কোরবানি ঈদের সময় অনেক খামারিই নিজে হাটে ছাগল নিয়ে যান। দালাল বা ফরিয়াদের কাছে বিক্রি করার চেয়ে এভাবে একটু কষ্ট করলে ভালো দাম পাওয়া যায় তাতে সন্দেহ নেই। যারা সারা বছর কষ্ট করে এই একটা মৌসুমের জন্য ছাগল পালন করেন তারাই সেটা বোঝেন।
কিন্তু হাট যদি হয় দূরবর্তী স্থানে তাহলে একসঙ্গে বেশি ছাগল বহন করার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বিশেষ করে গরমের সময়, প্রচণ্ড রোদের দিনে এই সতর্কতাগুলো খুব জরুরি। তা না হলে আপনার ঘরবন্দি ছাগলগুলো গরমে, ভ্রমণের ধকলে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এমনকি কোরবানির হাটে কিন্তু এভাবে ছাগল মারা যেতেও দেখা যায়।
হাটে ছাগল নেওয়ার প্রস্তুতিটা একমাস আগে থেকে নেয়াই ভালো। কোন ধরনের যানবাহনে ছাগল পরিবহন করবেন সেটিও আগেই ঠিক করুন। ট্রাকে, ভটভটিতে বা ট্রলিতে ছাগল পরিবহনের সময় উপরে ত্রিপল টানাতে পারলে ভালো যাতে ছায়া থাকে। আর কখনোই গাদাগাদি করে ছাগল নেওয়া যাবে না। নড়াচড়া করার যথেষ্ট জায়গা রাখতে হবে। ছাগল না বেঁধে ছেড়ে দিয়ে রাখা ভালো। তা না হলে গলায় ফাঁস লেগে মারা যাওয়ার ভয় থাকে।
[হাটে বিক্রি বা খামারের জন্য কিনে আনার ছাগলের জন্য একই ব্যবস্থা।]
ছাগলকে এক জায়গা থেকে গাড়িতে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের পূর্বপ্রস্তুতি
ক. খামারের যেসব ছাগল এক লটে বিক্রি করতে চান সেই নির্বাচিত ছাগলগুলোর আগে পিপিআর টিকা না
দেয়া থাকলে পরিবহনের অন্তত ২১ দিন টিকা দিয়ে নিতে হবে।
খ. পরিবহনের ১-২ ঘণ্টা আগে ছাগলের মাংসের মধ্য ১ মিলি লিটার (মি.লি) রেনামাইসিন এলএ ইনজেকশন দিয়ে নিন। এতে ছাগল পরিবহনজনিত অসুস্থতা থেকে রক্ষা পায়। অবশ্য এটি যেহেতু একটি অ্যান্টিবায়োটিক তাইলে এ ইনজেকশন দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, অপশনাল। না দিলেও চলবে। তবে নিশ্চিন্ত থাকার জন্য দেওয়াই ভালো।
গ. পরিবহনের আগে ছাগলকে পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণ ও চিটাগুড় মিশ্রিত পানি পান করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিচে বর্ণিত স্যালাইন ব্যবহার করা যেতে পারে (১টি ছাগলের জন্য):
১. পানি : ১ লিটার
২. লবণ : ১০ গ্রাম
৩. চিটাগুড় : ৩০ গ্রাম
এই স্যালাইন ছাগলের ভ্রমণজনিত ধকল সামলে উঠতে সহায়তা করবে।
ঘ. পরিবহনের সময় ছাগলের গায়ে যাতে সরাসরি বাতাস না লাগে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ত্রিপল দিয়ে গাড়ির চারপাশে বন্ধ করে দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ভেতরে অক্সিজেন প্রবাহ যেন ঠিক থাকে। বিশেষ করে শীত ও বর্ষার সময় এই ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরি। তবে প্রচণ্ড গরম হলে বাতাস চলাচল করতে দিতে হবে।
ঙ. পরিবহনের পর নতুন আনা ছাগলকে খামারে আগের ছাগলের সাথে মেশানো যাবে না। তাদেরকে অন্তত দুই সপ্তাহ আলাদা শেডে রাখতে হবে এবং কোনো রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে খামার থেকে সরিয়ে আলাদা করে ফেলতে হবে।
চ. পরিবহনের সাত দিনের মধ্যে ছাগলকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
ছ. দূরবর্তী স্থান থেকে দীর্ঘভ্রমণ করা ছাগলকে তিন দিন শক্ত ও বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার না দেওয়াই ভালো। সহজে হজম হয় এমন খাবার দিন। কাঁচা ঘাস, প্রচুর পানি, চিটাগুড়, সামান্য দানাদার খাবার দিতে পারেন।
একনজরে যা করবেন এবং করবেন না
যা করতে হবে
পরিববহনে তোলা এবং নামানোর সময় তাড়াহুড়া করা যাবে। ছাগলকে নিজের মতো করে ধীর ও শান্তভাবে নামতে দিন।
যথেষ্ট বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে এমন গাড়িতে পরিবহন করুন।
গাড়ির সামনের অংশে যেন বাতাসকে বাধা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
গাড়ির মেঝে (Floor) যেন ঢালু এবং পিচ্ছিল না হয়।
কখনোই গাদাগাদি করে নেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে একাধিক গাড়ি ব্যবহার করুন বা একাধিক ট্রিপ দিন।
অবস্থা ও বয়স ভেদে আলাদা করে নিন। যেমন: দুধ খাওয়া বাচ্চা ও প্রাপ্তবয়স্ক পাঁঠা বা খাসি একসঙ্গে নিবেন না। আবার ভরপুর গর্ভবতী ছাগলকে অবশ্যই আলাদা নিবেন।
যা করা যাবে না
ছাগলকে শিং ধরে টেনে হিঁচড়ে নিবেন না। গলায় দড়ি বেঁধে টানুন।
শোয়ানোর জন্য পায়ে দড়ি বাঁধবেন না।
যথেষ্ট বাতাস চলাচল করে না এমন গাড়িতে ছাগল পরিবহন করবেন না।
অন্য পশুর সঙ্গে ছাগল পরিবহন করবেন না।
নতুন ছাগল রাখার জন্য খামারে আলাদা ব্যবস্থা রাখা ভালো। এতে আঘাত, রোগ, বেশি ঘন হওয়ায় এবং পদদলিত হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো যায়।
প্রথম কয়েক দিন একটি ছোট খোলা জায়গায় রাখুন, যাতে ছাগলগুলোর প্রতি নজর রাখতে পারেন। খেয়াল করেন কোনো ছাগল আঘাত পেয়েছে কিনা বা জখম হয়েছে কিনা বা খোঁড়াচ্ছে কিনা। এই সময়টাতেই ছাগলের অভ্যন্তরীণ পরজীবী (বিভিন্ন ধরনের কৃমি) দমন করা জরুরি। তা না হলে আপনার খামারে এমন কোনো পরজীবীর অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে যা সহজে নির্মূল করতে পারবেন না।
ছাগল বেশি গরম বা শীত কোনোটাই সহ্য করতে পারে না। এছাড়া তারা গাদাগাদি করে থাকতেও পছন্দ করে না। এ বিষয়টি খুব সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে।
পরিবহনের সময় যদি ২৪ ঘণ্টার বেশি হয় তাহলে অবশ্যই সঙ্গে খাবার নিতে হবে। ছাগলকে ২৪ ঘণ্টার বেশি না খাইয়ে রাখা ঠিক নয়। কিছু না পেলেও অন্তত কাঁঠাল পাতা যেন গাড়িতে রাখা হয়। তবে পরিবহনের সময় বেশি খাবার কোনো মতেই দেওয়া যাবে না।
যার কাছ থেকে ছাগল কিনছেন তার কাছে সেসব ছাগলের নিয়মিত রেশন (খাবার) সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন। কারণ হঠাৎ করে রেশনের পরিমান ও ধরন পরিবর্তন করলে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় পরিবহনের পর প্রথম পাঁচ দিন তাদের হে (শুকনো ঘাস, খড় ইত্যাদি) দেওয়াই সবচেয়ে ভালো। এতে ছাগলের রুমেন ধীরে ধীরে নতুন পরিবেশ ও রেশনের সঙ্গে খাপ খেয়ে উঠবে।
0 Comments