সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

মুন্সীগঞ্জ জাতের গরু বা মিরকাদিমের ধবল গরু

মুন্সীগঞ্জ জাতের দেশী গরু
মুন্সীগঞ্জ জাতের গরু
আধুনিক খামারের ধারণা বাংলাদেশে এসেছে বেশ দেরিতেই। এদেশে গৃহস্থ্যরা সাধারণত হাল চাষের জন্য ‍দুটি বলদ আর ঘরে খাওয়ার জন্য একটি কালো বা লাল গাভীর রাখতেন। গরু থেকে বাড়তি আয়ের চিন্তা তখন ছিল না। এ কারণে বেশি উৎপাদনশীল গরুর ভাবনাও তাদের মাথায় আসেনি। ঘরে ঘরে যেসব গরু থাকতো তার সবগুলোই দেশীয় জাত। বাংলাদেশে প্রধানত তিন জাতের গরু পাওয়া যায়। এগুলো আকারে ছোট হলেও স্থানীয় জাত হওয়ার কারণে এগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। মাংসও বেশ সুস্বাদু। সাধারণত জীবনকালের উৎপাদন পর্যায়ের শেষে গাভী ও ষাঁড়গুলো এদেশে মাংস উৎপাদনে ব্যবহরা করা হতো। ফলে বাংলাদেশে দুধ ও মাংস উৎপাদনের জন্য বিশেষায়িত কোনো গরুর জাত তৈরি হয়নি।

ভারত পাকিস্তান ভাগের আগে এদেশের জমিদাররা ভারত থেকে বেশি দুধ দেওয়া কিছু জাতের গরু এদেশে নিয়ে আসেন। এসব গরুর সাথে দেশী গরুর প্রাকৃতিকভাবে প্রজননের ফলে সংকর জাতের গরুর উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে এই সংকর জাত থেকেই নতুন জাতের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো দুধ ও মাংস উৎপাদনে মূল দেশী গরুর চেয়ে উন্নতমানের।

মুন্সিগঞ্জ গরু হচ্ছে এমনি একটি জাত। স্বাধীনতার পরে দেশের দুধ ও মাংস উৎপাদন বাড়াতে সংকরায়ন কার্যক্রম জোরদার করা হয়। সরকারের এ উদ্যোগের ফলে দেশী গরুর প্রতি খামারিদের আগ্রহ কমতে থাকে এবং বিদেশী সংকরায়নের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে আস্তে আস্তে মুন্সিগঞ্জ জাতের গরুর সংখ্যাও কমতে থাকে।  বর্তমানে এ জাত বিলুপ্ত প্রায় । তবে ২০১৩ সাল থেকে জাতটির উন্নয়নে কাজ করছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)।

মুন্সিগঞ্জ গরুর বাহ্যিক গঠন
এই জাতের গরুগুলো সাধারণত মধ্যম আকৃতির হয়। গরুর গায়ের লোম হালকা ধূসর (cream) থেকে সাদাটে বর্ণের হয়। বয়ঃপ্রাপ্তির সাথে সাথে ষাঁড় গরুর সম্মুখ ভাগে কুঁজের (Hump) কাছাকাছি স্থানে লালচে আভা দেখা যায় । এই জাতের গরুর নাকের অংশ, চোখের পাতার লোম, লেজে চুলের গোছা এবং খুর বাদামি রঙের হয়। শিং মধ্যম বা ছোট আকৃতির ও বাঁকানো এবং খাড়াভাবে উপরের দিকে বিন্যস্ত থাকে । ষাঁড়ের গলকম্বল ও কুঁজ মধ্যম ধরনের এবং গাভীর তুলনায় উন্নত হয়। পূর্ণবয়স্ক ষাঁড়ের দৈহিক ওজন ৩০০-৪০০ কেজি এবং গাভীর দৈহিক ওজন ২০০-২৫০ কেজি।
মুন্সীগঞ্জ জাতের ষাঁড় গরু
মুন্সীগঞ্জ জাতের ষাঁড়
প্রজনন বৈশিষ্ট্য
বকনা গরু ৩.০-৩.৫ বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়। পরবর্তীতে প্রতি ১২-১৩ মাস অন্তর অন্তর বাচ্চা দেয় এবং বাচ্চা দেয়ার ৬০-৭০ দিনের মধ্যে পুনরায় গরম হয়।

দুধ উৎপাদন
খামারি পর্যায়ে প্রচলিত খাদ্য ব্যবস্থাপনায় মুন্সীগঞ্জ গাভী দৈনিক গড়ে ৩.০০ থেকে ৪.০০ লিটার দুধ দেয় । বিএলআরআই গবেষণা খামারে গাভী প্রতি দৈনিক গড় দুধ উৎপাদন হচ্ছে ৪.৫ থেকে ৫.৫ লিটার । তবে, কিছু সংখ্যক গাভী দৈনিক ৮.০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়।
মুন্সীগঞ্জ জাতের গাভীর বৈশিষ্ট্য
মুন্সীগঞ্জ জাতের গাভী
মুন্সিগঞ্জ জাতের গরুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য
এ জাতের গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিদেশী সংকর জাতের গরুর তুলনায় অনেক বেশি। ফলে এ জাতের গরু পালনে চিকিৎসা ব্যয় অনেক কম। এছাড়া দেশীয় প্রচলিত খাদ্য ও ব্যবস্থাপনায় নিয়মিত দুধ ও বাচ্চা দেয়। গাভীগুলো শান্ত স্বভাবের হওয়ায় পরিবারের নারী সদস্যরাই এদের লালন পালন করতে পারে।

মুন্সিগঞ্জ গরুর আবাসস্থল মুন্সিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা। তবে মুন্সিগঞ্জ জেলা সংলগ্ন বিভিন্ন জেলায় এ জাতের গরু মাঝে মধ্যে দেখা যায় । বিএলআরআই মুন্সিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জরিপ চালিয়ে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে,ঐসব অঞ্চলের মোট গরুর মাত্র ৩.৫৯% হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ জাতের গরু। মাঠ পর্যায়ে বিদ্যমান মুন্সিগঞ্জ জাতের গরুগুলোর মধ্যে ১২.৭০%, ১৯.০৫% এবং ৬৮.২৫% হচ্ছে যথাক্রমে ১ বছরের নিচের বয়সের বাছুর, বাড়ন্ত গরু (১ বছর থেকে বাচ্চা দেওয়ার আগ পর্যন্ত বয়স) এবং বয়স্ক (নুন্যতম একবার বাচ্চা দিয়েছে) গরু । মাঠ পর্যায়ে বিশুদ্ধ মুন্সিগঞ্জ জাতের গরুর ষাঁড় বা সিমেন সহজপ্রাপ্য নয়। এ কারণে জাতটি এখন বিলুপ্তির ‍ঝুঁকিতে রয়েছে।

মিরকাদিমের ধবল গরু
মুন্সীগঞ্জ জাতেরই একটি ভ্যারাইটি হলো মিরকাদিমের ধবল বা সাদা গরু। এক সময় পুরান ঢাকার লোকেরা মিরকাদিম ছাড়া অন্য গরুর মাংস খেতই না। এর বড় কারণ এ জাতের গরুর মাংসের আঁশ খুব চিকন ও নরম। রান্নার পর মোলায়েম হয়ে যায়। মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম নামক স্থানের নামেই এ গরুর নামকরণ। তাছাড়া  মিরকাদিমের গাই গরুর চোখের পাঁপড়ি সাদা, শিং সাদা, নাকের সামনের অংশ সাদা, পায়ের খুর সাদা, লেজের পশম সাদা, আর সারা শরীর তো সাদাই।
মিরকাদিমের ধবল গরু
মিরকাদিমের সাদা গরু
ব্রিটিশ আমল থেকে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম ছিল বিখ্যাত একটি নদীবন্দরের নাম। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে জাহাজ নোঙর করতো। তখন মিরকাদিমের এই বন্দরে লাখ লাখ মানুষের আনাগোনা ছিল। তৎকালীন এই বন্দরকে কেন্দ্র করে নানা রকম ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় তেলের মিল, ধান চালের আড়তসহ শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

দেশী বিদেশী ব্যবসায়ীদের আনাগোনার বদৌলতে এখানকার ধবল গরুর চাহিদা সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে ধবল গরু আর ভুটানের বুট্টি গরু পালন হতো বেশি। তবে ভারতের উড়িষ্যা, জঙ্গলি, নেপালি গরুও এখানে লালন পালন করা হতো। ধান-চাল আর তেলের কারখানা থাকার কারণে মিরকাদিমে ভূষি, কুড়া, খৈলসহ বিভিন্ন উন্নতমানের গোখাদ্য খুব সহজে পাওয়া যেত। এখনকার ব্যবসায়ীরাও মিরকাদিমের গরুকে মিনিকেট চালের খুদ, এক নাম্বার খৈল, ভাতের মাড়, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভূষি, গমের ভূষি, বুটের ভূষি ও রাব (মিষ্টিগুড়) খাওয়ান। সঙ্গে ভুট্টা চূর্ণ করে দেওয়া হয়। কোনো ঘাস খাওয়ানো হয় না। তাই মিরকাদিমের গরুর মাংসে আঁশ কম থাকে। মাংস একটু নরম ও তেলতেলে হয়। এ কারণে এখানকার গরু পালনে খরচ বেশি। দামও অন্যান্য গরুর চেয়ে বেশি।

তবে মিরকাদিমের কুলুপাড়া ধবল গরু পালন করার ঐতিহ্য ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। ২০০ বছরের এই ঐতিহ্য এখন হারানোর পথে।  ধবল গরুর খামার মালিকের সংখ্যা আগে যেখানে ২০০ জনের বেশি ছিল, এখন এসে দাঁড়িয়েছে ১০-১২ তে। কোনো খামারির কাছেই ৫-৬টার বেশি গরু নেই।

Post a Comment

0 Comments