সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

জাদুর ঘাস ভেটিভার

vetiver grass ভেটিভার ঘাস
ভেটিভার ঘাস

বিশেষ করে নদীর আশেপাশে শক্ত কান্ডযুক্ত এক ধরনের লম্বা ঘাস জন্মে। এর মধ্যে একটিকে উত্তর বঙ্গের কিছু এলাকায় বলে সরঞ্জা। এই ঘাসগুলো থোকা থোকা থাকে। এক জায়গায় ঘন হয়ে থাকে। পাতা এবং কান্ড আখ বা ভুট্টা গাছের মতো। তবে অতোটা মোটা হয় না। কিন্তু লম্বাই প্রায় সমান সমান। পাতায় বেশ ধার। এতোই তীক্ষ্ণ যে গায়ে লাগলে কেটে রক্ত বের হয়। এই ঘাস দিয়ে সাধারণত ঘিরা-বেড়া দেওয়া হয়। অনেকে ঘরের চালাও দেন। আবার শুকিয়ে পোড়ানোও হয়। মূলত রান্না লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

আরেক ধরনের ঘাস আছে, উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় বলে বিন্না। এগুলোই থোকা থোকা জন্মে বলে অনেক এলাকায় বলে বিন্নার থোপ। এগুলো কিন্তু সরঞ্জা বা কাশ জাতীয় ঘাসের মতো নয়। এসব ঘাসের আকার সাধারণত বেশ ছোট হয়। অনেকেই জানেন না এই ঘাস কতোটা উপকারী!

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম এই ঘাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, এই বিন্না ঘাস ব্যবহার করে কীভাবে কম খরচে আবাসন, বাঁধ রক্ষা, পাহাড়ধস ঠেকানো এবং নদীদূষণ কমানো সম্ভব। এর জন্য বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার সম্মাননাও পেয়েছেন।   

গবেষক শরীফুল ইসলাম এই বিন্না ঘাসের নাম দিয়েছেন ‘জাদুর ঘাস’। বিদেশে এটির পরিচিতি 'ভেটিভার' নামে। গবেষণার শুরুটা ২০০৭ সালে। সে বছর বাংলাদেশে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হেসেছিল। দুর্গত এলাকায় গিয়ে শরীফুল বোঝার চেষ্টা করেন—কী করে এই ধরনের দুর্যোগের সময় ক্ষতিগ্রস্ত বাসাবাড়ি ও রাস্তার ঢালগুলোকে ঠিক রাখা যায়। ঢাকায় ফিরে ইন্টারনেট ঘেঁটে জানার চেষ্টা করেন ‘লো কস্ট হাউজিং’ (স্বল্প ব্যয়ে বাড়িঘর নির্মাণ) আর ঢাল বা বাঁধ রক্ষার ওপর কোনো গবেষণা আছে কি না। 

তিনি হতাশ হয়ে দেখলেন, এই নিয়ে গবেষণার সংখ্যাটা খুব নগণ্য। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা, রাস্তার বাঁধ কিংবা নদীর পাড় বাঁচাতে আমাদের দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমানে জিওটেক্সটাইল কিংবা কংক্রিটের ব্লক। এগুলো বানাতে যেমন সময় লাগে, তেমনি ব্যয়বহুল। আবার লবণাক্ত পানির এলাকায় টিকে না। আর সঙ্গে ঠিকাদার এবং সরকারি কর্মকর্তাদের অনিয়ম দুর্নীতি তো রয়েছেই।  

অনেক পড়াশোনার পর বাঁধ রক্ষার এক সবুজ প্রযুক্তির সন্ধান পান শরীফুল ইসলাম। হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এসব দেশে সবুজ প্রযুক্তির মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় একধরনের ঘাস। যেটির নামে বলা হচ্ছে—ভেটিভার। 

 শরীফুল এবার ভেটিভারের খোঁজে নেমে পড়েন। ২০০৮ সালের শেষ দিকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে একজনের ফোন পান, তাঁর পাঠানোর ছবির সাথে মিলে যায় এমন ঘাসের সন্ধান পাওয়া গেছে চর গঙ্গামতিতে। দুদিন পরেই সেই চরে গিয়ে মিলিয়ে দেখলেন, এটিই তাঁর কাঙ্ক্ষিত ভেটিভার। স্থানীয় মানুষজন এই ঘাসকে বলে বিন্না। 

বিন্না ঘাস এনে লবণাক্ত মাটিতে, বালুতে বছরের একেক সময়ে চারা লাগিয়ে বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন শরীফুল ইসলাম। 

এই ভেটিভার আসলে কী?

ভেটিভার হলো একধরনের ঘাস, যা আমাদের দেশে বিন্না ঘাস নামে পরিচিত। এই ঘাসের শিকড় অনেক লম্বা হয়, মাটির গভীরে চলে যায়। মাত্র ৪ থেকে ৬ মাসেই মাটির ৬ থেকে ১০ ফুট গভীরে শিকড় চলে যায়। চারপাশে ছড়িয়েও পড়ে অনেকখানি এলাকাজুড়ে। 

একটা শিকড়ের সহনশক্তি লোহার বা ইস্পাতের ছয় ভাগের এক ভাগ! অর্থাৎ ছয়টা শিকড় একসঙ্গে করলে এটি ইস্পাতের মতোই শক্তিশালী। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই ঘাসের। 

২০০৮ সালে ভেটিভার সংগ্রহের পর থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন অধ্যাপক শরীফুল। তার গবেষণাপত্রগুলো বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে। দেশে বিদেশে অনেকগুলো স্বীকৃতি ও সম্মাননা পেয়েছেন। 

বাংলাদেশে ভেটিভারের প্রয়োগ 

জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেড সাতক্ষীরা, যশোর, কালীগঞ্জ অঞ্চলে মাছের ঘেরের চারপাশে ঢাল প্রতিরক্ষার জন্য অধ্যাপক শরীফুল ইসলামের পরামর্শ নিয়েছে।  

এরপর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশের সহায়তায় বান্দরবান, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় স্বল্প ব্যয়ে বাড়িঘর নির্মাণের কাজ করেছেন তিনি। গ্রামের মানুষকে নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, চারা সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন। 

ইফাদ, এডিবি ও কেএফডব্লিউর সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহায়তায় ২০১৪ সালে শরীফুল ইসলাম যোগ দেন সিআরআরআইপি প্রকল্পে। সেখানে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বাঁধ রক্ষায় ভেটিভার প্রয়োগের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন খুলনা, বরিশাল, বাগেরহাটসহ ১২টি জেলায়। এ ছাড়া হাওর এলাকাতেও বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। 

২০১৫ সালে ভারতের আসাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড় এবং মাসুলি দ্বীপের পাড় রক্ষার কাজে শরীফুল ইসলামের পরামর্শ নিয়েছে। ব্রাজিলের দুই প্রকৌশলী সেখানকার এক শহরে বাঁধ রক্ষার জন্য তাঁর কৌশল ব্যবহার করে এই ভেটিভার প্রয়োগ করেছেন। 

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পাহাড়ধস ঠেকাতে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে বড় পরিসরে এই ভেটিভার লাগানোর কাজ শুরু করা হয়েছিল। এখন কী অবস্থা জানা নেই।

Post a Comment

0 Comments