একটি জমির পরিমাণ, অবস্থান, বর্তমান অবস্থা, সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র, বেচা-কেনা, হস্তান্তর, দান, উইল ইত্যাদি বিষয় বুঝতে হলে এ সম্পর্কিত পরিভাষাগুলো জানা ও বুঝা খুব জরুরি। যেমন: মৌজা, পর্চা, খতিয়ান, দাগ নম্বর, নকশা, সিএস, আর ইত্যাদি। নিচে সেগুলো যতোটা সম্ভব সহজ করে উপস্থাপন করা হলো:
মৌজা
সার্ভের সময় সাধারণত একই রকম ভূ-প্রকৃতির ভৌগলিক এলাকা স্বতন্ত্রভাবে মাপজোক করা হয়। কোনো থানা বা উপজেলার এরকম স্বতন্ত্র ভৌগলিক এলাকা বা ভূ-খণ্ডই হলো মৌজা। মৌজা জরিপ বা ভূমি ব্যবস্থাপনার একটি একক। কয়েকটি গ্রাম একটি মৌজার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে । আবার কোনো কোনো গ্রামে একাধিক মৌজাও থাকতে পারে। মৌজার কোনো সুনির্দিষ্ট আয়তন নেই। তবে সাধারণত কোনো একটি উপজেলা একাধিক মৌজায় বিভক্ত থাকে। ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভের (CS) সময়ে এক একটি মৌজা এলাকাকে পৃথকভাবে পরিচিতি নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয় । বাংলাদেশে মোট মৌজার সংখ্যা হচ্ছে ৫৯ হাজার ৯৯০ টি। ভূমি ব্যবস্থাপনায় মৌজা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। খতিয়ান বাদ দিলে মৌজার নাম উল্লেখ থাকে। উপজেলাধীন প্রত্যেক মৌজাকে একটি ক্রমিক নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এই নম্বরকে জেএ নম্বর বলে। এটি স্থায়ী।
মৌজা ম্যাপ বা নকশা
খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ দুটো মিলেই পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড। আসলে জরিপের সময় খতিয়ান বা জমির মালিকানার বিবরণ এবং জমির নকশা বা ম্যাপ একসাথেই তৈরি করা হয়। কেবলমাত্র জমির খতিয়ান দেখে জমি চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এজন্য মৌজা ম্যাপ বা জমির নকশার প্রয়োজন হয়। মৌজা ম্যাপ জমি চিহ্নিত করতে বা খুঁজে পেতে খুব সহায়ক। এতে দাগ নম্বর দিয়ে জমি সূচিত করা থাকে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমির পাশাপাশি রাস্তা, স্কুল, মসজিদ, পুকুর ঈদগাহ ইত্যাদি পাবলিক প্রোপার্টিও চিহ্নিত করা থাকে। মৌজা ম্যাপ পর্চার মতোই ডিসি অফিসের রেকর্ডরুম থেকে সংগ্রহ করা যায়।
খতিয়ান
খতিয়ানে (Record of Rights) খতিয়ান নম্বর, জেলা ও মৌজার নাম লিপিবদ্ধ থাকে। এছাড়া একাধিক কলামে জমির মালিকের নাম, পিতার নাম, ঠিকানা, দাগ নম্বর (Plot Number), জমির শ্রেণী, পরিমাণ ইত্যাদি তথ্য উল্লেখ থাকে। খতিয়ানে কোনো এক মৌজায় কোনো একজন মালিকের জমির বিবরণ থাকে। আবার একটি খতিয়ানে একাধিক মালিকের জমির বিবরণও থাকতে পারে। এ খতিয়ানগুলো সাধারণত মৌজাওয়ারি তৈরি করা হয়। অর্থাৎ কোনো একটি মৌজার সব খতিয়ান একসাথে বাঁধাই করা হয়। এজন্য রেকর্ড বইকে অনেকে সাধারণ বা প্রচলিতভাবে Volume- ও বলে থাকেন।
হাল খতিয়ান
কোনো এলাকার সর্বশেষ জরিপে খতিয়ানের রেকর্ড প্রস্তুত হওয়ার পর সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষিত হয়ে বর্তমানে চালু আছে এমন খতিয়ানকে হাল খতিয়ান বলে ।
সাবেক খতিয়ান
হাল খতিয়ানের পূর্ব পর্যন্ত চালু খতিয়ানকে সাবেক খতিয়ান বলে , যা বর্তমানে চালু নেই তবে জমির ইতিহাস বুঝতে এর গুরুত্ব অনেক বিধায় এর সংরক্ষণ দরকার ।
সিএস খতিয়ান
সিএস খতিয়ানের পূর্ণরূপ Cadastral Survey (দেশব্যাপী জরিপ) খতিয়ান ১৯১০-১৯২০ সালে জরিপ করে এই খতিয়ান তৈরি করা হয়েছিল ।
এসএ খতিয়ান
এসএ খতিয়ানের পূর্ণরূপ State Acquisition (রাষ্ট্রকর্তৃক অধিগ্রহণ) খতিয়ান । টেস্ট একুইজিশন অ্যান্ড টেনেন্সি অ্যাক্ট প্রণয়ন করে ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা হয় । জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর যে খতিয়ান তৈরি করা হয় তা-ই এসএ খতিয়ান । ১৯৫৬ সালের জরিপে এ খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়।
আরএস খতিয়ান
আরএস-এর অর্থ হলো Revisional Settlement বা সংশোধনী বন্দোবস্ত । এসএ খতিয়ানের পর ঐ আইনের ১৪৪ ধারা অনুসারে যে খতিয়ান প্রকাশিত হয় (বা হবে) তাকে আরএস খতিয়ান বলে ।
পরচা বা পর্চা
যখন পৃথক একটি কাগজে খতিয়ানের অনুলিপি তৈরি করা হয় তখন তাকে পরচা বলা হয়। এই অনুলিপি সাধারণত হাতে লিখে বা টাইপরাইটারে বা কম্পিউটারে কম্পোজ করে তৈরি করা হয়ে থাকে। অনুলিপি যখন রেকর্ড রুমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয় তখন তাকে নকল বা Certified Copy। সহজ কথায়, পরচা হলো হাতে লিখিত বা কম্পোজকৃত খতিয়ানের কপি বা খসড়ার রূপ। আমরা সিএস, এসএ এবং আরএস পরচার নাম শুনে থাকি। সিএস, এসএ এবং আরএস পরচা আসলে বিভিন্ন রেকর্ডের খসড়া বা অনুলিপি বা কপি। কাজেই পরচা সিএস, এসএ, আরএস বা মহানগরে জরিপ এই ৪ প্রকার হতে পারে। এছাড়া জরিপ চলা কালে প্রাথমিকভাবে হাতে লেখা একটি খসড়া বিবরণ যাচাইয়ের জন্য জমির মালিককে দেওয়া হয়; একে মাঠ পরচা বা হাত পরচা বলে। পরচা বা রেকর্ডের সহি মুহুরি নকল (Certified Copy) পাওয়া যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় (DC office)- এর রেকর্ডরুমে। নির্ধারিত ফিসহ আবেদন করলে রেকর্ড রুম থেকে পরচা সরবরাহ করা হয়। পরচা কখনো কোনো দালালের কাছ থেকে নেওয়া যৌক্তিক নয়। এতে ভুল থাকতে পারে। কেবলমাত্র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ পরচা-ই আসল বা Authentic.
জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিবরণ, জমির খতিয়ান-দাগ, অংশ, হিস্যা, শ্রেণী ইত্যাদি জানার জন্য পরচা প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে জমি কেনাবেচার সময় পরচা যাচাইয়ের প্রয়োজন হয়। পরচা যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিস, এসি (ল্যান্ড) অফিস বা রের্কডরুমে যোগাযোগ করা যেতে পারে ।
ওয়ারিশ সনদ
উত্তরাধিকার মুসলিম আইনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পরেই তার সম্পদের ওপর উত্তরাধিকার প্রাপ্তি/অপ্রাপ্তির প্রশ্ন আসে। তখন ওয়ারিশ সনদের গুরুত্বও মুখ্য হয়ে ওঠে। ওয়ারিশ সনদ সাধারণত দেওয়ানি আদালত দিয়ে থাকে যা একজন মৃত ব্যক্তির আইনি উত্তরাধিকারীরা পেয়ে থাকে। যদি অছিয়ত বা উইল না করেই কোনো ব্যক্তি মারা যান, কোর্ট ওয়ারিশ সনদ প্রদান করে মৃত ব্যক্তির ঋণ/কর্জ নির্ধারণ করতে পারে।
সনদটি উত্তরাধিকারদের তাদের নামে কোনো সম্পত্তি হস্তান্তরিত আছে কিনা, বা উত্তরাধিকার যোগ্য কতটুকু সম্পদ আছে তা সত্যায়ন করে থাকে। উত্তরাধিকারী/সুবিধাভোগীর আবেদনের প্রেক্ষিতে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সনদটি ইস্যু করা হয়। ওয়ারিশ সনদ কার্যকরী, কিন্তু সব সময় এর বলে মৃতের সম্পদে উত্তরাধিকার নাও পাওয়া যেতে পারে। সাথে প্রয়োজন, একটি মৃত্যু সনদ এবং অনাপত্তি সনদ। যে আদালতের এখতিয়ারে সম্পত্তি রয়েছে, সেখানে আবেদন জারি করতে হয়। ওয়ারিশ সনদের নিয়ম-কানুন উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫ (The Succession Act, 1925) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি এমন এক ধরনের দলিল যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে তার পক্ষ থেকে কোনো কাজ করার ক্ষমতা দিতে পারে। সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, ভাড়া আদায় করা, আইনগত কাজ পরিচালনা করাসহ আরো নানা ক্ষমতা এর মাধ্যমে দেয়া যায়। পাওয়ার অব অ্যাটর্নিতে মূল মালিকের মতো প্রায় একই ক্ষমতা পাওয়ার গ্রহীতার থাকতে পারে। সবাই এই ক্ষমতা নিতে পারে না। চুক্তি করার যোগ্যতা ( নির্দিষ্ট বয়স, সুস্থতা) থাকলেই শুধু এই ক্ষমতা নেওয়া সম্ভব। মৃত্যু, উদ্দেশ্যসাধন, মেয়াদের অবসান প্রভৃতি কারণে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অবসান হতে পারে।
তফসিল (Schedule)
জমিজমার ক্ষেত্রে তফসিল বলতে আসলে ভূমির পরিচয়কে বুঝায়। অর্থাৎ জমিটি কোথায়, এর মালিক কে ইত্যাদির উল্লেখ থাকে। তফসিলে জেলার নাম, উপজেলা বা থানার নাম, মৌজার নাম, জমির দাগ-খতিয়ান নম্বর উল্লেখ করা হয়। এতে অনেক সময় জমির পরিমাণ, শ্রেণী এবং মালিকানার বর্ণনাও থাকে।
দাগ নম্বর
এটি কোনো সরলরেখা বা বক্ররেখা নয়। দাগ হচ্ছে জমির Plot Number। আমরা জানি মাপজোকের মাধ্যমে জমিকে একাধিক অংশে বিভক্ত করা হয়। এর প্রতিটি খণ্ডকে দাগ বা Plot বলে। জরিপের সময় এরকম প্রত্যেক খণ্ড জমিকে একটি নম্বর দ্বারা সূচিত করা হয়। এই নম্বরকেই দাগ নম্বর বলে।
দাখিলা/ খাজনা রসিদ
ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের পর তহসিল অফিস থেকে ভূমি মালিককে যে রসিদ দেওয়া হয় তাকে দাখিলা/খাজনা রসিদ বলে ।
হোল্ডিং
একটি খতিয়ানে একটি দাগ বা একাধিক দাগও থাকতে পারে। এমন একটি খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত ভূমিকে হোল্ডিং বা জোত-জমা বলে। হোল্ডিং এর পরিচিতি নম্বরকে হোল্ডিং নম্বর বলে । ১৯৫০ সালে State Acquisition(SA) আইন অনুসারে ‘হোল্ডিং’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় ।
দলিল
দলিল হচ্ছে মালিকানা প্রমাণের লিখিত সাক্ষ্য । জমির মালিকানার রেজিস্ট্রিকৃত কাগজকে দলিল বলে ।
আসাবা (রেসিডুয়ারি )
আসাবা বা রেসিডুয়ারি শব্দের অর্থ অবশিষ্টাংশ ভোগী । মুসলিম আইনে তিন ধরনের উত্তরাধিকারীর মধ্যে আসাবা এক ধরনের উত্তরাধিকারী।
হেবা বা দানপত্র দলিল
প্রাপ্ত বয়স্ক , সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি তার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা স্বত্ব অন্যের বরাবরে বিনাপণে মৌখিক বা লিখিত দলিল দ্বারা দান করলে তাকে মুসলিম আইনে হেবা বা দান বলে ।
উইল বা অছিয়ত
উইল হলো কোনো মুসলমানের সম্পত্তি বিলি ব্যবস্থা সম্পর্কিত এমন একটি আইনসম্মত ঘোষণা বা দলিল যা তার মৃত্যুর পর কার্যকর হয় । রেজিস্ট্রেশন আইন (সংশোধিত) ২০০৪ অনুযায়ী উইল রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক।
এওয়াজ বদল
পারস্পরিক সুবিধার জন্য স্থাবর সম্পত্তির দখল হস্তান্তর বা বিনিময় করাকে এওয়াজ বদল করা বলে। এতে একজন ভূমি মালিক তার জমির সাথে অন্য একজন ভূমি মালিকের জমির দখল পরিবর্তন করে থাকেন।
ওকালতনামা
মামলার বাদী বা বিবাদী তার বা তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা ও তথ্য উপস্থাপনার জন্য একজন আইনজীবীকে ক্ষমতা প্রদানের যে প্রমাণপত্র প্রদান করে তাকে ওকালতনামা বলে ।
ভূমি অধিগ্রহণ
কোনো স্থবর সম্পত্তি সরকারি প্রয়োজনে বা জনস্বার্থে আবশ্যক হলে ওই সম্পত্তি জেলা প্রশাসক কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণের বিধান ভূমি অধিগ্রহণ নামে পরিচিত।
অর্পিত সম্পত্তি
১৯৫৬ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় যেসব পাকিস্তানি নাগরিক (মূলত হিন্দু) দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন; পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সার্ভিস কর্তৃক বিধি মোতাবেক তাদের শত্রু বলে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তাদের এদেশে রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি বলে গণ্য করা হয়। ১৯৭৪ সালে ওই সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি নামকরণ করা হয়।
জমির দলিলে লেখা সংক্ষিপ্ত শব্দগুলোর পূর্ণ রূপ
পিং= পিতা, জং= স্বামী, গং= সকল, সাং= গ্রাম বা ঠিকানা, দং= দখল, মং= একত্রে, বিতং= বিস্তারিত, মোং= মোকাম, জঃ= জমা, কিঃ= কিস্তি, হেবা= দান, তোক= ভোগ, নিম/নিপসি= অর্ধেক, খারিজ= বাতিল, লায়েক= উপযুক্ত, তসদিক= সত্যায়ন, এওয়াজা= বিনিময়, রায়ত= দখলি প্রজা, ছোলেনামা= আপস, এজমালি= যৌথ মালিকানা, কিত্তা/কাতে= জমির অংশ, চৌঃ= চারদিকের সীমানা, নোনাবাড়ি= বসতবাড়ি, জোতদার= জমির মালিক।
এছাড়া,
তৌজি= প্রাপ্য খাজনার বিবরণপত্র
ছানি= পুনঃবিবেচনার জন্য পার্থনা
মৌরাশি= পুরুষানুক্রমে কোনো ভূমি ভোগ দখল করা
জোত= জমিদারের অধীনে প্রজার স্বত্ব বিশিষ্ট জমি
আরো পড়ুন:
1 Comments
ছোলেনামা কোথায় কখন পাওয়া যায়
ReplyDelete