সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

গভীর বিসিএস স্কোর কী এবং কেন জানা জরুরি?


গরুর দেহের ধরনের স্কোর (Body Condition Score) বা বিসিএস সাধারণ খামারিদের কাছে প্রায় অজানা বা উপেক্ষিত একটি ধারণা। কিন্তু খামারের সব পশুকে সুস্থ ও উৎপাদনশীল রাখতে চাইলে এই স্কোর জানাটা জরুরি। এটি জানা থাকলে বিশেষ করে গাভীর ক্ষেত্রে কখন, কোন পর্যায়ে রেশনের কতোটা পরিবর্তন করা দরকার তা হিসাব করে বের করা যায়। আর স্কোরিংয়ের ভিত্তিতে রেশন নির্ধারণ করার চর্চা ঠিকমতো করতে পারলে গভীর প্রজনন সমস্যা (গর্ভধারণ ইত্যাদি) সহজে এড়ানো যায়।

কেন বড়ি কন্ডিশন স্কোরিং করা হয়?

১. দেহের সঞ্চিত শক্তি (চর্বি) কতদিন ব্যবহার করা যাবে তা জানা যায়।

২. মাংস উৎপাদন ক্ষমতা সম্পর্কে জানা যায়।

৩. প্রজনন ক্ষমতার ভাল বা খারাপ দিক সম্পর্কে জানা যায়।

৪.খাবার রেশনের পুষ্টির ফলাফল ( Outcome ) সম্পর্কে জানা যায়।

৫. কেন দুগ্ধ উৎপাদন ভালো বা খারাপ হচ্ছে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

কীভাবে বডি কন্ডিশন স্কোর (BCS) করতে হয়?

পুষ্টিবিদরা স্কোর ১-৫ করার জন্য চোখ এবং হাতের স্পর্শের সাহায্যে লয়েন, রাম্প এবং লেজের গোড়ায় কতটুকু ফ্যাট আছে তা মূল্যায়ন করে। হুক ও পিনসের মধ্যাকার এবং যে লিগামেন্টগুলো লেজের গোড়া ও স্পাইন থেকে হুক এবং পিন বোনের দিকে গেছে, এসব জায়গায় মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শরীরের ভেতর মোট যে ফ্যাট আছে, তার সমতুল্য ফ্যাট এই জায়গাগুলোতে থাকে। 

বড়ি কন্ডিশন স্কোর (বিসিএস) শরীরের ওজন মাপার চেয়ে কতটুকু সঞ্চিত শক্তি আছে তা মাপা অধিক ভালো। কারণ শরীরে ফ্যাট, ফ্রেম সাইজ, গাট সাইজ এবং ওলানের সাইজের পরিবর্তনে ওজন পরিবর্তন হতে পারে। 

বিভিন্ন বডি কন্ডিশন স্কোরের অর্থ

BCS- 1.5

এই স্কোরের গাভী খুবই পাতলা /হালকা ধরনের (হাড্ডিসার)। এরকম গাভী কম দুধ বা কম বাচ্ছা দিবে। সে সুস্থ কিন্তু স্বাস্থবান না। তার কশেরুকা, বুকের পাঁজর, হুক, পিনস এবং লিগামেন্টস প্রতিটি স্পষ্ট দেখা যায়। কশেরুকার এক-অর্ধাংশ ট্রান্সভার্স প্রসেস দৃশ্যমান। লেজের গোড়ায় এবং রাম্পে খালি গর্ত দেখা যায়। লেজের গোড়া এবং পিনসের(Pin bone) মধ্যেকার চামড়ায় ভাজ দেখা যায়। এই স্কোরের গাভী খামারে থাকতে নেই।

BCS- 2

এই স্কোরের গাভীটি পাতলা / হালকা ধরণের। এরকম গাভী কম দুধ বা কম বাচ্ছা দিবে। সে সুস্থ হতে পারে কিন্তু স্বাস্থবান না। তার স্পাইন এবং ছোট পাজর (short rib) সহজে দেখা যায় কিন্তু কশেরুকা স্পষ্ট দেখা যায় না। ছোট পাজরের উপরের সার্ফেস সহজে অনুভব করা যায়। কশেরুকার  এক-তৃতীয়াংশ ট্রান্সভার্স প্রসেস দৃশ্যমান। হুক (Hook) এবং পিনস দেখা যায়। পিন বোনে (Bone) কোন ফ্যাট অনুভব করা যায় না। লিগামেন্টগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। লেজের গোড়া এবং থার্ল (Thurl) এরিয়াতে গর্ত আছে। লেজের গোড়া এবং পিনসের মধ্যেকার চামড়ায় ভাজ দেখা যায়।

BCS- 2.5

এই স্কোরের গাভীগুলো মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।কোন খামারে বডি কন্ডিশন স্কোর ২.৫ বা এর নিচে যাওয়া উচিত নয়। এই স্কোরটিই কম স্কোরের মধ্যে গ্রহণযোগ্য (lowest acceptable)। এই স্কোরের গাভীগুলোর প্রতিটি কশেরুকা দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। বুকের পাজর গণা যায়। কশেরুকার এক-তৃতীয়াংশ ট্রান্সভার্স প্রসেস দৃশ্যমান। লিগামেন্টস দেখা যায় কিন্তু BCS-2 এর মত না। হুকস এবং পিনসগুলো কৌনিক থাকে কিন্তু পিনসে কিছু ফ্যাট অনুভব করা যায়। লেজের গোড়া এবং থার্ল (Thurl) এরিয়াতে গর্ত থাকে।

BCS- 3

এই স্কোরের গাভীগুলো স্বাস্থ্যবান এবং বেশী দুধ উৎপাদনশীল। কিন্তু, এই স্কোরের গাভী যখন বাচ্ছা প্রসব করে, সে বেশিদিন সঞ্চিত ফ্যাট ব্যবহার করতে পারে না যদি না সে ড্রাই মেটার খাওয়া বৃদ্ধি করে। এই স্কোরের গাভীগুলোর থার্ল এরিয়া "V" এর মত দেখায়। মেরুদন্ড দেখা গেলেও, প্রতিটি কশেরুকা গোলাকার দেখা যায়। বুকের পাজর ০.৫-১ ইঞ্চি মাংস দিয়ে আবৃত থাকে। কশেরুকার ট্রান্সভার্স প্রসেস  অর্ধেকেরও কম দৃশ্যমান। লিগামেন্ট কিছুটা ফ্যাট দিয়ে আবৃত থাকা সত্ত্বেও দৃশ্যমান। হুকস এবং পিনসে কিছুটা ফ্যাট থাকে যা হাতে অনুভব করা যায়। লেজের গোড়ায় গর্ত থাকে কিন্তু কোন চামড়ার ভাজ থাকে না।

BCS- 3.5

প্রসবকালীন গাভী এবং সুষ্ক গাভীর এই স্কোর থাকা উচিত। এই গাভীগুলোর মেরুদন্ডে, বুকের পাজরে, লিগামেন্টে ফ্যাট অনুভব করা যায়। হুক এবং পিনস গোলাকার। কোন একক কশেরুকার ট্রান্সভার্স প্রসেস দেখা যায় না। থার্ল কিছুটা গর্তযুক্ত। কক্কিজিয়াল লিগামেন্ট (লেজের গোড়ায়) তেমন দেখা যায় না কিন্তু  সেক্রাল লিগামেন্ট দেখা যায়। লেজের গোড়ার এরিয়াটা গোলাকার এবং ভর্তি কিন্তু কোন ফ্যাট নেই। 

এই স্কোরটিই অর্জন করতে হবে।

BCS- 4

এই স্কোরের গাভীগুলো বাচ্ছা দেওয়ার সময় কম খাবে, বেশি ওজন হারাবে এবং তাঁদের মেটাবলিক সমস্যা থাকে। এই সব গাভীর মেরুদন্ড এরিয়াটা সমতল থাকে কারণ ফ্যাট জায়গাটা ভরাট করেছে। বুকের পাজর এককভাবে দেখা যায় না আবার খুব কম অনুভব করা যায়। হুকস এবং পিনসে ফ্যাট থাকে এবং তাদের মধ্যকার "U" আকৃতিটা সমতল থাকে যেখানে কোন ডিপ্রেশন পাওয়া যায় না। লিগামেন্ট দেখা যায় না। লেজের গোড়ার এরিয়িটা ফ্যাটে ভর্তি থাকে এবং ফ্যাটের ভাঁজ দেখা যায়।

BCS- 5

এই স্কোরের গাভীগুলো তীব্র ফ্যাটযুক্ত, তাঁদের মেটাবলিক সমস্যা এবং ব্রিডিং সমস্যা থাকে। মেরুদন্ড এবং বুকের পাজর দেখা যায় না এবং কম অনুভব করা যায়। হুকস এবং পিনস, থার্ল এরিয়াটা এবং লেজের গোড়া ফ্যাটে ভর্তি থাকে।


বিসিএস (BCS)  ব্যবস্থাপনা

বাচ্চা প্রসবকালীন, যখন বীজ দেওয়া হয়, যখন গর্ভ চেক করা হয়, মাঝে মাঝে দুগ্ধদানের সর্বশেষ পর্যায় এবং শুষ্ক পর্যায়ে গাভীর বডি কন্ডিশন স্কোর নেওয়া উচিত।

কম্পিউটারে পুষ্টির হিসাব করা রেশনের শক্তিমানের চেয়ে বডি কন্ডিশন স্কোরে প্রাপ্ত পুষ্টির শক্তিমানই বিবেচ্য। কারণ প্রারম্ভিক দুগ্ধদানের সময় (early lactation)  যদি গাভীর দেহ পাতলা হয় ( মেটাবলিক সমস্যার কারণে ওজন কমে যাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত ) তাহলে রেশনের শক্তিমান আরো বাড়িয়ে, ড্রাইমেটার খেতে বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে, যাতে গাভী ৩.৫ স্কোর অর্জন করতে পারে।

দুগ্ধদানের শেষ পর্যায়ের গাভী খাবার থেকে প্রাপ্ত শক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে যা শুষ্ক গাভী পারে না। এই জন্য শুষ্ক অবস্থায় বডি কন্ডিশন স্কোর ৩.৫ উঠানোর চেয়ে দুগ্ধদানের মাঝমাঝি থেকে শেষ পর্যায়ের (৭৫ থেকে ১০০ তম দিন ) মধ্যে গাভীকে ৩.৫ বডি কন্ডিশন স্কোর অর্জন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। 

আর দুগ্ধদানকালীন শেষ পর্যায়ে গাভীর দেহ যদি মোটা হয়, তাহলে যতদ্রুত সম্ভব বেশি শক্তিমানের রেশন বাদ দিয়ে কম শক্তিমানের রেশন সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার পরিবেশন করতে হবে, যাতে স্কোর ৩.৫ এর উপর না উঠে।

উন্নত খামারে গাভীগুলোকে বিভিন্ন গ্রুপ আকারে খাওয়ানো হয় যেমনঃ শুষ্ক পর্যায়ের গাভী, প্রারম্ভিক দুগ্ধদানকালীন গাভী, মাঝ পর্যায়ের দুগ্ধদানকালীন গাভী,শেষ পর্যায়ের দুগ্ধদানকালীন গাভী, ইত্যাদি। যখন গাভীগুলোকে গ্রুপ আকারে খাওয়ানো হয় তখন একটা গ্রুপের সবগুলো গাভীর বডি কন্ডিশন স্কোর সমান হওয়া প্রয়োজন। যদি না হয় তাহলে বুঝতে নিচের সমস্যাগুলোর কোনো একটি বা একাধিক সমস্যা হচ্ছে:

১. সম্ভবত কিছু গাভী মেটাবলিক (হজম) সমস্যায় ভুগছে যার কারণে দুগ্ধদানের সময় ড্রাইমেটার খাওয়া কম হচ্ছে।

২. কিছু গাভী খুরের সমস্যায় ভুগছে যার কারণে আক্রান্ত গাভী খাবার ট্রেতে আসতে পারছে না।

৩. হয়তো TMR ঠিকভাবে বানানো হচ্ছে না, উদাহরণস্বরুপঃ ঘাস গুলো TMR এর সাথে না দিয়ে যদি আলাদা খাওয়ানো হয়।

৪. ভুলক্রমে গ্রুপের পরিবর্তন ঘটলে।

একটা গ্রুপের স্কোর যদি সমান না হয় তাহলে সে গ্রুপে সঠিক রেশন বানানো বা পরিবেশন করা কঠিন কারণ তখন একই গ্রুপের কিছু গাভী সরবরাহকৃত রেশনে স্বাস্থবান হবে আর কিছু গাভী দুর্বল হবে।

প্রারম্ভিক দুগ্ধদানকালীন পর্যায় (Early Lactation Period)

আমরা সবাই জানি যে, একটি সর্বোচ্ছ দুগ্ধদানকারী গাভী তার দুগ্ধদানের প্রাথমিক পর্যায়ে দুধ উৎপাদন করার জন্য যে সঞ্চিত শক্তি ব্যবহার করে তার প্রয়োজনীয় অংশ আসে দেহের সঞ্চিত চর্বি থেকে। তাই ৪৫ গ্রাম মবিলাইজড ফ্যাট ৩ কেজি দুধ উৎপাদনে সাহায্য করে। আর এই কারণেই দুগ্ধদানের প্রথম ১০০ দিন প্রতিদিন ০.৫ কেজি করে ওজন হারানো স্বাভাবিক। তাই বিভিন্ন পশু পালে দুধের মাধ্যমে ৩০ দিনে বডি কন্ডিশন স্কোর ০.৫ পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একটা খামারে সেই সময় স্কোর ০.৫ এর বেশি কমে যাওয়া ভাল লক্ষণ নয়। দুগ্ধদানের প্রথম ৩০ দিনে গাভীর স্কোর ১ পয়েন্ট কমে যাওয়া গাভীর জন্য সংকটাপূর্ণ। যেসব গাভীর অতিরিক্ত স্কোর কমে যায় সেসব গাভী অনিয়মিত হিটে আসে, প্রথম ডিম্বস্ফূটন দেরিতে হয় এবং কনসিভ করতে ব্যর্থ হয়। এই গাভীগুলো খামারে কম স্থিতিশীল হয়।

সাধারণত যেসব গাভীর বডি কন্ডিশন স্কোর বাছুর দেওয়ার ২ সপ্তাহ পূর্বে ৩.৭৫-এর ওপর থাকে সেসব গাভীর স্কোর কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাচ্ছা দেওয়ার পর সেসব গাভী কম খায়, খাবারে ডিপ্রেশন হয়, ফ্যাটি লিবার ও কিটোসিস রোগ হয়, উচ্চমাত্রায় নন-এস্টারিফাইড ফ্যাটি এসিড (NEFA) থাকে, প্রসব এবং প্রজনন অঙ্গে সমস্যা হয়। যদি একটা গাভী বাচ্চা দেওয়ার ২ সপ্তাহ পূর্বে এবং পরে, এই সময়ের মধ্যে সঞ্চিত ফ্যাট হারায়, লিভার সেই ফ্যাট গ্রহণ এবং প্রসেস করার ফলে কিটোসিস এবং ফ্যাটি লিভার রোগ হয়। মিচিগানের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, যেসব শুষ্ক গাভীর স্কোর ৪ এর নিচে এবং ৪ এর উপরে তাদের মধ্যে  ৮% এবং ১৭% এরমত স্বাস্থ সমস্যা ছিলো। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব গাভীর স্কোর ৪ বা তারও বেশি ছিলো তারা ২.৫ গুণের বেশি প্রজনন সমস্যায় ভুগতো।

শুষ্ক পর্যায় (Dry period)

ফ্যাটি লিভার রোগ হওয়ার ভয়ে গাভীর খাবার কমিয়ে দেওয়া উচিত নয়। যদিও গাভীর প্রসবকালীন বডি কন্ডিশন স্কোর ৩.৫ অর্জন করার জন্য খাবার কমিয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এটি উপযোগী নয় কারণ শুষ্ক পর্যায়ে গাভীর বডি কন্ডিশনকে অগ্রাহ্য করে ওজন বৃদ্ধি করানো উচিত। কারণ যে বাচ্চাটা গর্ভে আছে তার প্রতিদিন ৪৫-৬৮ গ্রাম করে ওজন বাড়ছে।

Post a Comment

0 Comments