সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

জৈব সার ব্যবহারের উপকারিতা

জমিতে কেন জৈব সার ব্যবহার করবেন
জৈব সার
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। কিন্তু সেই সঙ্গে মাটি হারিয়েছে উর্বরাশক্তি, তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহারের কারণে মাটি, পানি, পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান সবই হুমকির মুখে পড়েছে। কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহারের ফলে এরই মধ্যে আমরা অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছ, শামুক, সাপ, কেঁচো, জোঁক, বিভিন্ন প্রকার উপকারী পোকামাকড় ও পাখির অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন করে ফেলেছি। শুধু তা-ই নয়, ফসলে এখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকজনিক রোগের প্রাদূর্ভাব বেড়ে গেছে। এতে রাসায়নিক বিষের ব্যবহার আরো বেড়েছে। কারণ ফসলের রোগ বুঝে সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করতে পারার মতো শিক্ষিত হয়ে ওঠেনি আমাদের কৃষকরা। কৃষকের শিক্ষিত সন্তানরা কখনোই পূর্বপুরুষের পেশায় ফিরেনি ফলে দিনে দিনে সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে।

এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে কৃষি ও পরিবেশকে বাঁচাতে হলে প্রাকৃতিক উপায়েই মাটির উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। অনেকে মনে করেন হাইব্রিড বা উফশী ফসল উৎপাদন লাভজনক করতে হলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার করতেই হবে। আর দেশীয় আদি জাতের ফসল চাষ করে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক কৃষি সম্ভব হবে না। কথাটি আংশিক সত্য। আসল কথা হলো, প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির উর্বরতাশক্তি ধরে রাখা গেলে একটি যেমন রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো যাবে, অপরদিকে ফসলের রোগবালাইও তখন কম হবে।

জৈবসারের উপকারিতা
জৈবসারের উৎস হচ্ছে খামারজাত সার, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, জৈবিক নাইট্রোজেন সংযোগকারী বা বিএনএফ উদ্ভিদ ও জৈব উৎস হতে পাওয়া অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, সবুজ সার, অ্যাজোলা, ছাই ইত্যাদি। তাছাড়া পচানো তরল গোবর ও কিছু পচা সবজি জমিতে প্রয়োগ করলে জৈব সারের কাজ হয়।

মুরগির পচনকৃত বিষ্ঠা ও সরিষার খৈল ব্যবহারে মাধ্যমে বিভিন্ন সবজি ফসলের মাটিবাহিত রোগ দমন করা যায়। সবজি ক্ষেতের মাটিতে বিভিন্ন রোগের জীবাণু ও কৃমি বাস করে, যারা সবজির গাছ নষ্ট করে বা মেরে ফেলে। মুরগির বিষ্ঠা ও সরিসার খৈলের মধ্যে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান আছে, যা বিভিন্ন রোগ জীবাণু ও কৃমিকে মেরে ফেলে এবং সাথে সাথে মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়।

ফসলসহ সব ধরনের উদ্ভিদের পুষ্টি জোগান দেয় মাটি। অর্থাৎ গাছ মাটি থেকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে। এখন মাটিতে সে পুষ্টি আসবে কোথা থেকে? এসমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে কৃষকরা রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। যেমন: নাইট্রোজের জন্য ইউরিয়া, ফসফরাসের জন্য টিএসপি বা ডিএপি, পটাসিয়ামের জন্য এমওপি, জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট, বোরন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু এসে সমস্যা হচ্ছে, এসব সার প্রয়োগ করলে গাছ খুব দ্রুত পুষ্টি পায় ফলে দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। এজন্য এসব সার জমিতে বারবার দিতে হয়। ফলে মাটির নিজস্ব উর্বরাশক্তি থাকে না।

কিন্তু মাটিতে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান তৈরির ব্যবস্থা যদি দাঁড় করানো যায় তাহলে কেমন হয়? ঠিক এ কাজটিই জৈবসার ব্যবহারের মাধ্যমে করা যায়। মাটির প্রধান উপাদানগুলো হলো, খনিজ (অজৈব বস্তু), জৈব বস্তু, পানি ও বাতাস। জৈব বস্তু থাকলে মাটির পানি ও পুষ্টি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং উদ্ভিদের প্রয়োজনমতো পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে। ফলে রাসায়নিক সারের মতো দ্রুত পুষ্টি পেয়ে গাছ ঝাঁপিয়ে ওঠে আবার দ্রুতই নেতিয়ে পড়ে- এমন হয় না। মাটির জৈববস্তু অসংখ্য ‍উপকারী অনুজীবকে (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক) বাঁচিয়ে রাখে। এই অনুজীবেরাই কিন্তু গাছের জন্য পুষ্টি জোগায়। পাশাপাশি মাটির গঠনও উন্নত করে। আর পানির কাজ হলো মাটিতে থাকা পুষ্টি গাছের কাছে শোষণযোগ্য করে তোলা।

অর্থাৎ মাটিতেও একটি চমৎকার ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। মাটির একটি আদর্শ বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে থাকে উপকারী ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অসংখ্য অনুজীব বা আনুবীক্ষণিক জীব এবং খালি চোখে দেয়া যায় এমন উপকারী কিছু প্রাণী যেমন: কেঁচো, পোকামাকড় ইত্যাদি। কেঁচো ও পোকামাকড় যেমন লাঙ্গলের মতো মাটি উলটপাল্ট করে দেওয়ার কাজ করে পাশাপাশি তারাও অনেক পুষ্টি উৎপাদন করে এবং অনেক উপকারী অনুজীবের পোষক হিসেবে কাজ করে।

আরো পড়ুন: সার কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই ৩৪ ধরনের ফসল আবাদ

জৈবসারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে, এটি জমিতে দিলে মাটি থেকে ফসলে পুষ্টি সরবরাহের গতিতে একটি ভারসাম্য থাকে। রাসায়নিক সারের মতো দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ফসল পুষ্টি নিয়ে নিঃশেষ করে দিতে পারে না। অর্থাৎ মাটিতে যথেষ্ট জৈব উপাদান থাকলে ফসল সব সময় ব্যালেন্স ডায়েটে থাকে। খাদ্যে ভারসাম্য থাকার কারণেই ফসলের আকার আকৃতি ও শিকড়ের বৃদ্ধি যথাযথ হয়। এ কারণে বারবার সার দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু রাসায়নিক সার দিলে ফসল দ্রুত পুষ্টি শোষণ করতে থাকে ফলে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। তখন শস্যের ভারে বা ঝড়ো বাতাসে হেলে বা শুয়ে পড়ার ভয় থাকে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাসায়নিক সার কিন্তু সময় বুঝে পরিমান মতো দিতে হয়। সার দেওয়া বেশি হয়ে গেলে ফসল পুড়ে যেতে পারে। যেমন: ধানে থোড় আসার সময় ইউরিয়া প্রয়োগ করলে গোড়া পচা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু জৈব সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভয় নেই। তাছাড়া রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে অবশ্যই জমিতে সেচ দিতে হয়, কিন্তু জৈব সার প্রয়োগের আগে বা পরে সেচের প্রয়োজন নেই। কারণ জৈব সারে প্রয়োজনীয় পানি থাকে, এ সার পরিবেশ থেকেও পানি শোষণ করে ধরে রাখে। তাছাড়া জৈবসার কখনো রাসায়নিক সারের মতো ভূগর্ভস্থ পানি বা প্রবাহিত পানির সঙ্গে মিশে দূষিত করে না। জৈবসার ব্যবহার করলে ফসলের রোগবালাইও কম হয়। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার কমে।

তবে শুধু জৈব সারের ওপর নির্ভর করে ফসলের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া কঠিন। কারণ ঘরে প্রচলিত পদ্ধতিতে তৈরি জৈবসারে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে না। বা থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। আর সবার বাড়িতে জৈবসার তৈরির মতো যথেষ্ট উপাদানও নেই। মানসম্মত জৈবসার তৈরি করতে হলে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। যাই হোক না কেন, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনমতো জৈবসার প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই।

Post a Comment

0 Comments