সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

আগাম শীতকালীন সবজিতে ভালো দাম পেতে করণীয়: সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ

কলাপাতার মোড়কে সবজি বাজারজাতকরণ
পরিবেশবান্ধক মোড়ক কলাপাতায় সবজি প্যাকেজিং
শীতকাল (পৌষ-মাঘ) শুরুর অন্তত মাসখানেক আগে অর্থাৎ হেমন্তকালেই  (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) যেসব আগাম জাতের শীতকালীন সবজি সংগ্রহ করার উপযুক্ত হয় সেগুলোকে বলে শীতের আগাম সবজি। এ ধরনের সবজি চাষে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা করা সম্ভব। কারণ বাজারে তখন সবজির বেশ সঙ্কট থাকে। আর শীতকালীন সবজির তখন অনেক চড়া দামে বিক্রি করা যায়।  শীতের আগাম সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, লাউ, মুলা, আলু, কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া অন্যতম।

তবে আগাম শীতের সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে সঠিক নিয়মে সবজি সংগ্রহ এবং বাজারজাত করার বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন না করলে সবজির মান খারাপ হতে পারে। তাতে ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে।

এজন্য কিছু বিষয় খেয়াল রেখে সঠিক নিয়মে সঠিকভাবে আগাম সবজি ফসল কোমল ও সতেজ অবস্থায় সংগ্রহ করে বাজারজাত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদিত সবজি দেরিতে সংগ্রহ করা হলে গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। আবার বেশি কচি অবস্থায় সংগ্রহ করলে ফলন অনেকখানি কম হবে। পরিবহনের সময় সবজির মানও দ্রুত নষ্ট হবে। তাই সবজি ফসল তখনই সংগ্রহ করতে হবে যখন এসব ফসল খাওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে এবং বেশি দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। উপযুক্ত পর্যায়টি হলো পরিপক্ব হওয়ার ঠিক আগে।

সবজির ধরনভেদে সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল
১. টমেটো, বেগুন, শসা, কুমড়া: এসব সবজিকে বোঁটা থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে গাছ থেকে আলাদা করে নিতে হবে।
২. চারা গাছ পাতলা করার সময় ছোট গাছ হিসেবে লালশাক, পালংশাক এসব শাক সংগ্রহ করে নিতে হবে । 
৩. পালংশাক, লালশাক, মুলাশাক সংগ্রহের সময় সম্পূর্ণ গাছটি শিকড়সহ উপড়ে ফেলে সংগ্রহ করতে হবে।
৪. শাক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পুঁইশাক ও লাউয়ের ডগা প্রুনিং বা ছাঁটাই করার সময় গাছের অংশ কেটে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো সংগৃহিত সবজি কখনো বাঁশের ঝাঁকা, ডালি/ডালা বা ভেতরের অংশ অমসৃণ খড়খড়ে এমন পাত্রে রাখা যাবে না। প্লাস্টিক বা অ্যালুমিনিয়ামের গামলা, বালতিতে রাখতে পারলে ভালো।

বিভিন্ন সবজি সংগ্রহের উপযুক্ত সময়
বেগুন: ফল যথেষ্ট কচি অবস্থায় তবে এটি পরিপূর্ণ আকার এবং রঙ প্রাপ্তির পর সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢেঁড়স :  কোমল ও কচি অবস্থায় ঢেঁড়সের ফল তুলতে হবে, তা না হলে ফল শক্ত ও খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফল বের হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পর ঢেঁড়স খাওয়ার উপযোগী হয়। ফল তোলা না হলে কান্ডের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন কম হয়।

ধুন্দল :  বীজ বোনার দেড় থেকে দুইমাস পর থেকে ধুন্দল ফল ধরা শুরু হয় এবং এটি দুই-তিন মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। গাছে ফল ধরার ৮ থেকে ১০ দিন পরেই সংগ্রহ উপযোগী হয়। ফল কচি অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত, এতে পুষ্টিমান বজায় থাকে। বেশি পরিপক্ব ফলের স্বাদ ও পুষ্টিমান দুটিই কমে যায়।

বরবটি : শুঁটি পরিপূর্ণ লম্বা ও মোটা হলে এবং বীজের অংশ সামান্য স্ফীত হতে শুরু করলে বরবটি তোলা যাবে।

লাউ : ফলের ত্বকের লোমশ ভাগ পরিপক্বতার সাথে সাথে কমতে থাকে, ফলের লোমশ ঘনত্ব দেখেও এর সংগ্রহ উপযোগিতা নির্ণয় করা যায় এবং সংগ্রহ করতে হয়।

মুলা : বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর থেকে সংগ্রহ করা যায়। শাকের জন্য ঘন করে লাগালে ফসল ২০ দিন পর এবং মুলার জন্য ৪০ দিন পর থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত সংগ্রহ করা যাবে।

শিম : ফুল ফোঁটার ২০-২৫ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। শুটি পরিপূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে এর বীজের অংশ কিছুটা স্ফীত হওয়ার পর পরই সংগ্রহ করতে হবে। তবে অতিরিক্ত পরিপক্ব শুটিতে আঁশ জন্মালে কোমলতা ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।

সবজি সংগ্রহের সময় সতর্কতা
হাত দিয়ে মোচড় দিয়ে কখনো সবজি ফসল সংগ্রহ করা যাবে না, এতে মাতৃ গাছের ক্ষতি হয়। মোচড়ানোর ফলে গাছে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে রোগ জীবাণুর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ক্ষতি এড়ানোর জন্য ধারালো ছুরি বা ক্লিপার/কাচি দিয়ে সংগ্রহ করা উচিত। ফসল সংগ্রহ করে ফসল তোলার পাত্রে রাখতে হবে ।

সবজি সংগ্রহ থেকে বাজারে নেয়া পর্যন্ত কার্যক্রমকে বাজারজাতকরণ বলা হয়ে থাকে। আর যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখলে বাজারজাতকরণ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করে শাকসবজির সংগ্রহের ক্ষতির পরিমাণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।

বাজারজাতের সময় যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে
ক. মাঠে থাকা অবস্থায় সংগ্রহের সময় সবজির গায়ে ধুলাবালি লাগতে পারে। এজন্য সংগ্রহের পর পরই পরিষ্কার পানিতে সবজি ধুয়ে নিলে আকর্ষণ বাড়ে এবং নেতিয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে। তবে অপরিষ্কার পানিতে ধোয়া উচিত নয়, কেননা রোগ-জীবাণুর আক্রমণের আশংকা বৃদ্ধি পায়।

খ. নিকটবর্তী বা দূরের বাজারে পাঠানোর আগে আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য ছাঁটাই করতে হবে। খুব ধারালো ছুরি দিয়ে ছাঁটাই করতে হবে। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ও বিবর্ণ অংশ ছেঁটে ফেলতে হবে।

গ. আকর্ষণ এবং মূল্য বাড়ানোর প্রয়োজনে সর্টিং এবং গ্রেডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সবজি ভেদে আকার-আকৃতি, বর্ণ, বাত্তি, কচি, পরিপক্বতা অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে গ্রেড করতে হবে।

ঘ. যেহেতু রসালো সবজি সংগ্রহ করার পরও শ্বসন প্রক্রিয়া চলতে থাকে, সে জন্য মাঠ থেকে সংগ্রহের পর  ঠাণ্ডা ঘরে অল্প সময়ের জন্য রাখতে হবে যাতে তাপমাত্রা নেমে গিয়ে বাইরের চেয়ে ঠাণ্ডা হয়। এতে সবজির গুণাগুণ ভালো থাকবে। দ্রুত শুকিয়ে যাবে না।

ঙ. দূরে পাঠাতে বা অনেকক্ষণ সবজি টাটকা রাখার জন্য মোড়ক লাগানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সংখ্যক সবজি সংগ্রহের পর পরই খুব কম সময়ের মধ্যেই পানি বেরিয়ে গিয়ে নেতিয়ে পড়ে। এসব শাকসবজি বাজারজাত করা খুবই অসুবিধাজনক। তাই এগুলো ঠাণ্ডা করে খুব পাতলা ও স্বচ্ছ পলিথিনের ব্যাগে রাখলে দীর্ঘ সময় তাজা থাকবে। সব ধরনের শাক, ব্রোকলি, শিম, লেটুস, ধনিয়াপাতা এগুলোকে মোড়কায়ন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

চ. মোড়কায়নের পর দূরের বাজারে পরিবহনের সময় সবজি যাতে আঘাত না লাগে সেজন্য বস্তা বন্দি না করে বায়ু চলাচলের সুবিধাযুক্ত প্লাস্টিক, কাঠ, বাঁশের খাঁচা অথবা কার্ড বোর্ডের বাক্সে ভরে দেওয়া উচিত। পরিবহনের সময় ট্রাকের ও ট্রেনের বগিতে পরিচ্ছন্নতা ও বাতাস চলাচলের বিশেষ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
ট্রাকে সবজি পরিবহনে সতর্কতা
সবজি পরিবহন
আজকাল শাক, ধনিয়াপাতা ও লেটুসপাতা দূরে পরিবহনের জন্য অনেকে বাঁশের খাঁচায় স্তরে স্তরে বরফকুচি বিছিয়ে সাজিয়ে নেন। এতে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা তরতাজা থাকে। গরমের সময় দূরে সবজি পরিবহনে এটি উত্তম উপায়। আর সবজি পরিবহনের আরো নানা কৌশল সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে চাইলে রাত ১০টার পর ঢাকার কাওরান বাজারে সবজির আড়ত ঘুরে যেতে পারেন।

Post a Comment

0 Comments