সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

বায়ো এজেন্ট: পোকা দিয়ে ফসলের পোকা দমন

trichogramma wasp
ট্রাইকোগ্রামা বোলতা
কিছু পোকা আছে যেগুলো অন্য পোকার ডিম ও লার্ভা খেয়ে জীবনধারণ করে। আর এসব পোকা সাধারণ ফসলের জন্য ক্ষতিকর হয় না। বরং ফসলের পাতা, কাণ্ড খেয়ে জীবনধারণ করে এমন ক্ষতিকর পোকার ডিম লার্ভা খেয়ে জৈব বালাইদমনকারক হিসেবে কাজ করে। অনেক প্রজাতির পোকা আবার ক্ষতিকর পোকার ডিম বা লার্ভার মধ্যে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর সেই ডিম বা লার্ভা খেয়ে বড় হয়। এ ধরনের পোকাকে বলে বায়ো এজেন্ট।

পোকা দমনের জন্য ক্ষেতে বায়ো এজেন্ট অবমুক্ত করার উপযুক্ত সময় ও রুটিন সম্পর্কে আগে ধারণা থাকতে হবে। তা না হলে কাঙ্ক্ষিত বালাই দমন হবে না। ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর পোকা প্রথম চোখে পড়ার পরপরই বায়ো এজেন্ট অবমুক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বায়ো এজেন্ট দিয়ে পোকা দমনে কিন্তু কীটনাশকের মতো তাৎক্ষণিক ফলের আশা করা ভুল। তাছাড়া ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ যদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন বায়ো এজেন্ট দিয়ে কাজ হবে না। তাছাড়া প্রতি একর জমিতে কী পরিমানে বায়ো এজেন্ট ছাড়তে হবে সেটিও জানাটা জরুরি। নিচে দুটি বায়ো এজেন্ট নিয়ে আলোচনা করা হলো:

ট্রাইকোগ্রামা ওয়াস্প বা বোলতা
ট্রাইকোগ্রামা বোলতা ট্রাইকোগ্রামটিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র ঝালরওয়ালা পাখাবিশিষ্ট ছোট একটি পতঙ্গ। এ বোলতা লেপিডপটেরা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত (প্রজাপতি ও মথ) শত্রু পোকার ডিম খেয়ে ফেলে। এ পোকার কোনো কোনো প্রজাতি ওয়াটার বিটল, ওয়াটার বাগ এবং অন্যান্য পোকার ডিমের পরজীবী। এ প্রজাতির পোকা প্রয়োজনে এদের পাখা দিয়ে সাঁতার কেটে হোস্ট (পোষক) পোকার ডিম খুঁজে বের করতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ট্রাইকোগ্রামা ওয়াস্প বিভিন্ন হোস্ট প্রজাতির ওপর বংশ বৃদ্ধি করে এবং হরমোন ও অন্যান্য পদার্থের ওপর নির্ভর করে এদের শরীরের রঙ পরিবর্তন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি বা পরিবর্তন হতে দেখা যায়।
trichogramma wasp colony
ট্রাইকোগ্রামা বোলতার কলোনি
ট্রাইকোগ্রামা ওয়াস্প হোস্ট পোকার ডিমে ডিম পাড়ে এবং ডিমের মধ্যে বাড়তে থাকে, ফলে শত্রু পোকার ডিম থেকে আর কীড়া (লার্ভা) জন্মাতে পারে না। হোস্ট পোকার ডিমে ৭ থেকে ১০ দিন থাকার পর বোলতারা বের হয়ে আসে। এরা খুবই ছোট পোকা, সচরাচর থেকে ১ মিলিমিটার লম্বা হয়।

বর্তমানে ভায়ালে এ পরজীবী পোকা পাওয়া যায়। ১ গ্রাম হোস্ট পোকার ডিমের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার পরজীবী ট্রাইকোগ্রামা থাকে, যা ১ হেক্টর জমিতে ব্যবহার করা যায়।
trichogramma wasp ‍attacks caterpillar
শুঁয়োপোকার ওপর ট্রাইকোগ্রামার আক্রমণ
বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার ডিমে কোনো আবরণ থাকে না, ফলে ট্রাইকোগ্রামা বোলতা সহজেই পরজীবায়ন ঘটাতে পারে। আক্রমণের শুরু থেকে শেষ ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর এ বোলতা অবমুক্ত করতে হবে।

ট্রাইকোগ্রামা অবমুক্তকরণের পদ্ধতি
ট্রাইকোগ্রামা অবমুক্তকরণের জন্য যেসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে:
> ফসলের ক্ষেত নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে পোকার আবির্ভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে
> পাতায়/ডগায়/ফুল/কুঁড়ি/ফলের বোঁটায় বা নাভীতে ডিম দেখামাত্র পরজীবী ট্রাইকোগ্রামা অবমুক্ত শুরু করতে হবে
> বেগুনের ক্ষেত্রে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণের পুরো মৌসুম ধরে নিয়ম অনুযায়ী পরজীবী বোলতাটি অবমুক্তকরণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে
> সাধারণত সকাল ৮টা থেকে ১০টা বা পড়ন্ত বিকাল ৪.৩০টা থেকে ৬টা পর্যন্ত পরজীবী বোলতা অবমুক্ত করা উত্তম। পরজীবায়নকৃত ডিম অথবা সদ্যজাত ট্রাইকোগ্রামা বোলতা ভায়াল এ করে মাঠে পরিবহন করা হয়
> পুরাতন খবরের কাগজ অথবা অন্য কাগজ সাধারণত ৬-৭ সেন্টিমিটার বর্গাকারে কেটে মাঝখানে ১টি ভাঁজ দিয়ে বৈয়ামে ভরতে হবে।  ঠিক যেভাবে চকলেট বা ক্যান্ডির কাগজ ভাঁজ দেয়া থাকে । ২২ সেন্টিমিটার লম্বা একটি বৈয়ামে সাধারণত ১২০ থেকে ১৩০ টি কাগজের টুকরা ধরে
> ২২ সেন্টিমিটার উচ্চতা বিশিষ্ট বা ৩ লিটার পানি ধরে এমন বৈয়ামে ১২০ থেকে ১৩০টি ভাঁজ করা কাগজের টুকরা রাখার পর সেখানে ১ গ্রাম ট্রাইকোগ্রামা ছাড়া হয়। কাগজের ভাঁজে পূর্ণবয়স্ক ট্রাইকোগ্রামা ঢুকে গেলে তা ফসলের গাছে স্থাপন করতে হয়
> বেগুনের ক্ষেত্রে শুরুতে আইলের থেকে ২ লাইন বাদ দিয়ে মাঠের এক কোণ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। অতঃপর ৫-৬ ধাপ যাওয়ার পর একটি ভাঁজ করা কাগজের টুকরা গাছের ডালের ভাঁজে স্থাপন করতে হবে। লাইন শেষ হওয়ার আগেই বাঁক নিয়ে ২ লাইন বাদ দিয়ে আবার লাইন বরাবর হাঁটতে হবে
> এভাবে ক্রমে একই নিয়মে পুরো জমিতে ট্রাইকোগ্রামা অবমুক্ত করতে হবে। স্ট্রিপ বা কার্ডে ট্রাইকোগ্রামা রাখা থাকলে সেক্ষেত্রে অবমুক্ত শেষ হলে প্রতিটি স্ট্রিপকার্ড গাছের পাতা বা ডালের খাঁজে গেঁথে বা জাংলায় (মাচা) ঝুলিয়ে রাখতে হবে যা থেকে পরে আরো ও ট্রাইকোগ্রামা বের হয়ে পরজীবায়ন ঘটাতে পারে।

ব্রাকন ওয়াস্প বা ব্রাকন বোলতা
ব্রাকন জাতীয় পরজীবী পোকা ব্রাকোনিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মাঝারি আকারের এ বোলতা অনেক পোকার কীড়া পরজীবায়ন করতে পারে। এদের স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই পাখাওয়ালা বা পাখাবিহীন হতে পারে। এদের অ্যাবডোমেন (তলপেট) লোমবিহীন বা অল্প লোমবিশিষ্ট হয়। ক্ষতিকর পোকার একটি কীড়া ক্যাটারপিলারের (শুঁয়োপোকা) মধ্যে অনেক সংখ্যক এ পোকার কীড়া থাকতে পারে। এ কীড়ার শরীরের সাদা, হলুদ রঙের রেশমি কোকুনের মধ্যে পুত্তলি জন্মায়। কোনো কোনো প্রজাতির শত্রু পোকার কীড়ার মধ্যে ও পুত্তলি অবস্থায় থাকে।
bracon wasp
ব্রাকন বোলতা
ব্রাকনের কীড়া খুবই আক্রমণ প্রবণ একটি বহিঃপরজীবী। স্ত্রী ব্রাকন প্রথমে হোস্ট পোকার কীড়ার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়, ফলে কীড়া অবশ হয়ে যায়। একটি স্ত্রী ব্রাকন ৫০০ থেকে ১ হাজার হোস্ট পোকার কীড়া পরজীবায়ন করতে পারে। পরজীবায়নকৃত কীড়া দুর্বল হয়ে যায় এবং আর বাঁচতে পারে না। পরজীবায়নকৃত কীড়ার ওপরে স্ত্রী ব্রাকন ডিম দেয় এবং পরে কীড়ার শরীরের ভেতরে খেয়ে বাড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে শত্রুপোকা ধ্বংস হয়।

এ প্রজাতির পূর্ণ বয়স্ক পোকা কাচের/প্লাস্টিকের পাত্রে/বৈয়ামে রাখা এবং এর মাধ্যমে মাঠে সরবরাহ করা হয়। এ বৈয়ামকে বাংকার বলে। একটি বাংকারে ৮০০ থেকে ১ হাজার জীবন্ত পূর্ণবয়স্ক ব্রাকন রাখা যায়। বাংকারে অথবা মাঠে ৬০:৪০ অনুপাতে স্ত্রী ও পুরুষ পোকা অবমুক্ত করা আবশ্যক। একটি শস্য মৌসুমে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর ৫-৬ বার পূর্ণ বয়স্ক ব্রাকন অবমুক্ত করতে হবে।
bracon wasp attacks larvae
ক্ষতিকর পোকার লার্ভায় ব্রাকন বোলতার আক্রমণ

মাঠে ব্রাকন অবমুক্তকরণ পদ্ধতি
বেগুনের ক্ষেত্রে  ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার কীড়ার আক্রমণের শুরু থেকে শেষ ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর পূর্ণ বয়স্ক এ পোকা অবমুক্ত করতে হবে। পূর্ণবয়স্ক ব্রাকন অবমুক্তকরণের সময় যেসব বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে হবে:
ক. নিয়মিত জরিপের মাধ্যমে বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী কিংবা জাতীয় ফসলের মাছি পোকার আবির্ভাব নিশ্চিত হতে হবে
খ. ডগায় বা ফলে হোস্ট পোকার কীড়া দেখামাত্র পরজীবী ব্রাকন অবমুক্ত করতে হবে এবং আক্রমণের পুরো মৌসুম ধরে নিয়ম অনুযায়ী পরজীবী ব্রাকন অবমুক্তকরণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে
গ. সাধারণত সকাল ৮টা থেকে ১০টা অথবা পড়ন্ত বিকালে ৪.৩০টা থেকে ৬টা পর্যন্ত পরজীবী এ বোলতা অবমুক্ত করা উত্তম। পরজীবায়নকৃত ডিম অথবা সদ্যজাত ব্রাকন বৈয়াম বা ব্যাংকারে করে মাঠে পরিবহন করা হয়
ঘ. সাধারণত ২২ সেন্টিমিটার একটি বৈয়াম বা বাংকারে ৮০০ থেকে ১ হাজার পূর্ণ বয়স্ক ব্রাকন থাকে। এ পোকা অবমুক্তকরণের শুরুতেই আইলের পাশ থেকে ২ লাইন বাদ দিয়ে মাঠের এক কোনো দিয়ে ভেতরে গিয়ে ৫-৬ ধাপ যাওয়ার পর বাংকারের মুখের ঢাকনা একটু খুলে কয়েকটি ব্রাকন বের করে দিতে হবে। এভাবে এক লাইনে ছাড়া শেষ হলে ২ লাইন বা ৬-৭ ধাপ বাদ দিয়ে পরের লাইনে আবার সোজা হাঁটতে হবে এবং ৫-৬ ধাপ পর পর পোকা ছাড়তে হবে
ঙ. এভাবে একই নিয়মে পুরো জমিতে ব্রাকন অবমুক্ত শেষ হলে বাংকার আওতামুক্ত করে রেখে দিতে হবে। পরের দিন বয়স্ক ব্রাকন ডিম থেকে বের হলে তা আবার অবমুক্ত করতে হবে এবং ব্রাকন বের শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে
চ. সবশেষে স্ট্রিপ/কার্ড গাছের ডালে বা জাংলায় বেঁধে রাখতে হবে যাতে পরে আরও ব্রাকন বের হয়ে পরজীবায়ন ঘটাতে পারে।

ট্রাইকোগ্রামা ও ব্রাকনকে কৃত্রিমভাবে খাওয়ানোপ্রখর রোদ বা অতিবৃষ্টির কারণে ট্রাইকোগ্রামা ও ব্রাকন মাঠে অবমুক্ত করা সম্ভব না হলে এদের জন্য মধু বা চিনির শরবত সরবরাহ করতে হবে। ছোট পরিষ্কার এক টুকরো তুলাতে মধু বা মিষ্টির সিরা বা শরবত ভিজিয়ে ভায়ালের বা বাংকারের মুখের কাপড়ের ওপর রাখতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে যেন মধু বা শরবত কাপড় চুইয়ে বা ফোঁটা আকারে ভায়ালের বা বাংকারের ভেতরে প্রবেশ না করে এবং কোনোভাবেই পিঁপড়ার আক্রমণ না ঘটে। তুলার টুকরা শুকিয়ে গেলে সেটি আবার মধু বা শরবত দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। প্রখর রোদ বা বৃষ্টির সময় ট্রাইকোগ্রামা ও ব্রাকন বোলতা অবমুক্ত করা উচিত হবে না। কোনো কারণে অবমুক্ত করতে না পারলে এদের এমনভাবে রাখতে হবে যেন পিঁপড়া ধরতে না পারে। এজন্য টেবিলের অথবা চৌকির পায়ার নিচে পানির পাত্র দিয়ে তার ওপর রাখা যেতে পারে। আলো বাতাস চলাচল করতে পারে এমন স্থানে ভায়াল সংরক্ষণ করতে হবে।

Post a Comment

0 Comments