ছাগলের খামার লাভজনক করতে হলে উদ্দেশ্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট জাত বাছাই গুরুত্বপূর্ণ। কম সময়ে কম বিনিয়োগে দ্রুত আয় করতে চাইলে যেমন দেশি জাত বেছে নেওয়া ভালো, তেমনি সময় নিয়ে বেশি বিনিয়োগ করে মোটা অংকের মুনাফা করতে চাইলে দরকার কিছু বিদেশি জাত।
আবার বিদেশি জাতের কোনো ছাগল বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে সেটিও বিবেচনা করা দরকার। নিচে কয়েকটি জাতের বর্ণনা দেওয়া হলো, এগুলো এখন পর্যন্ত দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল
এটিই বাংলাদেশের একমাত্র জাত। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে এ জাতের ছাগলের দেখা যায় ।
সাধারণত বৈশিষ্ট্য
গায়ের রঙ কালো, তবে সাদা, সাদা-কালো, খয়েরি-কালো, খয়েরি ইত্যাদি হতে পারে । শরীরের আকার ছোট। গায়ের লোম মসৃণ ও ছোট । এদের কান ও শিং ছোট এবং ছাগীর তুলনায় পাঁঠার শিং তুলনামূলক বড় ।
দুধ উৎপাদন
সাধারণত এ জাতের ছাগী দৈনিক ২০০-৩০০ মিলি লিটার দুধ দেয়। তবে উপযুক্ত খাদ্য ও উন্নত ব্যবস্থাপনায় ছাগী দৈনিক ১ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। এদের দুগ্ধ প্রদান কাল সাধারণত ২-৩ মাস।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল |
ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের ড্রেসিং হার শতকরা ৪৫-৪৭ভাগ । কিন্তু খাদ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য মাংসের পরিমাণ মোট ওজনের প্রায় ৫৫ ভাগ। এই জাতের ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু ।
বাচ্চা উৎপাদন
সাধারণত ১২-১৫মাস বয়সেই ছাগী প্রথম বাচ্চা দেয়। প্রথমবার শতকরা ৮০ ভাগ ছাগী একটি করে বাচ্চা দেয় । তবে দ্বিতীয়বার থেকে অধিকাংশ ছাগী দুটি করে বাচ্চা দিয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩/৪টি করে বাচ্চা পাওয়া যায়। ছয় মাস পরপর বাচ্চা দেয়। এ জাতের ছাগলের চামড়া বেশ উন্নত ও বিশ্বখ্যাত।
যমুনাপাড়ী
ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের এটোয়া জেলায় যমুনাপাড়ী ছাগলের উৎপত্তিস্থল। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় এ জাতের ছাগল পাওয়া যায়। এদের শরীরের রঙ সাদা, কালো , হলুদ-বাদামী বা বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ হতে পারে।
কান লম্বা, ঝুলানো ও বাঁকা। পা খুব লম্বা এবং পেছনের পায়ের পেছন দিকে লম্বা লোম আছে। এরা অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু ও চঞ্চল।
যমুনাপাড়ী ছাগল |
একটি পূর্ণবয়স্ক পাঁঠার ওজন ৬০-৯০ কেজি এবং ছাগীর ওজন ৪০-৬০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
দৈনিক দুধ উৎপাদন ৩-৪ লিটার।
এ জাতের ছাগল বছরে একবার একটি করে বাচ্চা দেয়।
বারবারি ছাগল
বারবারি জাতের ছাগল মাঝারি আকারের। তবে দুনিয়াজুড়ে এরা নান্দনিক সৌন্দর্য্য, অধিক উৎপাদনশীলতা, সুস্বাদু মাংস ও দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বিখ্যাত। মুখটা চিকন ও হরিণের মতো মায়াবী, পা দুটোও হরিণের মতো।
বারবারি ছাগলের অতি দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে এবং এক বছর (১২ মাস) থেকে ১৪ মাসের মধ্যে এই ছাগল দুইবার বাচ্চা প্রসব করে। এ জাতের ছাগী প্রতিবারে দুই থেকে তিনটি বাচ্চা জন্ম দেয়।
এই জাতের ছাগল মূলত ভারতের হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে পাওয়া যায়।
খামার করার জন্য বারবারি ছাগল অত্যন্ত উপযোগী। এই জাতের ছাগলের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা অনেক বেশি। এরা শুকনো খাবার খেয়ে বা দেশি ছাগলের মতোই মাঠে চরে খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
বারবারি ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু। ভারতে এই ছাগল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
বৈশিষ্ট্য
বারবারি ছাগলের আকার মাঝারি ধরনের। এরা দেখতে খুবই আকর্ষণীয় এবং সদা সতর্ক অবস্থায় থকে। এদের কান খাড়া এবং পাঁঠার মুখে ঘন দাঁড়ি থাকে। পাঁঠা ও পাঁঠির মোড়ানো শিং থাকে যেটা উপরে বা পেছনে খাড়া থাকে এবং দৈর্ঘ্যে মধ্যম আকারের হয়ে থাকে।
বারবারি ছাগল |
বারবারি ছাগলের লোমের রঙে অনেক বেশি বৈচিত্র্য থাকে। তবে সাধারণত সাদার ওপর হালকা বাদামী ছোপ ছোপ বর্ণের হয়ে থাকে।
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ছাগলের ওজন প্রায় ৪০-৪৫ কেজি ও স্ত্রী ছাগলের ওজন প্রায় ২৫-৩০ কেজি হয়ে থাকে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য
বারবারি ছাগল সুস্বাদু মাংস এবং প্রতিবার তিনটি করে বাচ্চা দেওয়ার জন্য বিখ্যাত। এই জাতের ছাগল দ্রুত প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে এবং এই জাতের ছাগলের সাধারণত রোগব্যাধী কম হয়।
বারবারি ছাগল বাঁধা অবস্থায় স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে পালন করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জাত। এরা বেশ ভালো পরিমাণে দুধ দেয় এবং এদের উর্বরতা অনেক বেশি। মাংস উৎপাদনের জন্য পুরুষ ছাগলকে খুব অল্প বয়সেই খোঁজা/খাসি করে দেওয়া হয়।
বোয়ার ছাগল
এই জাতটি সারা পৃথিবীতে খুব জনপ্রিয় হয়েছে মাংস উৎপাদনের জন্য। যে কোনো পরিবেশ খুব দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। এদের প্রতিদিন ২৫০ গ্রাম পৰ্যন্ত ওজন বাড়ে। এই ছাগল তিন মাসেই ৩০ থেকে ৩৬ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। খুব বাজে খাবার ব্যবস্থার মধ্যেও তিন মাসে এদের ১৫ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়ে থাকে।
বোয়ার ছাগল |
বারবারি ছাগল খুব দ্রুত বয়োপ্রাপ্ত হয়। প্রতিবার দুই থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। ২টি বাচ্চা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
ব্রাউন বেঙ্গল ছাগল
বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল এরই মধ্যে বিশ্বসেরা স্বীকৃতি পেয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে এ জাতের ছাগল পালন খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। একই প্রজাতির পাহাড়ি ভ্যারাইটি হচ্ছে ব্রাউন বেঙ্গল।
ব্রাউন বেঙ্গল ছাগলের মাংস তুলনামূলক বেশি স্বাদযুক্ত, চামড়াও উন্নতমানের।
ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ ব্রাউন বেঙ্গল ছাগল পালন করলেও লাভের আশায় অন্য জাতের সঙ্গে সংকরায়ন খুব একটা করে না। ফলে বিশ্বের হাতে গোনা যে চার-পাঁচটি ছাগলের জাত স্বতন্ত্র হিসেবে টিকে আছে, তার মধ্যে ব্রাউন বেঙ্গল অন্যতম।
ব্রাউন বেঙ্গল ছাগল |
ব্রাউন বেঙ্গল জাতের ছাগল ব্ল্যাক বেঙ্গলের মতোই বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। তাই খামারে দ্রুত সংখ্যা বাড়ে। এটি পালন করতে বড় চারণভূমি লাগে না। নিয়ম মেনে টিকা প্রয়োগ করা হলে রোগবালাই কম হয়।
অর্থাৎ ব্রাউন বেঙ্গল ব্ল্যাক বেঙ্গল ভ্যারাইটির দেশী ছাগল। পার্থক্য বলতে এগুলোর পা কিছুটা খাটো। ব্রাউন বেঙ্গল পার্বত্যাঞ্চলের আবহাওয়ার জন্য উপযোগী।
আরও পড়ুন:
এক নজরে ছাগলের সাধারণ রোগ ও চিকিৎসা
0 Comments