সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

গরুর হিটে না আসা এবং গর্ভধারণ না করার কারণ ও সমাধান

why cow does not become heat
গাভী বা বকনার হিটে আসার লক্ষণ

কর্ষণ ডটকম: ডেইরি বা দুগ্ধ খামারিদের একটা সাধারণ সমস্যা হচ্ছে গাভী সময়মতো হিটে আসে না। বা স্বাস্থ্যবতী বকনা গরুও অনেক অপেক্ষার পরও হিটে আসছে না। আবার হিটে আসছে তো বীজ দিলেও কাজ হচ্ছে না। এখন একটি বাণিজ্যিক খামারে সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে যদি গাভী একটি করে বাচ্চা না দেয় তাহলে দ্রুত সেই খামার লাটে উঠবে! ফলে এই সমস্যাটি নিয়ে আমাদের দেশের প্রচুর খামারিকে ভুগতে হয়। 

গরুর হিটে আসার বয়স ও সময়
গরু সাধারণত ১৭-২৪ মাস বয়সে প্রথম হিটে আসে। আর বাছুর প্রসবের ৪ সপ্তাহ পর থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যেই আবার হিটে আসার কথা। অবশ্য প্রথম বিয়ানের (বাছুর প্রসব) ক্ষেত্রে আরেকটু বেশি সময় নিতে পারে। ৬-৯ সপ্তাহের মধ্যে গরু গর্ভধারণ করাটা সবচেয়ে ভালো। সুস্বাস্থ্যে লক্ষণ এবং খামারির জন্যও আনন্দের বিষয়।

তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু বিলম্ব হতে পারে। তাতে খুব চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ৯০-১০০ দিনের মধ্যেও যদি হিটে না আসে বা হিটে আসার পর বীজ দিলেও গর্ভধারণ না করে তাহলে বুঝতে হবে কোনো সমস্যা আছে।

কী কী কারণে গরু উপযুক্ত বয়স ও সময়ে ডাকে বা হিটে আসে না এবং/অথবা গর্ভধারণ করে না তা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।  অবশ্য এরপরেই কিছু বিষয় আলোচনার বাইরে থেকে যাবে। কারণ মানুষের মতোই গরুর প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টিও বেশ জটিল। তবে মোটামুটি আমরা ধরে নিতে পারি এসব বিষয়ে খাটতি থাকলে গরু সময়মতো হিটে আসবে না বীজ (সিমেন) দিলেও গর্ভধারণ করবে না। 

ক. পুষ্টি সংক্রান্ত
খ. সিমেন বা বীজ সংক্রান্ত
গ. রোগব্যাধি সংক্রান্ত
ঘ. পরিবেশ সংক্রান্ত

পুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা
বাংলাদেশে গবাদিপশুর বাণিজ্যিক খামারের ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়, বড় জোর ৫০ বছর! এর আগের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে পাবনা সিরাজগঞ্জ এলাকায় দুগ্ধ উৎপাদনে যা উদ্যোগ নেওযা হয়েছিল সেটি মোটেও বাণিজ্যিক দুগ্ধখামার নয়, বড় জোর জাত উন্নয়নের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। পরে জিয়াউর রহমান সরকারের সময় সরকারিভাবে বীজ বা সিমেন আমদানি করে যখন জাত উন্নয়নের ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন অনেকেই বাণিজ্যিক খামারে উৎসাহিত হতে থাকেন। এরে আগে মানুষ বাথানে, মাঠে, চারণভূমিতে ছেড়ে দিয়ে দেশী গরু পালন করতেন। এবং সেটি শুধু পরিবারের দুধে চাহিদা মেটাতে এবং হালচাষ করতে। বলতে গেলে গরু ওই মাঠের ঘাস আর বিলের পানির ওপরই নির্ভর করতো। এ কারণে বাণিজ্যিক খামারে গরুর জন্য যে পুষ্টির প্রয়োজন সে সম্পর্কে মানুষের ধারণাই তৈরি হয়নি।

বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গরু হিটে না আসা এবং গর্ভধারণ না করার জন্য যতগুলো কারণ আছে এর মধ্যে ৮০%-ই পুষ্টি সংক্রান্ত। কারণ অনভিজ্ঞতা বা অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে খাবারের গুণগতমান কেউই পরীক্ষা করে না বা ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া সবাই ইচ্ছা মাফিক বা অনুমাননির্ভর খাবার দেন। অনেকেরেই ধারণা নেই যে কোন বয়সে কোন সময়ে একটি গরুর কোন কোন পুষ্টি উপাদান কতোখানি প্রয়োজন। খামার ব্যর্থ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো সঠিক পরিমাণে না খাওয়ানো। ফলে গরুকে সুস্থ রাখতে এবং পাশাপাশি তার প্রজনন স্বাস্থ্যও ঠিক রাখতে রেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিচে রেশন সংক্রান্ত বিষয়গুলো আলোচনা করা হল:

১. প্রোটিন বা আমিষ
রেশনে প্রয়োজনীয় পরিমাণে প্রোটিন না থাকলে যেকোনো প্রাণিরই প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা সৃষ্টি হয়। দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণের জন্য প্রোটিন আবশ্যক। ফলে গাভী হোক আর ষাঁড় হোক তাকে প্রচুর আমিষসমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে
তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে যেন কমপক্ষে ৩৫-৪০% রুমেন আনডিগ্রেডেবল প্রোটিন (RUP) থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে প্রজননে সমস্যা দেখা দিবে।

প্রোটিন নিয়ে কিছু কথা
উপরে রুমেন আন-ডিগ্রেডেবল প্রোটিন বা আরইউপি বলে এক ধরনের প্রোটিনের কথা বলা হয়েছে। তার মানে বুঝতেই পারছেন গরুর জন্য দুই ধরনের প্রোটিনের দরকার। আরেক প্রকার হলো রুমেন ডিগ্রেপেবল প্রোটিন বা আরডিপি। আর আরইউপি হলো সেই ধরনের প্রোটিন যা গরুর রুমেনের মধ্যে হজম হয় না বা ভেঙে যায় না। এটি অক্ষত অবস্থায় রুমেন থেকে ক্ষুদ্রান্তে চলে যায় এবং সেখানে সরাসরি শোষিত হয়। এই প্রোটিনের শোষণমাত্রা ৮৫%! বুঝতেই পারছেন প্রোটিনের সবচেয়ে কাযকর ব্যবহার চাইলে আরইউপির ওপর গুরুত্ব দিতেই হবে। এই ধরনের প্রোটিন পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের খৈলের মধ্যে। যেমন: সূর্যমুখীর খৈল (মিল), সরিষার খৈল, সয়াবিনের খৈল, তুলাবীজের খৈল, ফিশ মিল ও বন মিল ইত্যাদি।

আর রুমেন ডিগ্রেডেবল প্রোটিন হজম হয় গরুর রুমেনেই। সেখানে বিদ্যমান মাইক্রোবগুলো (অণুজীব, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া) এই প্রোটিন জাতীয় খাবার বিপাকের মাধ্যমে মাইক্রোবিয়াল প্রোটিন তৈরি করে। তবে এই কাজ করতে গিয়ে ব্যাকটেরিয়াগুলোকে কিন্তু অনেক শক্তি খরচ করতে হয়। সে কারণে এই প্রোটিনের সঙ্গে পরিমিত ননফাইবার কার্বোহাইড্রেড যেমন: স্টার্চ জাতীয় খাবার (গম, ভুট্টা ইত্যাদি) এবং সুগার (চিনি জাতীয় যেমন: ঝোলাগুড় বা চিটাগুড়) দিতে হবে। আরডিপির উৎসগুলো হাতের নাগালেই থাকে। যেমন: জার্মান, নেপিয়ার বা পাকচংয়ের মতো উন্নতজাতের ঘাসে প্রচুর পরিমানে আরডিপি পাওয়া যায়।

২. এনার্জি বা শক্তি
আপনার গরুর প্রয়োজনীয় শক্তির সরবরাহ করতে হবে যেমন- মেইনটেন্যান্স শক্তি, দুধের জন্য শক্তি, শারীরিক বৃদ্ধির জন্য শক্তি। প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান না দিলে গরুর শরীরে জমানো ফ্যাট ও ফ্যাটি এসিড ভেঙ্গে শক্তির চাহিদা পূরণ করে। এ অবস্থাকে নেগেটিভ এনার্জি ব্যালেন্স বলে। এই অবস্থায় গরু ডাকে আসে না বা গর্ভধারণ করে না। এটির জন্য দিতে কার্বোহাইড্রেড জাতীয় খাবার। সেটি হতে পারে গম, ভুট্টা, ঘাস, চিটাগুড় ইত্যাদি।

৩. ফসফরাস
খাদ্য সংক্রান্ত যতগুলো সমস্যা আছে এর মধ্যে ফসফরাসের ঘাটতি বা আধিক্য হলো অন্যতম। ফসফরাসের অভাবে গরুর চিরতরে গর্ভধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তেমনি শরীরে মাত্রাতিরিক্ত ফসফরাসের কারণে গরুর ডাকে আসা ও গর্ভধারণ বিলম্ব হতে পারে।

৪. কিটোসিস
গরুর গর্ভকালীন শেষ দুই মাস সবচেয়ে বেশি শক্তি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস সহ বিভিন্ন মিনারেল ও ভিটামিনের দরকার হয়। এবং বাছুর প্রসবের ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ দুধ দেয়া শুরু করে। কিন্তু সর্বোচ্চ দুধ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ খাদ্যগ্রহণ প্রয়োজন, গরুর শারীরিক অবস্থা সে পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে কমপক্ষে ১০-১২ সপ্তাহ সময় লাগে। এই অবস্থায় গরু তার লিভারের মধ্যে শরীরে জমাকৃত ফ্যাটি এসিড ভেঙ্গে কিটোন বডি (Ketone Bodies) নামক তিন ধরনের কেমিক্যাল (রাসায়নিক): অ্যাসিটোঅ্যাসিটেট, বেটা-হাইড্রোক্সি বিউটারেট এবং অ্যাসিটোঅ্যাসিটেট ক্রমাগম ভেঙ্গে অ্যাসিটোন ( acetoacetate, beta- hydroxybutyrate and acetone) তৈরি হতে থাকে। এতে গরুর শরীরের শক্তি কমতে থাকে এবং প্রজননসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। কিটোসিস অবস্থাটি তৈরি হয় সাধারণত ৬-১০ সপ্তাহের মধ্যে যখন গরু নতুন করে ডাকে আসা এবং গর্ভধারণের সর্বোচ্চ সময়। এই সময়ে শরীরে কিটোন বডি তৈরি হলে রক্তে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হতে এবং হলে প্রজননে সমস্যা দেখা দেয়।

৫. ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অনুপাত
শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের প্রয়োজন অপরিসীম। কিন্তু এই দুটি উপাদান সঠিক অনুপাতে না থাকলে শরীরে সঠিক মাত্রায় শোষণ হবে না। এতে করে মিল্ক ফিভার সহ প্রজননে সমস্যা দেখা যায়।

৬. ভিটামিন এ, ডি, ই
রেশনে সঠিক পরিমাণে এই তিনটি ভিটামিন না থাকলে শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, দুধ উৎপাদন, দুধের ফ্যাট ও প্রজননের উপর মারাত্নক প্রভাব পড়ে।

৭. সেলেনিয়াম ও ম্যাক্রো মিনারেলস
ভিটামিন ই শোষণ ও প্রজননের জন্য সেলেনিয়ামের প্রয়োজনীয়তা অনেক। যদিও আমরা সেলেনিয়ামকে কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তাছাড়াও ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সোডিয়াম ছাড়া অন্য যে মাইক্রো মিনারেলগুলো যেমন প্রয়োজন তেমনি থাকতে হবে। কম বা বেশি হলে প্রজনন সহ খাবার হজম, বৃদ্ধি ব্যহত হওয়া, খাবার গ্রহণ কমে যাওয়া এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই রেশনে প্রয়োজনমত ম্যাক্রো মিনারেল দিতে হবে যাতে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি না হয়।
ম্যাক্রো মিনারেল হলো যেসব খনিজ গরুর শরীরে বেশি পরিমানে থাকে। ফলে রেশনে সেসব মিনারেল বেশি পরিমানে দিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে: ক্যালসিয়াম, ক্লোরিন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম এবং সালফার।
আর মাইক্রো মিনারেল হলো যা গরুর শরীরে সামান্য পরিমানে থাকে। কিন্তু এই সামান্য পরিমানই কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এসব মিনারেলের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। মাইক্রো মিনারেলগুলো হলো: ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট, কপার/তামা, ফ্লুরিন, আইয়োডিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, সেলেনিয়াম এবং জিঙ্ক বা দস্তা।

৮. ব্লাড ইউরিয়া নাট্রোজেন
রক্তে নাইটোজেনের পরিমাণ বেড়ে গেলে গর্ভধারণে সমস্যা হয়। তাই বর্ষাকালে কাঁচা ঘাস খাওয়ানোর সময় সতর্কতার সঙ্গে খাওয়াতে হবে। 

৯. কাঁচা ঘাসে বিষক্রিয়া
প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত পাঁচ মিশালী ঘাসে কিছু বিষাক্ত ঘাস থাকে যা রক্তে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে প্রজননের সমস্যা সৃষ্টি করে। তাছাড়া নতুন কুশি বের হওয়ার ঘাস বা ধান গাছ খাওয়ানো যাবে না। প্রথম বৃষ্টির পর মাঠে গরু না চরানোই ভালো। কারণ ওই নতুন গজানো ঘাসে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। একইভাবে চাষ করা ঘাসেও ইউরিয়া দেয়ার অন্তত ২১ দিন পর ঘাস কাটতে হবে।

১০. কাঁচা ঘাসের অভাব
অনেক খামারে কাঁচা ঘাসের অভাব থাকে। ফলে অধিক পরিমাণে শস্য দানা খাওয়াতে হয়। এর ফলেও ডাকে আসা ও গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে। এটা মনে রাখতে হবে, গরুকে স্টার্চ বা কার্বোহাইড্রেড জাতীয় খাবার বেশি দিলে রাজ্যের রোগবালাই বাসা বাঁধবে। বসে বসে অতিরিক্ত ভাত বা শর্করা জাতীয় খাবার খেলে যেমন মানুষের সমস্যা হয় তেমনি বেশি বেশি কার্বোহাইড্রেড বা স্টার্চ গরুর স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। খাবারে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে প্রোটিন মিনারেল (গাভীর জন্য বিশেষ করে ক্যালসিয়াম) এবং ভিটামিনের ওপর।

১১. বডি কন্ডিশন
শরীরে যাতে অতিরিক্ত ফ্যাট না থাকে আবার একেবারে কমও যেন না থাকে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বডি কন্ডিশন স্কোর (বিসিএস স্কোর) ৪-৫ হওয়া ভালো। তবে ৬ হলেও সমস্যা নেই কিন্তু ৪ এর নিচে হওয়া উচিত নয়। 
এটি নিয়ে আলাদা একটি বিস্তারিত লেখা রয়েছে। সেখানে বিসিএস স্কোর কীভাবে পরিমাপ করা হয় তা আলোচনা করা আছে।

সমস্যা থেকে বাঁচতে করণীয়

ক. প্রোটিন
আমরা গরুর জন্য প্রায়ই এনার্জি বেজড রেশন তৈরি করে থাকি যেখানে প্রোটিনের অনুপাত খুবই কম থাকে। এই কথাটি অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা যতোখানি ভাত খাই সে তুলনায় আমিষ খাই খুবই কম। অতিমাত্রায় শর্করা গ্রহণের কারণে শরীরে শক্তি পাই ঠিকই কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর ঘাটতি বাড়তে থাকে। আর শরীরে শক্তি পাওয়ার কারণে প্রথমে আমরা ঘাটতিগুলো টের পাই না। কিন্তু ধীরে ধীরে সমস্যা বাড়তে থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা দেখা দেয়। এরপর একের পর এক অসুখ হতে শুরু করে। 
গবাদিপশুর খাবারের ক্ষেত্রেও আমাদের দেশে এই সমস্যা রয়েছে। এ কারণে হয়তো দেখা যায় গরুর গায়ে বেশ মাংস দেখা যাচ্ছে কিন্তু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে, একবার রোগ দেখা দিলে সহজে সারতে চায়। আবার বাড়ন্ত গরুর হলে ঠিকমতো বৃদ্ধি হয় না। প্রোটিন কিন্তু শরীরের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণের জন্য সবচেয়ে জরুরি খাদ্য উপাদান। এ কারণে গরুর রেশনে কমপক্ষে ১৬-১৭% প্রোটিন থাকা আবশ্যক। আর সেই সঙ্গে আরইউপি প্রোটিন থাকতে হবে ৩৫-৪০%।

খ. এনার্জি
গরুর রেশনে কমপক্ষে ১২ মেগাজুল/কেজি শক্তি থাকতে হবে। কম শক্তি সম্পন্ন খাবার দিলে গরু অনেক খাওয়ার পরও পর্যাপ্ত শক্তির যোগান পাবে না। আবার এতে করে প্রোটিনসহ অন্যান্য খাদ্য উপাদান শোষণের হারও কমে যেতে পারে।  রেশনে ১৫-২০% এর বেশি আঁশ (ফাইবার) থাকা যাবে না। খেয়াল রাখতে হবে যেন শরীরে কোনো মতেই নেগেটিভ এনার্জি ব্যালান্স (প্রয়োজনের তুলনায় কার্বোহাইড্রেট বা সুগার কম) না হয়। নেগেটিভ এনার্জি ব্যাল্যান্স হলেই শরীরে কিটোন বডিজ তৈরি হবে যা প্রজননের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

গ. ক্যালসিযাম ও ফসফরাস
এমনভাবে রেশন তৈরি করতে হবে যাতে করে গরুর শরীরে ফসফরাসের ঘাটতি দেখা না দেয়। রেশনে ফসফরাসের পরিমাণ ০.৪-০.৫% হওয়া উত্তম। ফসফরাসের পাশাপাশি ক্যালসিয়ামের ও চাহিদা পূরণ করতে হবে। রেশনে ক্যালসিয়ামের ঘনত্ব হবে ০.৭-০.৯%।

ঘ. ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অনুপাত
ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অনুপাত কমপক্ষে ২:১ হতে হবে। আমরা যারা গমের ভুসি ও ফসফরাস সাপ্লিমেন্ট (ডিসিপি) ব্যবহার করি তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুপাতটি উল্টা হয়ে যায়, ১:২। কারণ গমের ভূষিতে প্রচুর পরিমাণে ফসফরাস থাকে এবং সাথে ডিসিপি ব্যবহার করলে ফসফরাসের পরিমান প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। তাই যারা গমের ভুসি খাওয়ান তারা হিসাব মতো ডিসিপি ব্যবহার করবেন। ক্যালসিয়ামের জন্য লাইম স্টোন পাউডার বা ঝিনুক গুঁড়া ব্যবহার করবেন। 

ক্যালসিয়ামের জন্য অনেকে হাস-মুরগির ডিমের খোসার পাউডার ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে আমার মতে এটি মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ ডিমের খোসার সঙ্গে যে পর্দা বা ঝিল্লিটি থাকে সেটি মারাত্মক বিষক্রিযা তৈরি করতে পারে। এ নিয়ে আরেকটি পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।


ঙ. ভিটামিন
ভিটামিন এ, ডি, ই শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ডি এর অভাবে সঠিক ভাবে ক্যালসিয়াম শোষণ হবে না। এতে করে ক্যলসিয়াম ও ফসফরাস উভয়ের ঘাটতি দেখা দিবে। তাছাড়া ভিটামিন এ, ই এর অভাবে শারীরিক বৃদ্ধি ও প্রজনন মারাত্মক ব্যহত হয়। এই তিনটি ভিটামিনের পাশাপাশি অন্যান্য ভিটামিনের চাহিদার কথাও মাথায় রাখতে হবে।

চ. ম্যাক্রো মিনারেল
রেশনে পরিমিত ম্যাক্রো মিনারেলগুলো নিশ্চত করতে হবে। এর জন্য সঠিকভাবে রেশনে উপস্থিত মিনারেল হিসাব করে সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে। আমরা অনেকেই ইচ্ছামত সাপ্লিমেন্ট দিয়ে থাকি। এতে উপকারের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা বেশি। যেমন যারা বিভিন্ন ডালের ভুসি খাওয়ান তারা যদি আয়রন সাপ্লিমেন্ট দেন এতে আয়রন বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। কারণ ডালের ভুসিতে প্রচুর আয়রন থাকে। তেমনি লাইম পাউডার ও ঝিনুক গুঁড়াতেও প্রচুর আয়রন থাকে। তাই সেলেনিয়াম সহ সকল ম্যাক্রো মিনারেলের চাহিদা সঠিকভাবে দিতে হবে।

ছ. কাঁচা ঘাস
মনে রাখতে গরু একটি রুমিন্যান্ট প্রাণী। এরা মূলত তৃণভোজী। তৃণ অর্থাৎ ঘাসই গরুর প্রধান খাদ্য। সামান্য দানাদার খাদ্য এবং প্রচুর ঘাস খাইয়েও বাণিজ্যিকভাবে গরু পালন করা সম্ভব। তাদের উৎপাদন কিছুটা কম হলেও যত্ন ও ওষুধ বাবদ খরচ অনেক কমে যায়। তাই গরুকে প্রচুর পরিমাণে উন্নত জাতের ঘাস দিতে হবে। রক্তে যেন নাইট্রোজেনের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে বিষক্রিয়া না হয় সে জন্য দুধের গরুকে ইউরিয়া ও বর্ষাকালে কাঁচা ঘাস খাওয়ানোতে সতর্ক হতে হবে। এবং প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত ঘাস খাওয়ানোর সময় বিষাক্ত ঘাস যেন না থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

জ. ফ্যাট বা চর্বি
রেশনে ৫% এর বেশি ফ্যাট এবং ২% এর বেশি স্যাটুরেটেড ফ্যাট থাকা যাবে না। রেশনে ৩% ফ্যাট থাকা আবশ্যক।

সমস্যা হলে করণীয়
সময় হওয়ার পরও গরু ডাকে না এলে বা গর্ভধারণ না করলেই দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ এই সমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে অনেক ডাক্তার সরাসরি হরমোন ইনজেকশন দিয়ে দেন। এতে উল্টো ক্ষতি হতে পারে। এমনকি গরুর যদি পুষ্টিঘাটতি বা অন্য কোনো সমস্যা থেকে থাকে তাহলে হরমোন থেরাপির কারণ তার প্রজনন ক্ষমতা স্থায়ীভাবেও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

প্রথমে দেখতে হবে পুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা আছে কিনা। তারপর রোগ, বীজ ও পরিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। আপনার গরু যদি ব্যবস্থা নেওয়ার পর থেকে ৮-৯ সপ্তাহেও ডাকে না আসে বা গর্ভধারণ না করে এবং আপনার ব্যবহৃত রেশন যদি ওয়েল ব্যালান্সড না হয় থাকে তবে প্রথমে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে চিকিৎসা করাতে হবে:

১. প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে অর্থাৎ উচ্চ প্রোটিন যুক্ত খাবার যেমন ফিস মিল, সয়াবিন মিল, তিলের খৈল, সূর্যমুখী খৈল অথবা বাজারে প্রাপ্ত প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে। অতিরিক্ত সরিষার খৈল দেওয়া যাবে না এতে ইরোসিক এসিড থাকে।

২. উচ্চ আঁশ যুক্ত খাবার কমিয়ে উচ্চ এনার্জি যুক্ত খাবার দিতে হবে যাতে মেটাবলিক এনার্জি বৃদ্ধি পায়। এটি হতে পারে ভুট্টা, চিটাগুড় (মোলাসেস ইত্যাদ। এসব ক্ষেত্রে আঁশ ১০% এ নামিয়ে আনতে হবে যদিও এতে দুধের ঘনত্ব ও ফ্যাট কমে যেতে পারে। তবে যে কোনোভাবেই হোক অ্যানায়ন-ক্যাটায়ন মান পজেটিভ রাখতে হবে।

৩. ক্যালসিযাম ও ফসফরাস ইনজেকশন দিতে হবে।

৪. ভিটামিন এ ডি ই ইনজেকশন দিতে হবে।

৫. সেলেনিয়াম ও কপার সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে।

৬. পাশাপাশি একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে দেখতে হবে গরুর জরায়ুতে কোনো প্রকার সমস্যা আছে কিনা, কোন প্রকার ভাইরাস বা ব্যকট্যারিয়া দ্বারা আক্রান্ত কিনা ও জরায়ুতে ফ্যাট জমেছে বা সঠিক স্থানে আছে কিনা। 

সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগেই চেষ্টা করতে হবে যেন সমস্যা সৃষ্টি না হয়। সমস্যার সৃষ্টি হলে এর সমাধান করতে যে সময় ও অর্থ ব্যয় হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সঠিক ও সুষম রেশনই আপনার গরুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূলমন্ত্র।

এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক
গরু সময়মতো গরম না হলে:
- পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়াতে হবে।
- এ, ডি, ই ইনজেকশন, ১০০ কেজি গরুর দেহের ওজনের জন্য ১০ সিসি ৩ দিন পরপর ২/৩ দিন মাংসে পুশ করতে হবে।
- ডিবি পাউডার ১০০ কেজি গরুর দেহের ওজনের জন্য ৩০-৪০ গ্রাম খাদ্যের সাথে মিশিয়ে রোজ ১ বার ১ মাস খাওয়াতে হবে।
- সর্বশেষ হরমোন ইনজেকশন Fertazyl ৫ মিলি করে গাভী প্রতি ১ ডোজ মাংসে পুশ করতে হবে।

গাভী বা বকনা হিটে আসার  লক্ষণ
সাধারণত একটি গাভী বাচ্চা দেয়ার ৬/৮ সপ্তাহ পর এবং বকনার বয়োঃসন্ধি হওয়ার পর প্রতি ১৭ দিন থেকে ২৪ দিন পর পর হিটে আসে বা গরম হয় ( গড়ে ২১ দিন ধরা হয় )| কী কী লক্ষণ দেখে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার খামারের গাভী বা বক্নাটি হিটে এসেছে অথবা গরম হয়েছে তা নিচে দেয়া হল:

১. গাভী বা বকননার মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা যাবে .
২.গাভী বা বকনা ঘন ঘন ডাকাডাকি করবে.
৩.গাভী বা বকনা খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দিবে.
৪.আরেকটির গায়ে লাফিয়ে উঠে পড়তে চাইবে .
৫.সব সময় লেজ একটু উপরের দিকে উঠিয়ে রাখবে.
৬.তার যোনি পথ দিয়ে ডিমের সাদা অংশের মতো আঠালো তরল পদার্থ বা মিউকাস বের হবে.
৭. কিছুক্ষণ পর পর প্রস্রাব করবে এবং অন্য গরুর গা চাটবে ও শুঁকবে আর নাঁক কুঞ্চিত করবে.
৮.গাভী বা বকনা সহজে বসবে না, সে বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে থাকবে.
হিটে আসা বা গরম হওয়ার সময় কাল ১৬/১৮ ঘণ্টা এবং এই সময়ের মধ্যে গাভী বা বকনাকে প্রজনন করাতে হবে।

আরো পড়ুন:

Post a Comment

0 Comments