৯.
বেঙ ডাকে ঘন ঘন
শীঘ্র হবে বৃষ্টি জান।
৭০.
যদি বর্ষে মাঘের শেষ,
ধন্যি রাজার পুণ্য দেশ।।
যদি বর্ষে ফাগুনে,
রাজা যায় মাগুনে।।
৭১.
যুগরে খাইছে ভূতে
বাপরে মারে পুতে।
৭২.
শোনরে বাপু চাষার পো
সুপারী বাগে মান্দার রো৷
মান্দার পাতা পচলে গোড়ায়
ফড়ফড়াইয়া ফল বাড়ায়।
৭৩.
গাছে গাছে আগুন জ্বলে
বৃষ্টি হবে খনায় বলে।
৭৪.
যদি হয় চৈতে বৃষ্টি
তবে হবে ধানের সৃষ্টি।
৭৫.
নিত্যি নিত্যি ফল খাও,
বদ্যি বাড়ি নাহি যাও।
৭৬.
শুধু পেটে কুল,
ভর পেটে মূল।
৭৭.
সাত হাতে, তিন বিঘাতে
কলা লাগাবে মায়ে পুতে।
কলা লাগিয়ে না কাটবে পাত,
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।
৭৮.
যদি ঝরে কাত্তি।
সোনা রাত্তি রাত্তি।।
৭৯.
মিললে মেলা।
না মিললে একলা একলা ভালা!
৮০.
শোন শোন চাষি ভাই
সার না দিলে ফসল নাই।
৮১.
চালায় চালায় কুমুড় পাতা
লক্ষ্মী বলেন আছি তথা।
৮২.
বারো মাসে বারো ফল
না খেলে যায় রসাতল।
৮৩.
সকাল শোয় সকাল ওঠে
তার কড়ি না বৈদ্য লুটে।
৮৪.
গাছগাছালি ঘন রোবে না
গাছ হবে তার ফল হবে না।
৮৫.
তিন নাড়ায় সুপারী সোনা,
তিন নাড়ায় নারকেল টেনা,
তিন নাড়ায় শ্রীফল বেল,
তিন নাড়ায় গেরস্থ গল।
৮৬.
সোল বোয়ালের পোনা,
যার যারটা তার তার কাছে সোনা।
৮৭.
আলো হাওয়া বেঁধো না
রোগে ভোগে মরো না।
৮৮.
যদি হয় সুজন এক পিড়িতে নয় জন।
যদি হয় কুজন নয় পিড়িতে নয় জন।
৮৯.
পাঁচ রবি মাসে পায়।
ঝরায় কিংবা খরায় পায়।
৯০.
ক্ষেত আর পুত,
যত্ন বিনে যমদূত।
৯১.
আমি অটনাচার্যের বেটি
গনতে গাঁথতে কারে বা আঁটি।
৯২.
যত জ্বালে ব্যঞ্জন মিষ্ট
তত জ্বালে ভাত নষ্ট।
৯৩.
বাদল বামুন বান,
দক্ষিণা পেলেই যান।
৯৪.
পৌষের কুয়া বৈশাখের ফল।
য’দ্দিন কুয়া ত’দ্দিন জল।
শনিতে সাত মঙ্গলে/(বুধ) তিন।
আর সব দিন দিন।
৯৫.
পাঁচ রবি মাসে পায়,
ঝরা কিংবা খরায় যায়।
৯৬.
গাঁ গড়ানে ঘন পা।
যেমন মা তেমন ছা।
থেকে বলদ না বয় হাল,
তার দুঃখ সর্বকাল।।
0 Comments