সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ধানের ব্লাস্ট রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার (সচিত্র)

ধানের ব্লাস্ট রোগ
ধানের পাতা ব্লাস্ট রোগ
ব্লাস্ট রোগ (Blast)। সারা বিশ্বের ধানের একটি অন্যতম মারাত্মক রোগ। এ রোগ বীজতলায় চারা গাছকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। আবার রোপণের পর ধান গাছ এ রোগের আক্রান্ত হলে ফলন ব্যাপকভাবে কমে যায়। আক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করলে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।  ধান গাছের সাধারণত ৩টি অংশে ব্লাস্ট রোগ আক্রমণ করে থাকে। গাছের আক্রান্ত অংশের ওপর ভিত্তি করে এ রোগ তিনটি নামে পরিচিত যেমন- ১. পাতা ব্লাস্ট, ২. গিঁট ব্লাস্ট এবং ৩. নেক/শীষ ব্লাস্ট।

রোগের কারণ
পাইরিকুলারিয়া গ্রিসিয়া (Pyricularia grisea) বা ম্যাগনাপোর্থে অরাইজা (Magnaporthe oryzae) নামক ছত্রাকের আক্রমণে ব্লাস্ট রোগ হয়। এ রোগটি আমন ও বোরো উভয় মৌসুমেই হতে পারে। ধানের চারা অবস্থা থেকে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় ব্লাস্ট রোগ হতে পারে। তবে ধান গাছের বয়স যতো বাড়ে লিফ ব্লাস্ট বা পাতা ব্লাস্ট রোগের সম্ভাবনা ততো কমে।

বীজ, বাতাস, কীটপতঙ্গ ও আবহাওয়ার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। ঘন ঘন এবং দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত এবং দিনের বেলা ঠান্ডা পড়লে এ রোগের আক্রমণ বাড়ে।
এছাড়া দিন ও রাতের তাপমাত্রার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য যেমন, রাতে ঠান্ডা, দিনে গরম ও সকালে পাতায় পাতলা শিশির জমলে ব্লাস্ট রোগ দ্রুত ছড়ায়। মূলত রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য খুব বেশি হলেই পাতায় শিশির জমে।
তাছাড়া দিন রাত ঠান্ডা আবহাওয়া থাকলেও ব্লাস্টের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। মাটিতে রস কম থাকলেও ব্লাস্ট হতে পারে। এ কারণে  হালকা পলি মাটি বা বেলেমাটির পানি ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় এমন জমির ধানে ব্লাস্ট রোগ বেশি হতে দেখা যায়।
জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পটাশ সার দিলেও এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। দীর্ঘদিন জমি শুকনা অবস্থায় থাকলেও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে।
ধান গাছের অঙ্গসংস্থান
ধান গাছের অঙ্গসংস্থান (Morphology)

রোগের লক্ষণ
ধান গাছের পাতা ও পত্রফলকের গোড়ায় কোনো ক্ষত দেখা যাচ্ছে কি না নিয়মিত পরীক্ষা করুন। ধান গাছের পাতা, পত্রফলকের গোড়া (collar), গিঁট (node), শীষের গোড়া (neck), শীষ বা শীষের অংশ বিশেষ (panicle) এবং কখনো পত্রধারকও (leaf sheath) ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে পাতায় সাদাটে থেকে ধূসর সবুজ ক্ষত বা স্পট/দাগ দেখা যায়। এসব দাগের চারপাশটা ঘন সবুজ হয়।

পুরনো ক্ষত হলে পাতার উপর উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকার বা মাকু আকৃতির ক্ষত হয়। এর মধ্যখানে ধূসর রঙের হয়, আর চারদিকে লাল বা বাদামি মতো অথবা মরে শুকিয়ে যাওয়ার মতো বর্ডার বা কিনার থাকে।

কিছু ক্ষত ডায়মন্ড আকৃতির হয়। অর্থাৎ মাখানে বেশ প্রসারিত কিন্তু দুই প্রান্ত সরু।
ক্ষতগুলো ক্রমেই মিলিত হয়ে বড় ক্ষততে পরিণত হয়। এবং পুরো পাতাটি একসময় মরে যায়।
ব্লাস্ট রোগে পাতায় ডায়মন্ড আকৃতির ক্ষত
পাতায় ডায়মন্ড আকৃতির ক্ষত
ব্লাস্টের ক্ষত অনেক সময় ধানের বাদামি দাগ ক্ষতের সঙ্গে অনেকে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। পাতার ব্লাস্টের ক্ষত সাধারণত লম্বাটে দুই মাথা সরু আকৃতির হয়। কিন্তু বাদামি দাগ রোগের ক্ষতের আকৃতি হয় অনেকটা গোলাকার, ডিমের মতো। এর কিনার কখনো সুঁচালো বা সরু হয় না। তাছাড়া বাদামি দাগ রোগের ক্ষতের রঙ হয় বাদামি এবং ক্ষতগুলোর চারপাশ থাকে হলুদ বা হলুদাভ।
ধানের পাতা ব্লাস্ট
পাতা ব্লাস্ট
পাতা ব্লাস্ট
পাতায় প্রথমে ডিম্বাকৃতির ছোট ছোট ধূসর বা সাদা বর্ণের দাগ দেখা যায়। দাগগুলোর চারদিক গাঢ় বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এ দাগ ধীরে ধীরে বড় হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে। অনেক দাগ একত্রে মিশে পুরো পাতাটাই মেরে ফেলতে পারে। এ রোগে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে জমিতে মাঝে মাঝে পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রে খোল ও পাতার সংযোগস্থলে কাল দাগের সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে পচে যায় এবং পাতা ভেঙে পড়ে ফলন বিনষ্ট হয়।।
ধানের কলার ব্লাস্ট
কলার ব্লাস্ট
ধানের গিঁট ব্লাস্ট
গিঁট ব্লাস্ট
গিঁট বা নোড ব্লাস্ট
ধান গাছের থোড় বের হওয়ার পর থেকে এ রোগ দেখা যায়। গিঁটে কালো রঙের দাগ সৃষ্টি হয়।  ধীরে ধীরে এ দাগ বেড়ে গিঁট পচে যায়, ফলে ধান গাছ গিঁট বরাবর ভেঙে পড়ে।
ধানের নেক ব্লাস্ট
নেক বা শীষ ব্লাস্ট
নেক বা শীষ ব্লাস্ট
এ রোগ হলে শীষের গোড়া অথবা শীষের শাখা প্রশাখার গোড়ায় কাল দাগ হয়ে পচে যায়। শীষ অথবা শীষের শাখা প্রশাখা ভেঙে পড়ে। ধান চিটা হয়।
ধানের ব্লাস্টের লক্ষণ
কলার ব্লাস্ট, পাতা ব্লাস্ট আক্রমণের কয়েক দিন পর, মাকু আকৃতির ক্ষত

রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকার
রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করার হলো ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধের প্রথম ধাপের ও সবচেয়ে সহজ উপায়।
মাটিতে জৈব সারসহ সুষম মাত্রায় সব ধরনের সার ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত জমির খড়কুটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ছাই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
সুস্থ গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে, দাগি বা অপুষ্ট বীজ বেছে ফেলে দিয়ে সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে।
রোগের আক্রমণ হলে জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
জমিতে সব সময় পানি রাখতে হবে।
রোগের শুরুতে হেক্টরপ্রতি ৪০ কেজি (বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
ট্রাইসাইক্লাজল (ট্রুপার ৭৫ ডব্লিউপি) বা টেবুকোনাজল + ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন (নাটিভো৭৫ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
আমনের ক্ষেত্রে সম্ভব হলে বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই আগাম বীজতলা তৈরি করুন।
নাইট্রোজেন সার বা ইউরিয়া প্রয়োগ করুন দুই বা দুইয়ের বেশি ভাগে। বেশি সার দিলে কিন্তু ব্লাস্টের আক্রমণ বাড়ে।
আক্রান্ত জমিতে জমিতে পানি না থাকলে দ্রুত সেচের ব্যবস্থা করুন। পানি ধরে রাখুন।
সিলিকন সার যেমন: ক্যালসিয়াম সিলিকেট প্রয়োগ করা যেতে পারে। কারণ মাটিতে যথেষ্ট সিলিকন থাকলে ব্লাস্টের আক্রমণ কম হয়। তবে এ সার খুবই ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে ধান বা ধান জাতীয় শস্যের খড় প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ধরনের খড়ে প্রচুর সিলিকন থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এসব খড় যেন ব্লাস্টমুক্ত হয়।
ছত্রাকনাশক ওষুধ আগে থেকেই জমিতে প্রযোগ করলে ব্লাস্ট থেকে নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা বেশি।

আরো পড়ুন
বায়ো এজেন্ট: পোকা দিয়ে ফসলের পোকা দমন
ধানের বাদামি দাগ রোগ ও প্রতিকার (সচিত্র)
আলুর লেইট ব্লাইট বা মড়ক রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার (সচিত্র)

Post a Comment

0 Comments