সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

আলুর লেইট ব্লাইট বা মড়ক রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার (সচিত্র)

আলুর লেট ব্লাইট রোগ
আলুর লেইট ব্লাইট বা মড়ক রোগ বিশ্বজুড়ে অন্যতম একটি ক্ষতিকারক রোগ। এ রোগের আক্রমণে আলুর ফলন গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ কমে যায়। ছত্রাকের (fungus) মতো একটি জীবাণু বা অনুজীবের আক্রমণে এ রোগ হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Phytophthora infestans। এটি মূলত এক ধরনের শ্যাওলা/শৈবাল (algae) জাতীয় উদ্ভিদ। এ কারণেই স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ার মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এর প্রাথমিক ও প্রধান পোষক আলু। তবে অন্যান্য সোলানেসি উদ্ভিদ যেমন: টমেটো ফসলেও আক্রমণ করতে পারে।

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে অর্থাৎ মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য ফাল্গুন মাসে তাপমাত্রা রাতে ১০ থেকে ১৬ ডিগ্রি এবং দিনে ১৬ থেকে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আর্দ্রতা শতকরা ৯০ ভাগের বেশি হলে  এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলে এ রোগ ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে মহামারি আকার ধারণ করে। বাতাস, বৃষ্টিপাত ও সেচের পানির সাহায্যে এ রোগের জীবাণু আক্রান্ত গাছ থেকে সুস্থ গাছে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ আর্দ্রতা যতো বাড়বে লেট ব্লাইটের সংক্রমণ ততো দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।

মড়ক রোগের লক্ষণ
১. রোগের আক্রমণে প্রথমে গাছের গোড়ার দিকে পাতায় ছোপ ছোপ ভেজা হালকা সবুজ গোলাকার বা বিভিন্ন আকারের দাগ দেখা যায়, যা দ্রুত কালো রং ধারণ করে এবং পাতা পঁচে যায়।
২. সকালে মাঠে গেলে আক্রান্ত পাতার নীচে সাদা পাউডারের মত জীবাণু দেখা যায়।
৩. ঠান্ডা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আক্রান্ত গাছ দ্রুত পঁচে যায়। এ অবস্থায় ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ক্ষেতে সমস্ত গাছ মারা যেতে পারে।
৪. এ রোগে আক্রান্ত আলুর গায়ে বাদামি থেকে কালচে দাগ পড়ে এবং খাবার অযোগ্য হয়ে যায়।

রোগের সচিত্র লক্ষণ
লেট ব্লাইট রোগের প্রথশ লক্ষণ হলো, আলুর পাতায় ছোট ছোট হালকা থেকে গাঢ় সবুজ রঙের গোলাকার বা অসম আকৃতির ছোপ ছোপ দাগ। এসব স্পটে পানির ফোঁটা জমে থাকতে পারে। চিত্র-১ খেয়াল করুন। এই লক্ষণগুলো প্রথমে সাধারণত গোড়ার দিকের পাতায় দেখা যায়। পাতার একেবারে আগা এবং কিনারায় যেখানে শিশির বেশিক্ষণ ধরে জমে থাকে সেখানে প্রথম লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
late blight potato plant leaves
চিত্র-১: লেট ব্লাইট আক্রমণের প্রথম লক্ষণ হালকা থেকে গাঢ় সবুজ পানি শোষক স্পট

ঠাণ্ডা ও আর্দ্র আবহাওয়ার মধ্যে লক্ষণগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ছোপ দাগুলো বড় হয়ে গাঢ় বাদামি বা কালো আকার ধারণ করে। কখনো দেখতে তেলতেলে (গ্রিজি) মনে হয়, চিত্র-২ খেয়াল করুন। কখনো কখনো স্পটগুলোর চারপাশে ধুসর বা হলুদ রঙের বৃত্ত দেখা যেতে পারে, চিত্র-৩ দেখুন।
late blight potato plant stem
চিত্র-২: স্পটগুলো দ্রুত বড় হলে বাদামি বা কালো আকার ধারণ করে

লক্ষণগুলো কিন্তু শুধু পাতা বা পাতার শিরার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, দ্রুত এটি পুরো পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত পাতা কয়েক দিনের মধ্যে শুকিয়ে যায়। লক্ষণগুলো কখনো কখনো পাতার বোঁটার গোড়া এবং আলু গাছের কাণ্ড শাখা প্রশাখাতেও দেখা যেতে পারে, চিত্র-৪ খেয়াল করুন।
late blight potato plant leave
চিত্র-৩: স্পটগুলোর চারপাশে হলুদ বা সাদাটে রঙ থাকতে পারে

late blight potato plant and brance
চিত্র-৪: লেট ব্লাইট আলুর পাতার বোঁটার গোড়া, শাখা প্রশাখা বা নতুন রসালো মঞ্জুরিতে আক্রমণ করতে পারে 

late blight potato plant leaves
চিত্র-৫: ঠান্ডা ও আর্দ্র আবহাওয়াতে এ রোগের জীবাণু বংশবিস্তার করে। তখন আক্রান্ত স্থানের চারপাশে সাদা দেখায়

ঠাণ্ডা ও আর্দ্র আবহাওয়ার মধ্যে যখন রোগটি দ্রুত ছড়ায় তখন আক্রান্ত স্থানের চারপাশে সাদা বৃত্ত দেখা যেতে পারে, চিত্র-৫ লক্ষ্য করুণ। আবার আক্রান্ত পাতার বোঁটার গোড়ার দিকেও এমন হতে পারে, চিত্র-৬ দেখুন। এমন হলে বুঝতে হবে এ স্থানেই লেট ব্লাইটের জীবাণু তার স্পোর তৈরি করছে। যা দিয়ে এ জীবাণু বংশবিস্তার হয়। আবহাওয়া যখন গরম ও শুষ্ক হতে থাকে সেই সঙ্গে উল্লেখিত লক্ষণগুলোও শুষ্ক হয়ে যায়, স্পোর তৈরি বন্ধ হয়ে যায়, এবং হলুদাভ বাদামি রঙ ধারণ করে, চিত্র-৭ দেখুন।
late blight potato plant 01
চিত্র-৬: স্পোর তৈরির সময় আক্রান্ত পাতার বোঁটার গোড়াতেও সাদা সাদা দেখা যাবে

late blight potato plant
চিত্র-৭: গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ার মধ্যে বাদামি ও শুষ্ক স্পট দেখা যাবে

লক্ষণযুক্ত অংশের চারপাশে মলিন সবুজ থেকে হলুদ রঙ থাকতে পারে। ক্ষেত মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলে পচা দুর্গন্ধ হতে পারে।

লেট ব্লাইটে আক্রান্ত টিউবার বা আলুর আকার হবে অসম। অর্থাৎ মসৃণ হবে না। ত্বকের ছোপ ছোপ দাগ থাকবে, দাগের রঙ হবে বাদামি বা বেগুনী, চিত্র-৮ দেখুন। তবে লাল আলুতে এ লক্ষণ শনাক্ত করা কঠিন।
late blight tuber
চিত্র-৮: আক্রান্ত আলুর আকারে সমতা থাকবে না। কোথাও পচে বা শুকে দেবে যেতে পারে। জাত ও স্থান ভেদে বাদামি থেকে বেগুনী রঙের হতে পারে।

আক্রান্ত আলুর ত্বকের নিচে হলুদাভ বাদামি বা লালচে বাদামি শুষ্ক গুটি গুটি দেখা যাবে। এটি আলু প্রায় ১/২ ইঞ্চিজুড়ে থাকতে পারে, চিত্র-৯ দেখুন।  তবে এ লক্ষণটি আলুর জাত, আবহাওয়ার তাপমাত্রা এবং আক্রান্তকালের ওপর নির্ভর করে আক্রান্ত স্থানের বিস্তৃতি কমবেশি হতে পারে।
late blight potato tissue
চিত্র-৯: আক্রান্ত আলুর ত্বকের নিচে হলুদাভ বাদামি বা লাল বাদামি পচা দাগ থাকবে।

আক্রান্ত আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখলে বা স্টোরেজেই আক্রান্ত হলে কিনারের টিস্যু দেখে সহজেই শনাক্ত করা যায়, চিত্র-১০ দেখুন। লেট ব্লাইট আক্রান্ত টিস্যু ও সুস্থ টিস্যুর মাঝখানে একটি বাদামি দাগ থাকতে পারে। আক্রান্ত স্থানে ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবাণুর আক্রমণ হলে পচনের মাত্রা বাড়বে।
late blight seed in cold storage
চিত্র-১০: কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা আলুর টিস্যু এভাবে পচে যাবে

মনে রাখতে হবে আলুতে লেট ব্লাইট রোগের সবচেয়ে বড় উৎস হলো আক্রান্ত বীজ আলু। এ কারণে আলু সঠিকভাবে সংরক্ষণ অথবা বিএডিসি বা ভালো কোনো কোম্পানির কাছ থেকে বীজ আলু সংগ্রহ করাই সবচেয়ে নিরাপদ।
late blight seed
চিত্র-১১: আক্রান্ত আলু বীজ গজালেও নতুন কুঁড়িও লেট ব্লাইট আক্রান্ত হবে
রোগ প্রতিরোধে করণীয়
এ রোগ প্রতিরোধে আগাম আলুর চাষ অর্থাৎ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আলু রোপণ অথবা আগাম জাত চাষের মাধ্যমে এ রোগের মাত্র অনেকটা কমানো সম্ভব। রোগ সহনশীল জাত যেমন- বারি আলু-৪৬, বারি আলু-৫৩, বারি আলু-৭৭ এগুলি চাষ করা যেতে পারে। এ ছাড়া রোগ মুক্ত প্রত্যায়িত বীজ অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। নিম্ন তাপমাত্রায়, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য ৭ থেকে ১০ দিন অন্তর অন্তর ম্যানকোজেব গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন- ডায়থেন এম ৪৫ বা পেনকোজেব-৮০ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ২গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভাল ভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
চিত্র-১২

রোগ দেখা দেয়ার পর আক্রান্ত জমিতে রোগ নিয়ন্ত্রন না হওয়া পর্যন্ত সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হবে। নিজের বা পাশ্ববর্তী ক্ষেতে রোগ দেখা মাত্রই ৭ দিন অন্তর যে কোন একটি গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক পর্যায়ক্রমিকভাবে নিম্ন বর্ণিত হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। যেমন-
ক. এক্রোবেট এম জেড (ম্যানকোজেব ৬০%+ ডায়মেথোমর্ফ৯%)-২ গ্রাম অথবা
খ. সিকিউর ৬০০ ডব্লিউ জি(ম্যানকোজেব ৫০%+ ফেনামিডন১০%)-২ গ্রাম অথবা
গ. মিলোডিডুও ৬৬.৮  ডব্লিউ পি (প্রোপিনেব ৭০%+ ইপ্রোভেলিকার্ব)-২ গ্রাম অথবা
ঘ. জ্যামপ্রো ডিএম (এমটোকট্রাডিন ৩০%+ ডায়মেথোমর্ফ ২২.৫%)- মিঃলিঃ অথবা
ঙ. কার্জেট এম ৮ (ম্যানকোজেব ৬৪%+ সাইমোক্সালিন ৮%)-২ গ্রাম অথবা
চ. ফুলিমেইন ৬০ ডব্লিউ পি (ফ্লুমর্ফ ১০%+ (ম্যানকোজেব ৫০%)-২ গ্রাম

যদি কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া দীর্ঘসময় বিরাজ করে ও রোগের মাত্রা ব্যাপক হয় সে ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ছত্রাকনাশকের যে কোন একটি মিশ্রণ পর্যায়ক্রমিকভাবে নিম্নবর্ণিত হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ দিন অন্তর স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
ক. এক্রোবেট এম জেড ৪ গ্রাম +সিকিউর ৬০০ডব্লিউ জি ১গ্রাম অথবা
খ. এক্রোবেট এম জেড ৪ গ্রাম+মিলোডিডুও ৬৬.৮  ডব্লিউ পি ১গ্রাম অথবা
গ. ফুলিমেইন ৬০ ডব্লিউ পি ৪ গ্রাম+অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি( কার্বেন্ডাজিম ৫০%) ১ গ্রাম অথবা
ঘ. মিলোডিডুও ৬৬.৮  ডব্লিউ পি ৪ গ্রাম+সিকিউর ৬০০ডব্লিউ জি ১গ্রাম

রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হলে ৩ থেকে ৪ দিন অন্তর ছত্রাকনাশকের মিশ্রণ স্প্রে করতে হবে। ছত্রাকনাশক পাতার উপরে ও নিচে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।

সতর্কতা
গাছ ভেজা অবস্থায় জমিতে ছত্রাকনাশক স্প্রে না করাই ভালো। আর যদি স্প্রে করতেই হয় তাহলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সাবানের গুঁড়া মিশিয়ে নিতে হবে। ছত্রাকনাশক স্প্রে করার সময় হাত মোজা, সানগ্লাস, মাস্ক ও  এপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। সবসময় বাতাসের অনুকূলে স্প্রে করতে হবে।

Post a Comment

0 Comments