সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

পাবনা ক্যাটল বা পাবনা জাতের গরু

পাবনা ক্যাটল বা পাবনা জাতের গরু
পাবনা জাতের গরু
পাবনা ক্যাটল বা পাবনা জাতের গরুর আবাস এর নামেই স্পষ্ট। এ জাতের গরু পদ্মা ও যমুনা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে পাওয়া যায়। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় এখনো এ জাতের গরুর অনেক দেখা মেলে। যদিও নির্বিচারে সংকরায়নের কারণে আসল জাতও হুমকির মুখে রয়েছে।

গবেষকরা বলেন, জমিদারি আমলে যখন ভারত থেকে অধিক উৎপাদনশীল গরু এদেশে আমদানি করা হয় তখন স্থানীয় জাতের সাথে দীর্ঘদিন সংকরায়নের ফলে কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ জাতের গরু তৈরি হয়। পরবর্তীতে সেগুলো আলাদা জাত হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারত থেকে আনা গরুর সঙ্গে স্থানীয় জাতের গরুর সংকরায়নের ফলে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে যেসব জাতের উদ্ভব ঘটেছে তার মধ্যে একটি হলো পাবনার গরু। সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় এ জাতের গরু পাওয়া যায়। বিশেষ করে পদ্মা ও যমুনা নদীর সঙ্গমস্থলের উজানে পাবনা জাতের গরুর বিস্তৃতি। এ জাতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে দেশী বকনা এবং সিন্ধী ও শাহীওয়াল ষাঁড়ের মাধ্যমে। মূলত দুগ্ধ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে আনা ভারতীয় গরুর সঙ্গে দেশী গরুর সংকরায়নের ফলে এ জাতের উদ্ভব ঘটে। এ কারণে ঐতিহাসিকভাবে দুধ উৎপাদনের হিসেবে পরিচিত পাবনা ও সিরাজগঞ্জে এ জাতটি পাওয়া যায়। আর বেশি দুধ উৎপাদন করে বলেই এ এলাকার মানুষ এ জাতটিকে গত পঞ্চাশ বছর ধরে খুব সতর্কতার সাথে সংরক্ষণের চেষ্টা করেছে।

পাবনা জাতটি উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলাদেশে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন শুরু হয়েছিল আঠারো শতকের শেষভাগে। কাজটি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে তিনটি অঞ্চলের জমিদারি দেখভাল করার জন্য আসতে হতো তাকে। তখনই তিনি এ কাজটি শুরু করেন। শাহজাদপুর অঞ্চলে তার পরগনা দেখতে আসতেন। চলনবিল এবং গোয়ালা নদীর তীরের জলমগ্ন মানুষদের গরিবী ঘোচাতে তিনি হাতে নিয়েছিলেন গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন কার্যক্রম। যমুনা থেকে বড়াল, বড়াল থেকে গোয়ালা এবং এর চারপাশ দিয়ে চলনবিল; এলাকাটি শাহজাদপুর। তদানীন্তন পাবনা জেলার একটি থানা। এ এলাকাটি বছরের বেশিরভাগ সময় জলমগ্ন থাকতো। বর্ষায় মানুষ বাস করতো মাটির ঢিবিতে নির্মাণ করা বাড়িতে।

রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কাজ। এজন্য ভারত থেকে নিয়ে এলেন শাহীওয়াল ও সিন্ধি জাতের কিছু ষাঁড়। ষাড়গুলো তিনি শাহজাদপুর অঞ্চলের কৃষকের মাঝে বিতরণ করলেন। তবে শর্ত দিলেন, তাদের খর্বাকৃতির গাভীগুলো যখন প্রজননে আসবে, তখন এ উন্নত জাতের ষাড় দিয়ে সংকরায়ন করাতে হবে এবং অন্যদেরও তা তা বিনামূল্যে দিতে হবে। শুরু হলো বাংলাদেশে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন কার্যক্রম। ষাঁড়ের মালিকদের প্রতি মাসে ৩০ টাকা করে বরাদ্দ করলেন খাদ্য, যত্ন ও ওষুধপত্রের জন্য।  শুধু তাই নয়, নিজের জমিদারি থেকে ৬০৭ হেক্টর জমি গরুর বাথানের (চারণভূমি) জন্য দান করলেন তিনি। অতি অল্প সময়ে কয়েক হাজার সংকর জাতের গাভী তৈরি হয়। এরা দিনে ১০-১৫ লিটার দুধ দিতে শুরু করে।

বৈশিষ্ট্য
পাবনা জাতের গরুর গায়ের রঙ লাল অথবা ধূসর। আবার দুই রঙের মিশ্রণও হতে পারে। ষাঁড়ের গায়ের রঙ গাঢ় ধূসর থেকে বিভিন্ন মাত্রায় সাদা হতে পারে। এ জাতের গরুর চামড়ার রঙ রঙিন হতে পারে। তার মানে অন্য জাতের গরুর মতো নিখাদ সাদা বা কালো নয়। এ গরুর নাক ও মুখের সামনের অংশ (ঠোঁট), চোখের পাতা, খুর, শিং এবং লেজের পুচ্ছ কালো বর্ণের হয়। বকনা গরুর শরীরের আকার আকৃতি দুধেল জাতের গরুর মতোই। ষাঁড়ের আকার বেশ বড় এবং মাংসের জন্য পালন করার জন্য উপযুক্ত। প্রাপ্তবয়স্ক ষাঁড়ের ওজন ৩৫০-৪০০ কেজি, আর বকনার ওজন ২৫০-২৮০ কেজি।

প্রায় ৫০-৫৫ বছর সময়ের মধ্যে শাহজাদপুর অঞ্চলে একটি অধিক দুগ্ধ উৎপাদনশীল গরুর জাত সৃষ্টি হয়েছিল বলেই ১৯৪৭ সালে সেখানে দুধ পাউডার করার শিল্প স্থাপিত হয়। ১৯৪৭ সালে শাহজাদপুরের কোল ঘেঁসে, লাহিরী মোহনপুর রেলস্টেশনের পূর্বপাশে দুগ্ধ পাউডার কারখানা স্থাপিত হয়। দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি সমবায়ও গড়ে উঠেছিল পাবনার শাহজাদপুরে।

অপ্রিয় হলেও সত্যি কথা হলো, যত্রতত্র কৃত্রিম প্রজননের ফলে দুধের উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে আমরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছি। দেশে ৭০ লাখ সংকর জাতের গরু আছে। কিন্তু সংকর জাতের গাভীগুলোর প্রজনন স্বাস্থ্যের হাজারো সমস্যা। যারা খামার করেন তারা নিশ্চয় সেগুলো জানেন । কৃত্রিম প্রজনেনর ফলে গাভীর মৃত্যু, বাছুরের মৃত্যু, ওলানফোলা রোগ, রিপিট ব্রিডিং, প্রজনন ক্ষমতা চিরতরে নষ্ট হওয়া, মিল্কফিভার এসব সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়।

সংকরায়ন নিয়ে দেশে বিস্তারিত কোনো গবেষণা নেই। জাত ‍উন্নয়নের বিষয়ে কারো কাছেই নেই কোনো সঠিক তথ্য, নেই কোনো প্রতিকারের বিধান। ফলে ফ্রিজিয়ান এবং শাহীওয়াল জাতের বীজ দিয়ে সংকরায়নের কারণে দেশে প্রাথমিক পর্যায় ১৯৮০-১৯৯০ সাল পর্যন্ত গাভীপ্রতি দুধের উৎপাদন ২০-৩০ লিটারের বেশি ছিল। কিন্তু এ দুধের উৎপাদন কমে বর্তমানে ৮ লিটারে নেমেছে।

স্থানীয় জাত সংরক্ষণে মনযোগী না হওয়ার কারণে আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছি। এসব জাতকে অবহেলা করছি মানে আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া অমূল্য সম্পদ হেলায় হারাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ যে পাবনা ব্রিডের সৃষ্টি করেছিলেন, সে জাতের গাভী প্রায় ৭০-৮০ বছর পর্যন্ত ১২-১৫ লিটার দুধ দিত, প্রায় বিনা যত্নে। অথচ জাতটি রক্ষায় কারো কোনো গরজ নেই।

Post a Comment

0 Comments