দুগ্ধখামারের নবজাতক বাছুরের যত্ন একটু আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে নিতে হয়। কারণ এই বয়সী বাছুরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম থাকে। নবজাতক বাছুরের সাধারণত যে ক’টি রোগ বেশি হয় তার মধ্যে অন্যতম নাভিপচা। দ্রুত রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা না করলে বাছুর মারাও যেতে পারে।
সাধারণত নবজাতক বাছুরের নাভি এবং নাভির চারপাশের অংশের প্রদাহ ও সংক্রমণকেই নাভির রোগ (Navel ill) বলে। বাছুরের নাভি বা আমবিলিক্যাল কর্ড (নাড়ি) গঠিত হয় এমনিয়োটিক মেমব্রেন, আমবিলিক্যাল শিরা, আমবিলিক্যাল ধমনী ও ইউরেকাস দ্বারা। বাছুর গাভীর জরায়ুতে থাকা অবস্থায় এই নাড়ির মাধ্যমেই বাছুরের শরীরে পুষ্টি সরবরাহ হয়। জন্মের সময় নাভি বা আমবিলিক্যাল কর্ড ছিঁড়ে যায়। এ সময়ে আমবিলিক্যাল শিরা ও ইউরেকাস বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু বাকি অন্যান্য অংশগুলো উন্মুক্ত থাকার কারণে পারিপার্শ্বিকের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে নাভিতে নানা জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। এ সংক্রমণ মূত্রথলি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে মূত্রথলির প্রদাহ হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাছুরের গিরা/গিঁট ফোলা (Joint ill) রোগও দেখা দেয়।
সংক্রমণ সৃষ্টিকারী জীবাণু
Escherichia coli, Proteus Spp, Staphylococcus spp. এবং Corynebacterium pyogenes। এ ব্যাকটেরিয়াগুলো স্থানীয় সংক্রমণ যেমন বাছুরের পায়ের সন্ধি, মেনিনজেস, চক্ষু, এন্ডোকার্ডিয়াম, পা, কান ও লেজের ধমনীতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। নাভিপ্রদাহ (Omphalitis) সাধারণত নাভির বাহ্যিক অংশের প্রদাহ বা সংক্রমণকে বোঝায়। বাছুরের জন্মের ২-৫ দিনের মধ্যে এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগ সংক্রমণের কারণ
অনেকগুলো কারণে বাছুরের নাভিতে সংক্রমণ হতে পারে। এই কারণগুলোর মধ্যে বাছুরের যথেষ্ট কলস্ট্রাম (শাল দুধ) না পাওয়া এবং প্রতিকূল পরিবেশগত পরিস্থিতি যেমন, বাছুরের থাকার স্থানে অতিরিক্ত আর্দ্রতা বা ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ এবং গোবর ও প্রস্রাব নিয়মিত পরিষ্কার না করা। পরিচ্ছন্নতার অভাবেও এমনটি হতে পারে। জন্মের পর বাছুরের নাভি নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত না করা এবং খামারের অন্য বাছুর বা গরু যদি নাভি চোষে বা চেটে দেয় তাহলেও ইনফেকশন হতে পারে। এছাড়া,
১. জন্মের পর বাছুরের নাভি যদি সঠিকভাবে কাটা না হয়।
২. বাছুরকে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে রাখা হলে।
৩. বাছুরের নাভি কাটার ব্লেড বা ছুরি জীবাণুমুক্ত না হলে।
৪. গাভী অধিক পরিমাণে বাছুরের নাভি চাটলে।
এসব কারণেও নাভিতে সংক্রমণ হতে পারে।
রোগের লক্ষণ
জন্মের ৪-৬ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। শরীরের তাপমাত্রা খুব বেড়ে যায় (১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। নাভি ফুলে যায় এবং ভেজা ভেজা থাকে। অনেক সময় নাভিতে ব্যথা এবং পুঁজ জমে থাকে। চাপ দিলে রক্তমিশ্রিত তরল বের হয়। নাভিতে ব্যথা থাকায় বাছুর মায়ের দুধ টেনে খেতে চায় না। বাছুর বারবার আক্রান্ত নাভি চাটে। বাছুর ঘন ঘন প্রস্রাব করে। দীর্ঘমেয়াদি টক্সিমিয়ার কারণে বাছুর খায় না এবং ঝিমায়। ক্ষুধামান্দ্য ও অবসাদগ্রস্তভাব লক্ষ্য করা যায়। এভাবে ক্রমান্বয়ে নিস্তেজ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। নাভিতে ক্ষত থাকার কারণে মাছি বসে ডিম দেয়ার ফলে নাভি থেকে পুঁজ বা রক্ত পড়তে শুরু করতে পারে।
রোগ নির্ণয়
বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ দেখে নাভিপাকা রোগ নির্ণয় করা যায়। আক্রান্ত নাভি থেকে সোয়াব (Swab) নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে রোগের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
নাভিতে সংক্রমণ হলে বা নাভি পচা রোগ হলে সব সময় কিন্তু বাছুরের শরীরে জ্বর অনুভূত হয় না। এমনকি বাহ্যিক কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ নাও দেখা যেতে পারে। নাভি ফুলে গেলেই ধরে নিতে হবে বাছুরের নাভিতে জীবাণুর আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। এসময় সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে। এতে মারাত্মক সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। তবে অনেক বাছুরের নাভি পচা বা নাভি ফোলার সমস্যায় একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের সংমিশ্রণে চিকিৎসা করতে হয়। কারণ এই সমস্যাটি সাধারণত একাধিক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ঘটে থাকে।
প্রাথমিক অবস্থায় নাভি রোগের জন্য টেট্রাসাইক্লিন ইনজেকশন যেমন: Renamycin, Tetracycline-এর যে কোনো একটি ইনজেকশন মাঝারি ওজনের বাছুরের জন্য ৩-৪ মিলি. করে মাংসে দিনে একবার করে ৫-৭ দিন দিতে হবে। এছাড়া পেনিসিলিন গ্রুপের ওষুধ যেমন: Pronapen, Strepto P ইত্যাদি যেকোনো একটি মাঝারি বাছুরকে ১ ভায়াল করে মাংসপেশীতে দিনে একবার করে ৫-৭ দিন দিলে নাভিরোগ ভালো হয়ে যায়।
নাভি পেকে গেলে
প্রয়োজনবোধে ব্লেড বা ছুরি (Scalpel) দিয়ে কেটে পুঁজ বের করে জীবাণুনাশক ওষুধ যেমন, পটাশের পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফাঁকা স্থান দিয়ে টিংচার আয়োডিন বা পভিডন আয়োডিনযুক্ত গজ ঢুকাতে হবে। এভাবে পরপর দুই দিন গজ ঢুকাতে হবে এবং পরে আক্রান্ত স্থানে সালফার গ্রুপের পাউডার (Sumid vet) দিতে হবে। আক্রান্ত নাভি টিংচার আয়োডিন দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন Pronapen/Streptopen-এর যে কোনোটি ১০ মিলি মাংসপেশীতে দিনে একবার করে ৪-৫ দিন দিতে হবে।
নাভিতে পোকা হলে:
আইভারমেকটিন গ্রুপের Drop: Ivertin 5ml (Chemist) দিনে ১ বার ২/৩ ফোটা দিলে সমস্ত পোকা মরে আপনা আপনি পড়ে যাবে।
অথবা, চিমটা দিয়ে পোকা বের করে অথবা নাপথলিন গুড়া করে ক্ষতস্থানে পর পর ২/৩ দিন গজ ঢুকাতে হবে।
বাছুরের নাভির ব্যবচ্ছেদ |
বাছুর জন্মের সময়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত মানের হতে হবে। জন্মের পর বাছুরের নাভি যাতে ৭ দিনের মধ্যেই শুকিয়ে যায় সেজন্য প্রতিদিন নাভি পরিষ্কার করে টিংচার অব আয়োডিন লাগাতে হবে। প্রসবের পর Umbilicus বাছুরের নাভি ১ ইঞ্চি পরিমাণ রেখে এবং সিল্ক সুতা দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। মা যেন নাভি চাটতে না পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নাভি যেন ছিঁড়ে না যায় এবং মাছি না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাছুরকে শুকনো পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে।
নাভির সংক্রমণ প্রতিরোধ বা শনাক্তের প্রধান ও প্রথম কাজ হলো নিয়মিত নবজাতক বাছুরের নাভি পরীক্ষা করা। একটি খামারে প্রয়োজনীয় হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে বাছুরকে নাভি পচা রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর মধ্যে অন্যতম হলো- জন্মের পর পরই জীবাণুনাশকে (যেমন: ৭০%-এর উপর মাত্রার আয়োডিন দ্রবণ) চুবিয়ে নেওয়া। এছাড়া নাভি পুরোপুরি শুকিয়ে না যাওয়া অবধি প্রতিদিন জীবাণুনাশকে চুবিয়ে নিতে হবে।
বাছুরের আরেক ধরনের নাভি ফোলা বা নাড়ি ফোলার সমস্যাকে পশুচিকিৎসা বিজ্ঞানে বলে ওমফালোফেলবাইটিস। এই সংক্রমণ সাধারণত এক থেকে তিন মাস বয়সী বাছুরের মধ্যে হয়। এই সমস্যা হলে বাছুরের গায়ে হালকা জ্বর, অলসতা এবং বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সংক্রমণটি নাভিতে উন্মুক্ত নাড়ি থেকে যকৃতে (লিভার) ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ এই নাড়ি লিভারের সঙ্গে যুক্ত।
এ ধরনের সংক্রমণ হলে ব্যাকটিরিয়া রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে ফুসফুস, হাড়, অন্থিসন্ধি বা মস্তিস্কের মতো শরীরের অন্য প্রত্যঙ্গে জমে গিয়ে পরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় করণীয়
মা গাভীকে নিয়মিত টিকা দিতে হবে। তাহলে মায়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে বাছুরও পাবে। ফলে ছোটখাট সংক্রমণ সহজেই প্রতিরোধ করতে পারবে। বাছুর যাতে পর্যাপ্ত শালদুধ পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। খামার শুকনো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। চারণভূমি (যদি গরু ছেড়ে দিয়ে পালন করা হয়) যতোটা সম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করতে হবে। গাভী যদি স্বাভাবিক প্রসব না করে, অর্থাৎ বাছুরের জন্ম হতে যদি ডাক্তারের সহায়তা লাগে তাহলে সেসব বাছুরের নাভি ফোলা রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাছুরের নাভি না শুকানো পর্যপ্ত ৭০% ইথানল এবং ক্লোরহেক্সিডাইন দ্রবণে দৈনিক চুবিয়ে দিতে হবে। এই দ্রবণে ৭০% থাকবে ইথানল এবং ক্লোরোহেক্সিডাইন আর বাকি অংশ বিশুদ্ধ পানি। আর ইথানল আর ক্লোরোহেক্সিডাইন থাকবে সমান সমান (৫০:৫০)।
0 Comments