বাংলাদেশে ফসলের ক্ষেতে তিন ধরনের মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা যায়। যেমন: হলুদ মাজরা, কালো মাথা মাজরা এবং গোলাপী মাজরা ।
এরা আসলে এক ধরনের মথ। ফলে প্রজাপতি বা রেশম পোকার মতো এদের লার্ভাগুলোই মূলত ফসলের ক্ষতি করে। কারণ লার্ভাগুলোর মথে পরিণত হওয়ার আগে প্রচুর পরিমাণে সবুজ কচি পাতা খায়। এ কারণে মাজরা পোকার আক্রমণ হলে ধাপের ডগার ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণেই ফলন ব্যাপক ভাবে কমে যায়।
মাজরা পোকার কীড়াগুলো (লার্ভা) ধান গাছের কান্ডের ভেতর থেকে খাওয়া শুরু করে। ধীরে ধীরে গাছের ডিগ (ডগা বা নতুন পাতা) পাতার গোড়া খেয়ে কেটে ফেলে। ফলে ডিগ পাতা মারা যায়। একে ‘মরা ডিগ’ বা ‘ডেড হার্ট ’ বলে।
গাছে শীষ আসার আগে পর্যন্ত এ ধরনের ক্ষতি হলে মরা ডিগ দেখতে পাওয়া যায়। থোড় আসার আগে মরা ডিগ দেখা দিলে ধানের গোছায় বাড়তি কিছু কুশি তৈরি হয়। এতে অবশ্য ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে যায়।
মাজরা পোকার আক্রমণের লক্ষণ
ক্রিসেক রোগের অথবা ইঁদুরের ক্ষতির নমুনার সাথে কখনো কখনো মাজরা পোকার আক্রমণে সৃষ্ট ক্ষত মরা ডিগ গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। মাজরা পোকার আক্রমণে মরা ডিগ টান দিলে সহজে উঠে আসে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত গাছের কান্ডে মাজরা পোকা খাওয়ার কারণে ছিদ্র এবং খাওয়ার জায়গায় পোকার মল দেখতে পাওয়া যায়।
শীষ আসার পর মাজরা পোকা ক্ষতি করলে সম্পূর্ণ শীষ শুকিয়ে যায়। একে ‘সাদা শীষ’, ‘মরা শীষ’ বা ‘হোয়াইট হেড’ বলে।
খরা বা ইঁদুরের ক্ষতির লক্ষণও কিন্তু হোয়াইট হেড। ফলে রোগ শনাক্তের সময় এ দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
কীড়া যদি পাতার খোলের ভেতরে খায় এবং কান্ডের ভেতরের অংশ সম্পূর্ণভাবে কেটে না দেয় তাহলে ধানগাছের আংশিক ক্ষতি হয় এবং শীষের গোড়ার দিকের কিছু ধান চিটা হয়ে যায়।
মাজরা পোকার আক্রমণ হলে, কান্ডের মধ্যে কীড়া, তার খাওয়ার চিহ্ন ও মল পাওয়া যায়। অথবা কান্ডের বাইরের রং বিবর্ণ হয়ে যায় এবং কীড়া বের হয়ে যাওয়ার ছিদ্র থাকে।
গাছে মাজরা পোকার ডিমের গাদা দেখলে বুঝতে হবে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পুরো ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
খেয়াল রাখতে হবে
হলুদ মাজরা পোকা পাতার ওপরের অংশে ডিম পাড়ে এবং গোলাপী মাজরা পোকা পাতার খোলের ভিতরের দিকে ডিম পাড়ে।
হলুদ মাজরা পোকার ডিমের গাদার ওপর হালকা ধূসর রঙের একটা আবরণ থাকে। কালোমাথা মাজরা পোকার ডিমের গাদার ওপর মাছের আঁশের মতো একটা সাদা আবরণ থাকে, যা ডিম ফোটার আগে ধীরে ধীরে গাঢ় রং ধারণ করে।
যেভাবে ক্ষতি করে মাজরা পোকা
মাজরা পোকার কীড়াগুলো ডিম থেকে ফুটে রেরুবার পর আস্তে আস্তে কান্ডের ভেতরে প্রবেশ করে। কীড়ার প্রথমাবস্থায় এক একটি ধানের গুছির মধ্যে অনেকগুলো করে গোলাপী ও কালোমাথা মাজরার কীড়া জড়ো হতে দেখা যায়। কিন্তু হলুদ মাজরা পোকার কীড়া ও পুত্তলীগুলো কান্ডের মধ্যে যে কোন জায়গায় পাওয়া যেতে পারে।
ক্ষেতে বসানো আলোর চার পাশে যদি প্রচুর মাজরা পোকার মথ দেখতে পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে ক্ষেতের মধ্যে মথগুলো ডিম পাড়া শুরু করেছে।
মাজরা পোকার জীবনচক্র |
নিয়মিতভাবে ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মাজরা পোকার মথ ও ডিম সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেললে মাজরা পোকার সংখ্যা ও ক্ষতি অনেক কমে যায়। থোর আসার পূর্ব পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মথ ধরে ধ্বংস করা যায়।
ক্ষেতের মধ্যে ডালপালা পুঁতে দিলে (পার্চিং) পাখির বসার সুযোগ পায়। পাখিরা মাজরা পোকার মথ ও লার্ভা বা কীড়া খেয়ে পোকার সংখ্যা কমিয়ে দেয়।
মাজরা পোকার পূর্ণ বয়স্ক মথের প্রাদুর্ভাব খুব বেড়ে গেলে ধান ক্ষেত থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরে আলোক ফাঁদ বসিয়ে মাজরা পোকার মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা যায়।
যেসব অঞ্চলে হলুদ মাজরা পোকার আক্রমণ বেশি, সেসব এলাকায় সম্ভব হলে চান্দিনার (বি আর ১) মতো হলুদ মাজরা পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাতের ধান চাষ করে আক্রমণ প্রতিহত করা যায়।
ধানের জমিতে শতকরা ১০-১৫ ভাগ মরা ডিগ অথবা শতকরা ৫ ভাগ মরা শীষ পাওয়া গেলে বুঝতে হবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তখন আর জৈব বালাইনাশক পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসল রক্ষা করা যাবে না। তখন অনুমোদিত কীটনাশক যেমন- ডায়াজিনন ৬০ ইসি, কার্বোফুরান ৫জি, ফেনিট্রথিয়ন ৫০ ইসি ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
0 Comments