সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সাইজে ছোট হলেও ব্ল্যাক বেঙ্গল কেন বিশ্ব সেরা

why black bengal goat best
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল


দেশের ছাগল খামারি একটা সাধারণ ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে যে, খামারে তিন চার ফুট উচ্চতার, বিশাল কানওয়ালা ছাগল থাকবেই। কুরবানির সময় একেকটা ছাগল লাখ টাকার ওপরে বিক্রি হওয়ার কথা শোনা যায়। খামারি সারা বছর এসব ছাগল পেলে পুষে ওই ঈদের সময় বিক্রি করেন।

এসব ছাগল কিন্তু বছরে একবার বাচ্চা দেয়। আবার একবারে সাধারণত একটার বেশি বাচ্চা দেয় না। অথচ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বছরে দুইবার, একবারে কমপক্ষে দুটি করে বাচ্চা দেয়। এরপরও আকারে ছোট হওয়ার কারণে খামারিরা এই দেশীয় জাতের ছাগল পালন করতে চান না।

অথচ একমাত্র এই ছাগলের কল্যাণেই ছাগল পালনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। বিশ্ববাজারে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া 'কুষ্টিয়া গ্রেড' নামে পরিচিত। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও এবং আন্তর্জাতিক আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের (আইএইএ) মূল্যায়ন মোতাবেক, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। তারা ১০ বছর ধরে গবেষণা করে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে এই মুহূর্তে আড়াই কোটির বেশি বিভিন্ন জাতের ছাগল আছে। এর ৯৫ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল। দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ ছাগল পালন করেন। গৃহপালিত একক কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে এটা রেকর্ড।

বিশ্বের হাতে গোনা যে চার থেকে পাঁচটি ছাগলের জাতের এখনো সংকরায়ণ হয়নি, স্বতন্ত্র জাত হিসেবে টিকে আছে, তার অন্যতম ব্ল্যাক বেঙ্গল। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই জাতটি টিকিয়ে রেখেছেন মূলত গ্রামের সাধারণ মানুষ। 

খামারি বলেন, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বছরে চারটা করে বাচ্চা দেয়। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এদের ছয় থেকে আট হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। এরা বাড়ির আশপাশের গাছের পাতা, সবজির বর্জ্য খেয়েই বড় হয়। মাসে ৫০ থেকে ১০০ টাকার ঘাস কিনতে হয়। তাই এদের পালতে বাড়তি কোনো চাপও পড়ে না।  

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, সারা দেশের ঘরে ঘরে পালিত ছাগলের সংখ্যা ২ কোটি ৫৪ লাখ ৩৩ হাজার। দেশের প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি ছাগল পালিত হচ্ছে। তবে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলায় বেশি পালিত হয়। 

বাংলাদেশের নিজস্ব এই জাতটির জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং ডিএনএ পরীক্ষা করে দীর্ঘ নয় বছর গবেষণা করেছে জাতিসংঘের আণবিক শক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। 

২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংস্থা দুটি বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপরে গবেষণা করে ব্ল্যাক বেঙ্গলকে অন্যতম সেরা জাত হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এফএও এবং আইএইএর ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা বলেন, অন্য ৯৯টি জাতের সব ধরনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলই সবার সেরা। (সূত্র: প্রথম আলো)  

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে ২০ বছর ধরে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘তুলনা করে দেখা গেছে, অন্যান্য জাতের ছাগলের চেয়ে এর মাংসের স্বাদ ভালো। এ কারণে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা বেশি। এর চামড়া এত উন্নতমানের যে বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া ব্যবহৃত হয়।’ (সূত্র: প্রথম আলো)

যেসব কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গল সেরা
বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রাণিবিদ্যাবিষয়ক স্বীকৃত জার্নালগুলোতে ব্ল্যাক বেঙ্গল নিয়ে শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই গবেষণার মাঝ পর্যায়ে ২০০৭ সালের ২০ মার্চ জাতিসংঘের সংবাদ সংস্থা ইউএন নিউজ-এ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। কিন্তু এখানেই রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাণিসম্পদ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বসতি।’ ওই বছরই আইএইএর ওয়েবসাইটে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বিশ্বসেরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।  

গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের এই ছাগলের নবজাতকের মৃত্যুহার কম। আর এরা বছরে দুবারে কমপক্ষে চারটি বাচ্চা দেয়। তাই অন্য জাতগুলোর তুলনায় এই জাতের ছাগলের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, এটি পালন করতে বড় চারণভূমি লাগে না। বাড়ির উঠান বা রান্নাঘরের পাশের ছোট্ট স্থানেও এরা দিব্যি বেড়ে ওঠে।  

তবে এফএওর গবেষণা মোতাবেক, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দুর্বল দিক এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-ওজন এবং দুধের পরিমাণ অন্যান্য ছাগলের চেয়ে কম। আফ্রিকার মাসাই ছাগল, ভারতের যমুনাপাড়ি ছাগল এবং চীনা জাতের ছাগলের মাংস ও দুধের পরিমাণ ব্ল্যাক বেঙ্গলের চেয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি।

কিন্তু ওইসব 'উন্নত জাতের' ছাগলের ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাচ্চা জন্মের পরই মারা যায়। কিন্তু ব্ল্যাক বেঙ্গলের বাচ্চার মৃত্যুর হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এ কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গলের জীবনচক্রে মোট বংশবৃদ্ধির হার অনেক বেশি। 

এসব কারণেই বিজ্ঞানীরা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার বিচারে ব্ল্যাক বেঙ্গলকে সেরা জাত হিসেবে নির্বাচন করেছেন। 

Post a Comment

0 Comments