সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ব্রিটিশ জুলুমের নীল এখন রংপুরে মূল্যবান অর্থকরী ফসল

রংপুরে অর্থকরী ফসল নীল চাষে ভাগ্য বদল

কাপড়ের রাসায়নিক রঙ উদ্ভাবনের পর সারা বিশ্বেই নীল চাষ প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও বর্তমানে পরিবেশ সচেতনরা নতুন করে অর্গানিক (জৈব) রঙের দিকে ঝুঁকছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সাল থেকে ভারতের নীল চাষ শুরু করেছিল। এই নীলের ওপরই নির্ভর ছিল ইউরোপের পোশাক শিল্প (টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি)। বাংলাদেশসহ পুরো বঙ্গভূমিতে এই নীল চাষের অনেক নিষ্ঠুর ও করুণ কাহিনী রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বিদ্যমান নীল কুঠিগুলো সেই ‍জুলুমের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে। প্রায় ১৫০ বছরের কষ্টের পরিক্রমা। ১৮৫৯ সালের নীল চাষিদের বিদ্রোহ সারা বিশ্বে নাড়া দিয়েছিল। ১৮৫৯-১৮৬০ সালের দিকে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়।

প্রায় দেড়শ বছর আগে এই নীলকর সাহেবরা ভারত ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের একমাত্র রংপুর জেলায় এখন নতুন করে শুরু হয়েছে নীল চাষ। শুধু তা-ই নয়, দিন দিন এই ফসল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রথমে অনুর্বর জমিকে উর্বর করতে ও জ্বালানি আর জৈবসার তৈরির জন্য নীল চাষ করা হতো। স্থানীয়ভাবে এটিকে বলা হতো ‘মাল’ গাছ। এটি লাগানো হতো বালুময় অনুর্বর পতিত জমি এবং রাস্তার ধারে। অনেকটা অড়হর গাছের মতো দেখতে। 

এ মাল গাছই যে নীল গাছ তা কিন্তু তারা জানতেনও না। ২০০৫ সালে প্রথম স্থানীয়রা জানতে পারেন, এ গাছ থেকেই প্রাকৃতিক নীল সংগ্রহ করা যায়। এরপর আধাবাণিজ্যিকভাবে নীল উৎপাদন শুরু হয় ২০০৭ সালে। রংপুর সদরের হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামের ডা. অনীল কুমার রায়ের ছেলে ডা. নিখিল চন্দ্র রায়ের হাত ধরেই আধুনিককালের নীল চাষ শুরু হয়। 

রংপুর জেলার সদর, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া ও নীলফামারী জেলা কিশোরগঞ্জ উপজেলা প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৩ হাজার কৃষক এখন নীল চাষ করছেন। যদিও ১০/১২ বছর আগেও প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হতো। মাঝে নীল উৎপাদনকারী কারখানা বন্ধ থাকায় এর আবাদ কমে যায়। বন্ধ কারখানা চালু হওয়ায় এখন নীল চাষে নতুন উদ্যোম দেখা যাচ্ছে। 

জানা যায়, শুধু ভারতেই প্রতি বছর ৩০০ টন নীলের দরকার হয়। সবচেয়ে ভালো মানের নীল আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হয় প্রায় ২৫ হাজার টাকায়। সবচেয়ে বড় ক্রেতা এল সালভাদর। অবশ্য রংপুরের নীল এখনো সেখানে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পারেনি। কারণ উৎপাদন এখনো সীমিত। তারপরও রংপুরে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার কেজির বেশি নীল উৎপাদিত হচ্ছে। বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।

২০০৮ সালে রংপুর সদরের রাজেন্দ্রপুরে ‘নিজেরা কটেজ অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ (এনসিভিআই)’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন স্থানীয় কয়েকজন। পাঁচ বছরে এনসিভিআইয়ের সদস্য ও পরিধি বেড়ে যায়। গড়ে ওঠে প্রাকৃতিক নীল ডায়িং কারখানা। তারা নীল গাছের পাতা সংগ্রহ ও তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করছেন নীল। সেই নীলে ডায়িং করা ব্যাগ, ফতুয়া, চাদর, নকশিকাঁথা ও বাহারি পণ্য তৈরি করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করছেন তারা।

আন্তর্জাতিক সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ ‘লিভিং ব্লু’ নামের একটি কর্মসূচির মাধ্যমে নীল চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। ওই কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় রংপুর জেলার রাজেন্দ্রপুর ও পাগলাপীর এলাকায় প্রায় দুই হাজার কৃষক তিন হাজার একর জমিতে নীল চাষ করছেন। 

নীলের ব্যবহার

নীল সাধারণত সব ধরনের সুতি, উলেন, সিল্ক টাইপের জামা কাপড়ের রঙ উজ্জ্বল করতে ব্যবহৃত হয়। একজোড়া জামাকাপড় নীল দিতে ৩ থেকে ৭ গ্রাম নীলের প্রয়োজন হয়। সারা বিশ্বে প্রতিবছর ২০ লাখ কেজি নীল উৎপাদিত হয়।

নীল তেল ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী। এটি গায়ে মাখা যায়। ডাইং ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে আবশ্যকীয় উপকরণ হিসেবে নীল ব্যবহৃত হচ্ছে। 

ইদানীং চুলে কলপ দেয়ার জন্যও ব্যবহার বাড়ছে নীলের। 

নীল ব্যবহারে চামড়া ভালো থাকে, শরীরের উজ্জ্বলতা বাড়ে। 

নীল তেলের খৈল লোশন হিসেবে, সেভিং ফোম তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়।

শরীরের ব্যথা উপশমে নীল ব্যবহৃত হয়। 

কেনিয়ার মানুষ দাঁতের সমস্যা উপশমের জন্য নীলের ডাল দিয়ে দাঁত মাজেন। কেউ কেউ পোকার আক্রমণ ও সাপের কামড়ে ব্যথায় বিষ কমানোর জন্য নীল ব্যবহার করেন। 

ওষুধ শিল্পে নীলের বহুমাত্রিক ব্যবহার রয়েছে।

নীল গাছে কোনো সার দিতে হয় না। পোকা রোগে আক্রমণ তেমন করে না। বলতে গেলে কোনো যতœআত্তি করতে হয় না। গরু ছাগল হাঁস-মুরগি খায় না নষ্ট করে না। নীলের পরাগ রেণু মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে শারীরিক গঠনে সহায়তা করে। নীল তামাকের শতভাগ বিকল্প চাষ হতে পারে লাভ, পরিবেশ আর সার্বিকতা চিন্তা করে। 

নীলগাছের পরিচিতি

নীলকে (Indigoferra sp.) প্রাকৃতিক নীলও বলা হয়। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে নীল সাধারণত মৌসুমি গাছ ৬ মাসের জীবনকাল বিশিষ্ট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বীজ বপন করলে অক্টোবর নভেম্বরে গাছ মারা যায়। বর্ষায় পাতা ঝরে যায়। ১ থেকে ২ মিটার লম্বা ঝোপালো গাছ হয়। পাতা ডিম্বাকৃতি ও সমান্তরালভাবে সন্নিবেশিত। ফুল গোলাপি থেকে বেগুনি রঙের হয়। 

মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়াতে নীল আচ্ছাদন ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। অনুর্বর জমিতে অনাদরেই বেড়ে ওঠে নীল। 

নীলের অন্তত ৭৫০টি প্রজাতি আছে বিশ্বময়। নীলগাছ উষ্ণ ও অবউষ্ণ অঞ্চলে বেশি জন্মে। তবে বেশি প্রচলিত জাত হলো Indigofera আর এরা Fabaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত উদ্ভিদ। বিভিন্ন রকমের ফুল হয়। তবে লাল রঙের একটু ছায়া থাকে লালচে। তবে কিছু কিছু জাতের ফুল সাদা ও হলুদ রঙের। ফল ও বীজ সরিষার মতো। তবে জাতভেদে বিভিন্ন আকারের হয়। নীল বানানোর জন্য দুটো জাত বেশি উপযোগী। এ দুটো জাত হলো Indigofera tinctoria এবং Indigofera suffruticosa| পৃথিবীর কোনো কোন দেশে নীল তাদের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিগণিত। নীল বা Indigo কে বলা হয় The color of Kings। 

বীজ বপন

ফেব্রুয়ারি-মার্চ বা ফাল্গুন মাস বীজ বপনের সময়। অর্থাৎ পাট বপনের সময়ই নীলের বীজ বোনার সময়। এক চাষ দিয়ে বীজ বপন করা হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিনা চাষেই বীজ বপন করা হয়। প্রতি একরে ৪-৫ কেজি আর হেক্টরে ১০-১৫ কেজির বীজ লাগে। নীলের বীজ অনেকটা সরিষার বীজের মতো। অনেকটা ধইঞ্চা বা পাটের বীজে মতো ছিটিয়ে বপন করা হয়। 

রংপুরে নীল সংগ্রহ প্রক্রিয়া

পাতা কাটা ও প্রক্রিয়জাতকরণ

বীজ বপনের ৯০ দিন পর গাছ যখন একটু বড় হয় তখন প্রথমবার পাতা কাটা হয়। ওপর থেকে ১ দেড় ফুট শাখাসহ পাতা কেটে আনা হয়। এভাবে একবার কাটার পর ৬ মাস আয়ুকাল মৌসুমে অন্তত ৪-৫ বার পাতা কাটা যায়। পাতা সংগ্রহের পরও গাছের অবশিষ্ট অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বীজের গাছ থেকে নিয়মিত পাতা সংগ্রহ করা হয় না। প্রথমবার পাতা কাটার পর বীজ গাছকে আলাদা করে যত্নআত্তি করে রাখা হয়।

নীল সংগ্রহ কোনো বিশেষায়িত পদ্ধতি নয়। জমি থেকে গাছের উপরের শাখাসহ নীল পাতা সংগ্রহ করে চৌবাচ্চাতে পরিমাণমতো পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় বা জাগ দেয়া হয়। পানি এ পরিমাণে হবে যেন পাতার উপর ১ ইঞ্চি পানি থাকে। এভাবে ২০ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা জাগে ডুবিয়ে রাখা হয়। এরপর প্রথম চৌবাচ্চা থেকে পাতা ডালপালা ছেঁকে শুধু নীল পানি দ্বিতীয় চৌবাচ্চাতে নেয়া হয়। পাতা ডালপালা জৈবসার কিংবা জ্বালানি হিসেবে শুকিয়ে নেয়া হয় বা জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

দ্বিতীয় চৌবাচ্চা থেকে ১ ঘণ্টা ঝাঁকানির পর প্রচুর ফেনা সৃষ্টি হয়। এরপর পরিমাণমতো কস্টিক সোডা মিশিয়ে আবার অনবরত নাড়াচাড়া বা ঝাঁকানো হয়। কতক্ষণ পর মাঝারি আকারের বালতি বা পাত্রে মোটা মার্কিন কাপড় বিছিয়ে ফেনাযুক্ত দ্রবণটি ছাঁকা হয়। ছেঁকে ফলা পানি এরপর একদিন রেখে দেয়া হয়। এতে মার্কিন কাপড়ে তলানি জমা হয় আর থিতানো পানি আলাদা হয়ে যায়। মার্কিন কাপড়ের এ তলানিই নীল। 

এই থিতানো পানিও কিন্তু উপকারী জৈবসার হিসেবে গাছের গোড়ায় দেয়া হয় অথবা বাথরুমের মেঝে পরিষ্কার করতে ব্যবহৃত হয়। এ পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে পা ফাটা বা পায়ের বিভিন্ন চর্মরোগ সংক্রান্ত সমস্যা দূর হয়। 

পানি ঝরে যাওয়ার পর মার্কিন কাপড় থেকে ছোট চামচের মাধ্যমে কেঁচিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এ ভেজা শক্ত নীল রোদে শুকিয়ে দানাদার নীল তৈরি হয়। প্রথমে রোদে শুকালে নরম কয়লার মতো হয়। ১-২ দিন শুকালেই নীল শক্ত হয়। পরে গ্রাইন্ডিং মেশিনে বা হলারে বা পাটাতে পিশে গুঁড়া করে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। 

সাধারণভাবে প্রতি প্যাকেট নীলের দাম আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে কৌশল আর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে মান ভালো হয়। তখন দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়, লাভও বেশি হয়। অনেক সময় ছোট ছোট আস্ত টুকরা করে ৫ টাকা করে বিক্রি করা হয়। 

রংপুরে নীল চাষ। প্রান্তিক চাষির অর্থকরী ফসল

নীলের ফলন

প্রতিবারে প্রতি শতক জমি থেকে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি পাতা সংগ্রহ করা যায়। প্রতি ১ একর জমি থেকে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার কেজি পাতা কাটা যায়। প্রতি কেজি পাতা মূল্য ২ থেকে ৩ টাকা হারে বিক্রি হয়। প্রতি একর থেকে ৫০ হাজার টাকার শুধু নীলপাতা বিক্রি করা যায়। তাছাড়া জ্বালানি এবং জৈবসার তো আছেই। এ পদ্ধতিতে ২০০ থেকে ২৫০ কেজি পাতা থেকে ১ কেজি নীল পাওয়া যায়। ১ কেজি নীল পেতে ১ হাজার টাকা খরচ হয়। বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি প্রাকৃতিক নীল প্রায় ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ মানসম্মত হতে হবে।

স্থানীয় পর্যায়ের সংগ্রহ পদ্ধতিতে প্রায় ১০ ভাগ নীল পাওয়া যায়। এ কারণে অনেক দেশে প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রফতানি করা যাচ্ছে না। নীলের বীজ থেকে নীল তেল তৈরি করা যায়। ১০ মিলিলিটার তেল ৩০ মার্কিন ডলার। ৫ কেজি বীজ থেকে ১ কেজি তেল পাওয়া যায়। বীজের মূল্য ১৫০ টাকা ২০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি। নীল চাষে আর উৎপাদন খরচ নেই বললেই চলে। কেননা এটা অনুর্বর জমিতে আবাদ করা হয় জমি উর্বর করার জন্য। তাই কোনো সার পানি বালাইনাশক দেয়ার দরকার হয় না। শুধু শ্রমিক মজুরি লাগে। সর্বসাকুল্যে ১ একরে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। 

উত্তরবঙ্গে নীল চাষের পথিকৃৎ ডা. নিখিল চন্দ্র রায় বলেন, নীলগাছ দিয়ে জাক দেয়ার পর বাছাই করা ডালপালা থেকে উৎকৃষ্ট মানের কম্পোস্ট সার তৈরি; পাতা সংগ্রহের পর গাছের অবশিষ্টাংশ থেকে কয়েল তৈরি এবং নিজের তৈরি বন্ধু চুলাতে ব্যবহার; ছাকনির সময় ফেলে দেয়া পানি মিনি প্যাকেটজাত করে ক্লিনার লিকুইড হিসেবে বাজারে বিক্রি করা যায়।

Post a Comment

0 Comments