সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ধানের ক্ষেতে রিলে ফসল হিসেবে খেসারি চাষ


ডালের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা এবং সহজে চাষযোগ্য হলো খেসারি। এর বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাথাইরাস স্যাটিভাস। বিষাক্ত এক উপাদানের কারণে ল্যাথারিজম নামের রোগ হয় এমন ধারণার কারণে খেসারির ডালের বদনাম আছে। তবে ডালশস্যের মধ্যে খেসারি সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু ফসল। ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা যেমন আছে, তেমনই খরা ও অতিরিক্ত পানি জমাও সহ্য করতে পারে। খরাতেও টিকে যায়। এ কারণেই ভারতবর্ষে এটি দুর্ভিক্ষের ফসল নামে পরিচিত।

যদিও সস্তার এই ডাল খাদ্যগুণে ভরপুর। শুকনো ডালে ৩১.৯ শতাংশ প্রোটিন (আমিষ), ৫৩.৯ শতাংশ শর্করা ও ০.৯ শতাংশ তেল/চর্বি থাকে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও ভিটামিন রয়েছে।

খেসারির ডালে রয়েছে এক ধরনের স্নায়ুবিষ। বিটা এন অক্সালিল অ্যামাইনো অ্যালানাইন (BOAA) বা সংক্ষেপে বোয়া অস্থিবিষ বিটা অ্যামাইনো প্রোপিটনাইট্রিল মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর। কারো দৈনিক খাবারের ৩০ শতাংশই খেসারির ডাল বা খেসারি দিয়ে জানানো কোনো খাদ্যসামগ্রী থাকে এবং সেটা যদি টানা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে খাওয়া হয় তাহলে বোয়ার কারণে হতে পারে ল্যাথাইরিজম। এ রোগ হলে শরীরের কোনো অঙ্গ অকেজো হয়ে যায়।

তবে, বোয়া পানিতে দ্রবণীয়। তাই ধানের মতো এক রাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন ভাপিয়ে এরপর রোদে শুকিয়ে যেভাবে চাল করা হয়, খেসারির ডালও সেরকম করলে সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়।

কিন্তু খেসারি ডাল তখনই বিষক্রিয়া তৈরি করে যখন বীজে বোয়ার পরিমাণ থাকে ০.২ শতাংশের বেশি থাকে। খেসারির বীজে সাধারণত ০.১-২.৫ শতাংশ বোয়া থাকে। ০.২ শতাংশের কম হলে খেসারির ডাল নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়। দেশী জাতগুলোতে বোয়ার মাত্রা খুব বেশি। তাই সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিয়ে খাওয়াই ভালো। 

জমি নির্বাচন

দো-আঁশ এবং এঁটেল মাটিতে খেসারি ভালো হয়। তবে সব ধরনের মাটিতেই এ ডাল চাষ করা যায়। তবে এঁটেল মাটিই এই খেসারি চাষের উপযুক্ত। এই ডালের লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতাও অনেক বেশি।

জাত নির্বাচন

যে কোনো ফসল চাষের আগে খুব ভেবে চিন্তে খোঁজখবর নিয়ে জাত নির্বাচন করা উচিত। কারণ কিছু জাতের ফলন বেশি, আবার কোনো জাতের বিশেষ কোনো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, আবার কোনো জাতের নির্দিষ্ট বিরূপ আবহাওয়া সহ্য করার ক্ষমতা।

বারি খেসারি-১

স্থানীয় জাতের তুলনায় ৪০% পর্যন্ত বেশি ফলন দেয়। এ জাতের গাছ গাঢ় সবুজ এবং প্রচুর শাখা-প্রশাখা হয়ে থাকে। বারি খেসারি-১ জাতের হাজার বীজের ওজন ৪৮-৫২ গ্রাম। ফসল পাকতে ১২৫-১৩০ দিন সময় লাগে। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৪-১.৬ টন। অর্থাৎ বিঘাপ্রতি ৪.৭-৫ মণ। (১ হেক্টর= ৭.৫ বিঘা)। এ জাত পাউডারি ও ডাউনি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধী।

বারি খেসারি-২

গাছের উচ্চতা ৫৫-৬০ সেমি। পাতা স্থানীয় জাতের তুলনায় বেশি চওড়া। ফুলের রং নীল। বীজ একটু বড়, হাজার বীজের ওজন ৫০-৫৫ গ্রাম। বীজের রং হালকা ধূসর। আমিষের পরিমাণ ২৪-২৬%। বীজ বপন থেকে ফসল পাকা পর্যন্ত ১২৫-১৩০ দিন সময় লাগে। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৫-২ টন। 

রিলে ফসল

রিলে ফসল হিসেবে আমন ধানের জমিতে খেসারি চাষ করা যায়। এটিকে পয়রা চাষও বলে। আমন ধান কাটার সপ্তাহ দুয়েক আগে জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা অবস্থায় বীজ ছিটিয়ে বুনতে হবে। তবে কখনোই কাদা থাকা অবস্থাতে নয়।

মাঠের পাকা ধান কাটার ১০-১২ দিন আগে জমিতে ছড়িয়ে দিলে অথাৎ রিলে ফসল হিসেবে চাষ করলে খেসারির বীজ লাগবে বিঘাপ্রতি ১৫-১৬ কেজি। উল্লেখ্য, খেসারির মতো মসুর, সরিষাও এভাবে বুনে চাষ করা যায়। 

রিলে ফসলের ক্ষেত্রে আমন ধানের পরিপক্বতাকাল এবং জমির রসের পরিমাণের উপর খেসারির বীজ বপনের সময় নির্ভর করে। এক্ষেত্রে কার্তিক মাস থেকে মধ্য-অগ্রহায়ণ (মধ্য-অক্টোবর থেকে নভেম্বর) পর্যন্ত বীজ বপন করতে হবে। 

পয়রা ফসলে বীজ বোনার ৩০-৪৫ দিনের মাথায় ২ শতাংশ ডিএপি দ্রবণ (এক লিটার পানিতে ২০ গ্রাম) স্প্রে করতে পারলে ভালো হয়। সার এক রাত ভিজিয়ে রাখলে আরো ভালো। ফুল আসার সময় ২ শতাংশ ইউরিয়া দ্রবণ (এক লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া) গাছে স্প্রে করলে ফলন বাড়ে।

সাধারণত জমির মাটিতে থেকে যাওয়া রসেই খেসারি চাষ হয়ে যায়। তবে ৬০-৭০ দিনের মাথায় একবার সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে ফলন বেশ বাড়ে।

একক ফসল হিসেবে আবাদ

একক ফসল হিসেবে আবাদ করতে চাইলে  মধ্য-কার্তিক থেকে মধ্য-অগ্রহায়ণ (নভেম্বর) মাসে জমিতে ৩-৪ টি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে।  বীজ ছিটিয়ে বপন করা যায়। তবে সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি রাখা ভালো। তাতে

প্রতি একরে ১৬-১৮ কেজি বীজ লাগে।  আবার ২৫-৩০ সেমি দূরত্বে বীজ বুনলে বীজ লাগে বিঘাপ্রতি ১০-১১ কেজি। বীজ ছিটানোর পর ভালো করে মই দিয়ে জমি সমান করতে হবে। লাঙল দেওয়া জমিতে বীজ বোনার আগে বিঘাপ্রতি ৬-৭ কেজি ডিএপি দিতে পারলে খুব ভালো।

আর জমি যদি অনুর্বর হয় তাহলে একক ফসলের জন্য অনুর্বর জমিতে হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ হারে সার ব্যবহার করতে হবে:

সারের নাম         সারের পরিমাণ/হেক্টর

ইউরিয়া               ৪০-৪৫ কেজি

টিএসপি               ৮০-৮৫ কেজি

এমওপি               ৩০-৪০ কেজি

অণুজীব সার          সুপারিশ মত

সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। আগে খেসারির চাষ না করা জমিতে আবাদের জন্য প্রতি কেজি বীজের সাথে ১০০ গ্রাম হারে অনুমোদিত অণুজীব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। 

পরিচর্যা

বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার করতে পারলে ভালো। বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সেটিকে খেয়াল রাখতে হবে।

রোগবালাই ব্যবস্থাপনা

রোগের নাম: খেসারির ডাউনি মিলডিউ রোগ

ক্ষতির নমুনা: রোগাক্রান্ত খেসারি গাছের পাতা কিছুটা হলদে হয়ে যায়। পাতার নিচে ছত্রাকের অবস্থান খালি চোখেই দেখা যায়। রোগের মাত্রা বেশি হলে পাতা কুঁচকে ও ঝলসে যায়। এ ছত্রাকের জীবাণু মাটিতে ১-২ বৎসর বেঁচে থাকতে পারে।

ব্যবস্থাপনা: রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন বারি খেসারি-১ এবং বারি খেসারি-২ চাষ করতে হবে। রিডোমিল এম জেড (০.২%) ১২ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়।

ফসল সংগ্রহ

ফাল্গুন (মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ) মাসে ফসল সংগ্রহ করা যায়।

বীজ সংরক্ষণ

বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতার পরিমাণ আনুমানিক ১০%-এর নিচে রাখতে হবে। তারপর টিনের পাত্র ও পলিথিনের ব্যাগ বা চটের ব্যাগ অথবা আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। শুধু বীজ হিসেবে রাখার জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

গুদামজাত ব্যবস্থাপনা

গুদামজাত করার আগে দানা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়। ডালের দানা শুকিয়ে পানির পরিমান ১২% এর নিচে আনতে হবে। বীজের জন্য টন প্রতি ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন ১০% গুড়া মিশিয়ে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। ফসটক্সিন ট্যাবলেট ২টি বড়ি প্রতি ১০০ কেজি গুদামজাত ডালে ব্যবহার করতে হয়। এ বড়ি আবদ্ধ পরিবেশে ব্যবহার করতে হয়।

Post a Comment

0 Comments