সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ভাদ্র (মধ্য আগস্ট–মধ্য সেপ্টেম্বর) মাসের ফসল, কৃষকের করণীয়


নীল আকাশে সাদা ছেঁড়া মেঘ আর সাদ কাশফুলের সমারোহ জানা দেয় শরৎ ঋতুর আগমন। সবে বর্ষা ঋতু শেষ হয়ে যাওয়া তখনো পানিতে সারাদেশ টইটুম্বুর থাকে। সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামে। আবার ভ্যাপসা গরম। এসময়টাতে ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা একটু বেশি থাকে।  এ কারণে এ মাসটাতে ফসলের প্রতি একটু বাড়তি নজর দিতে হবে। ভাদ্র মাসে প্রয়োজনীয় কাজগুলো দেখে নেওয়া যাক:

আমন ধান

আমন ধান ক্ষেতের অন্তর্বর্তীকালীন যত্ন নিতে হবে। ক্ষেতে আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আমন ধানের জন্য প্রতি একর জমিতে ৮০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হয়। এ সার তিনভাগ করে প্রথম ভাগ চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৩০-৪০ দিন পর এবং তৃতীয় ভাগ ৫০-৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। নিচু জমি থেকে পানি নেমে গেলে এসব জমিতে এখনো আমন ধান রোপণ করা যাবে। দেরিতে রোপণের জন্য বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল, নাইজারশাইল বা স্থানীয় উন্নত ধান বেশ উপযোগী। দেরিতে চারা রোপণের ক্ষেত্রে প্রতি গুছিতে ৫-৭টি চারা দিয়ে ঘন করে রোপণ করতে হবে। আমন মৌসুমে মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগ পরা রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময় শেষ কৌশল হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।

পাট

বন্যায় তোষা পাটের বেশ ক্ষতি হয়। এতে ফলনের সাথে সাথে বীজ উৎপাদনেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। বীজ উৎপাদনের জন্য ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত দেশি পাট এবং আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত তোষা পাটের বীজ বোনা যায়। বন্যার পানি উঠে না এমন সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে জো বুঝে  লাইনে বুনলে প্রতি শতাংশে ১০ গ্রাম আর ছিটিয়ে বুনলে ১৬ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। জমি তৈরির সময় শেষ চাষে শতকপ্রতি ২৭০ গ্রাম ইউরিয়া, ৪০০ গ্রাম টিএসপি, ১৬০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে। পরবর্তীতে শতাংশপ্রতি ইউরিয়া ২৭০ গ্রাম করে দুই কিস্তিতে বীজ বপনের ২০-২৫ দিন এবং ৪০-৪৫ দিন পর জমিতে দিতে হবে।

আখ

এসময় আখ ফসলে লালপচা রোগ দেখা দিতে পারে। লালপচা রোগের আক্রমণ হলে আখের কাণ্ড পচে যায় এবং হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। এজন্য আক্রান্ত আখ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে যাতে পানি না জমে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া রোগমুক্ত বীজ বা শোধন করা বীজ ব্যবহার করলে অথবা রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করলে লালপচা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। লালপচা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি আখের জাত হচ্ছে ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ৩০।

তুলা

ভাদ্র মাসের প্রথম দিকেই তুলার বীজ বপন কাজ শেষ করতে হবে। বৃষ্টির ফাঁকে জমির জো অবস্থা বুঝে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বিঘা প্রতি প্রায় ২ কেজি তুলা বীজ বপন করতে হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৬০ থেকে ৯০   সেন্টিমিটার এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৩০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার বজায় রাখতে হয়। তুলার বীজ বপনের সময় খুব সীমিত। হাতে সময় না থাকলে জমি চাষ না দিয়ে নিড়ানি বা আগাছা নাশক প্রয়োগ করে ডিবলিং পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। বীজ গজানোর পর কোদাল দিয়ে সারির মাঝখানের মাটি আলগা করে দিতে হবে। সমতল এলাকার জন্য সিবি-৯, সিবি-১২, হীরা হাইব্রিড রূপালী-১, ডিএম-২, ডিএম-৩ অথবা শুভ্র জাতের চাষ করতে পারেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ি তুলা-১ এবং পাহাড়ি তুলা-২ নামে উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষ করতে পারেন।

শাকসবজি

ভাদ্র মাসে লাউ ও শিমের বীজ বপন করা যায়। এজন্য ৪-৫ মিটার দূরে দূরে ৭৫ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সে.মি গভীর করে মাদা বা গর্ত তৈরি করতে হবে। এরপর প্রতি মাদায় ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। মাদা তৈরি হলে প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বুনে দিতে হবে এবং চারা গজানোর ২-৩ সপ্তাহ পর দুই-তিন কিস্তিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫ গ্রাম এমওপি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এ সময় আগাম শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। সবজি চারা উৎপাদনের জন্য উঁচু এবং আলো বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বাকরে বীজতলা করে সেখানে উন্নতমানের ও উন্নতজাতের উচ্চফলনশীল ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো এসবের বীজ বুনতে পারেন। বীজতলার মাটি অবশ্যই শুকনো হতে হবে। অন্যথায় গোড়া ও মূল পচা রোগে সব চারা পচে যেতে পারে।

গাছপালা

ভাদ্র মাসেও ফলদবৃক্ষ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা যায়। বন্যায় বা বৃষ্টিতে মৌসুমের রোপিত চারা নষ্ট হয়ে থাকলে সেখানে নতুন চারা লাগিয়ে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে হবে। এছাড়া এবছর রোপণ করা চারার গোড়ায় মাটি দেয়া, চারার অতিরিক্ত এবং রোগাক্রান্ত ডাল ছেঁটে দেয়া, বেড়া ও খুঁটি দেয়া, মরা চারা তুলে নতুন চারা রোপণসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে। ভাদ্র মাসে আম, কাঠাল, লিচু গাছ ছেঁটে দিতে হয়। ফলের বোঁটা, গাছের ছোট ডালপালা, রোগাক্রান্ত অংশ ছেঁটে দিলে পরের বছর বেশি করে ফল ধরে এবং ফলগাছে রোগও কম হয়।

প্রাণিসম্পদ

ভাদ্র মাসের গরমে পোলট্রি শেডে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে। টিনশেডে চটের ছালা রেখে মাঝে মাঝে পানি দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে। যাতে করে অধিক গরমে মুরগিগুলো মারা না যায় এবং নানা রোগের বিস্তার না ঘটে। ভেজা আবহাওয়া ও মাঝে মাঝে গরম পোলট্রির ক্ষেত্রে গামবোরো রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি করে। এ রোগে  মুরগির পালক নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। গা গরম ও কাঁপুনি দেখা দেয়। সাদা পানির মতো পাতলা পায়খানা দেখা যায়। মুরগি সহজে নড়ে না। এমনিতে ভাইরাসজনিত এ রোগের কোন চিকিৎসা নেই। এজন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে ও রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ মাসে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটানো যেতে পারে। এ মাসে ফুটানো মোরগ-মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে এদের চিকিৎসা করাতে হবে।

বাংলাদেশে গোখাদ্যের সমস্যা এখনও বিরাজমান। সে কারণে পতিত জমিতে নেপিয়ার, বাজরা, খেসারি, মটর, ইপিল ইপিল, গিনি ঘাস লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দুধবতী গাভী পালন এবং যারা গরু মোটাতাজাকরণ করবেন, তাদের অবশ্যই গবাদিপশুকে সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে। কোন জায়গায় যদি পানি জমে থাকে সে এলাকায় জন্মানো ঘাস গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে না। কারণ এতে গাভী বা গরুর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। গরু ও ছাগলকে নিয়মিত গোসল করার ব্যবস্থা করতে হবে। গোয়াল ঘরের গোবর নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার। আর গরুর গায়ের আঠালি, মাছি, জোঁক পোকামাকড় বেছে দিতে হবে। তড়কা, বাদলা, গলাফুলা রোগ যাতে না হয় সেজন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারি সার্জনের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।

মৎস্যসম্পদ

পুকুরে সার ব্যবহারের মাত্রা আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলতে হবে। জৈবসার ব্যবহার না করাই ভালো। খাদ্য ঘাটতির জন্য পরিমাণ মতো অজৈব সার ব্যবহার করা দরকার। পুকুরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

পুকুরে নতুন মাছ ছাড়ার সময় এখন। মাছ ছাড়ার আগে পুকুরের জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। পুকুর জীবাণুমুক্ত করে সঠিক সংখ্যক সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে। যেসব পুকুরে মাছ আছে সেসব পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা দরকার। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি-পুকুরে পাঙ্গাশ মাছের চাষ, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ, প্লাবিত এলাকায় ঘেরের মাধ্যমে রাজপুঁটি ও চিংড়ির চাষ, পুকুরে রুই জাতীয় ও চিংড়ির মিশ্র চাষ এবং প্লাবিত এলাকায় খাঁচায় মাছ চাষ করা যেতে পারে। বন্যার কারণে ভেসে যাওয়া পুকুরের মাছ পুকুরে রাখতে ভেসে যাওয়া পুকুরগুলোর ১৫ থেকে ২০ মিটার দূরত্বে একটি চটের ব্যাগে ৫ থেকে ৭ কেজি ধানের কুড়া বা গমের ভুসি ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পানির নিচে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। তবে ব্যাগটিতে অবশ্যই ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে। খাবার পেয়ে মাছ পুকুরেই অবস্থান করবে। কোন কারণে পুকুরের পানি যদি দূষিত হয় তবে ভাইরাস, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে মাছের ক্ষত রোগ দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেহের ভারসাম্যহীনতা, শরীরে লাল দাগ দেখা যায়। পরে মাছ ক্ষতরোগে মারা যায়। এ রোগ প্রতিকারে অধিক আক্রান্ত মাছ উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। প্রতি শতক পুকরে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হবে। ছোট ও ব্রুড মাছের জন্য প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ৬০ থেকে ১০০ মিলি গ্রাম টেরামাইসিন মিশিয়ে মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে।

আরো পড়ুন:

Post a Comment

0 Comments