ইউরোপের বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি |
একটি ব্যবিলনীয় ট্যাবলেটে পাওয়া ১৬শ থেকে ১৭শ খ্রিস্টপূর্বাব্দের রেসিপিতে রান্নার উপকরণ হিসেবে পেঁয়াজের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাত্ ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবিলনীয় সংস্কৃতি থেকেই মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম পেঁয়াজের চাষ শুরু হয় বলে ধরে নেয়া যায়।
একাধিক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, প্রথম পেঁয়াজের আবাদ হয় ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে। এছাড়া উত্তরপশ্চিম ভারত, বেলুচিস্তান এবং আফগানিস্তানেও প্রাগৈতিহাসিককালে পেঁয়াজের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়।
বহুস্তরীয় কন্দটির নামকরণ নিয়েও নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। এর ইংরেজি ‘অনিয়ন’ নামটি আদি নামের সবচেয়ে কাছাকাছি বলে মনে করা হয়। ধারণা করা হয়, ১৭০৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সুয়েজ উপসাগরের তীরে ইহুদি রাজা অনিয়ার (ONIA) নির্মিত শহরের নামেই পেঁয়াজের নামকরণ হয়।
বেশিরভাগ গবেষক একমত, অন্তত পাঁচ হাজার বছর বা তার আগে পেঁয়াজের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। তবে আরো আগে থেকেই মানুষ বুনো পেঁয়াজ সংগ্রহ করে খেত। আর কৃষিযুগের শুরুতে যেসব ফসল চাষাবাদ শুরু হয় তার মধ্যে পেঁয়াজ প্রথম সারিতেই ছিল। অন্যান্য ফসলের চেয়ে তুলনামূলক দীর্ঘ সময় সংরক্ষণযোগ্য, সহজে পরিবহনযোগ্য, যে কোনো মাটি ও জলবায়ুতে কম পরিশ্রমেই চাষ করা যায় এসব সুবিধার কারণে জনপ্রিয় ফসলে পরিণত হয় পেঁয়াজ।
জন্মস্থান ও জন্মকালের হদিশ না মিললেও খাদ্য হিসেবে এবং শিল্পে, চিকিত্সায় এবং মমি তৈরিতে পেঁয়াজের ব্যবহার যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল তার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।
আপত্কালীন খাদ্য হিসেবেও পেঁয়াজের ব্যবহার ছিল। পেঁয়াজ তৃষ্ণা মেটায়। খাদ্য সংকট মোকাবেলায় এটি শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হতো।
চীনের সবজি বাগানে পেঁয়াজ জায়গা করে নেয় অন্তত ৫ হাজার বছর আগে। ভারতে বৈদিক যুগের বিভিন্ন লিখিত দলিলে পেঁয়াজের কথা উল্লেখ আছে। মিশরে ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পেঁয়াজের অস্তিত্ব মিলেছে। প্রাচীন সুমেরীয়রা ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেও ব্যাপকভাবে পেঁয়াজ চাষ করতো এবং রান্নায় ব্যবহার করতো। ক্রিটের কোসোসে রাজপ্রাসাদে ৪০০০ বছর আগে পেঁয়াজ চাষ ও রান্নার প্রমাণ মিলেছে।
আরো পড়ুন: [পেঁয়াজের বিকল্প চিভ]
তবে মিশরে আসার পর পিঁয়াজের ব্যবহার শুধু খাদ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। মিশরে পেঁয়াজ রীতিমতো পুজনীয় বস্তু ছিল। সম্ভবত অসংখ্য শল্কপত্রের কারণে পেঁয়াজকে অনন্তের প্রতীক মনে করছো মিশরীয়রা। একটি পেঁয়াজ আড়াআড়ি কাটলে অনেকগুলো বৃত্ত তৈরি হয়। একটি বৃত্তের ভেতরে আরেকটি বৃত্ত। এটি অনন্ত জীবনের প্রতীক মনে করা হয়। এ কারণে ফেরাউনের মৃতদেহের সঙ্গে পেঁয়াজও সমাহিত করা হতো। পিরামিডের দেয়ালে পেঁয়াজের ছবি রয়েছে। দেবতার প্রতীক হিসেবেও পেঁয়াজ রাখতেন মিশরীয় ধর্মগুরুরা।
মিশরে পিরামিডে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সমাধিতে খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজের ব্যবহার সংশ্লিষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, পিরামিড নির্মাণ শ্রমিকদের পেঁয়াজ খেতে দেয়া হতো। মিশরীয়দের ধারণায় এ কন্দ টনিকের কাজ করে।
খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজের উল্লেখ আছে বাইবেল এবং কোরানেও।
প্রাচীন মিশরে দেবতার নৈবেদ্য দেওয়া হতো পেঁযাজ |
ভারতেও অতি প্রাচীনকাল থেকে পেঁয়াজের আবাদ হয়ে আসছে। ভারতের ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লিখিত চরম সংহিতায় পেঁয়াজকে মূত্রবর্ধক, হজমে সহায়ক, হূিপণ্ড, চোখ এবং অস্থিসন্ধির জন্য উপকারী ভেষজ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে গ্রিক শারীরতত্ত্ববিদ ডিওসকরিডেস লিখে গেছেন পেঁয়াজের একাধিক ওষুধি গুণের কথা।
অলিম্পিক গেমের জন্য প্রস্তুত করতে গ্রিকরা ক্রীড়াবিদদের পেঁয়াজ খেতে দিত। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ক্রীড়াবিদরা প্রচুর পরিমানে কাঁচা ও রান্না পেঁয়াজ, পেঁয়াজের জুস খেত। শরীরেও ঘষা হতো পেঁয়াজ।
রোমানরা নিয়মিত পেঁয়াজ খেত। তাদের হাতেই তত্কালীন রোমান প্রদেশ ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে পেঁয়াজের আগমন ঘটে। রোমান লেখক, প্রকৃতিবিদ প্লিনি দ্য এলডার পম্পেই নগরীর বাঁধাকপি ও পেঁয়াজের কথা লিখে গেছেন। ইতিহাস বিখ্যাত সেই অগ্ন্যুত্পাতে প্রাণ হারানোর আগে প্লিনি পেঁয়াজ নিয়ে রোমানদের নানা বিশ্বাসের কথা লিখে গেছেন।
ক্ষীণদৃষ্টি, ঘুমের সমস্যা, মুখের ঘা, কুকুরে কামড়ানো, দাঁতের ব্যথা, আমাশয় ও কোমড়ের ব্যথায় পেঁয়াজ অব্যর্থ মহৌষধ বলে বিশ্বাস করতো রোমানরা। গ্লাডিয়েটরদের এরিনায় পাঠানোর আগে শরীরে পেঁয়াজের রস মালিশ করা হতো। এটি শক্তিবর্ধক বলে বিশ্বাস ছিল তাদের।
আরো পড়ুন: [উচ্চফলনশীল পেঁয়াজের চাষ পদ্ধতি]
মধ্যযুগে ইউরোপের রন্ধনশিল্পে শিম ও বাঁধাকপির পাশাপাশি অপরিহার্য সবজি হয়ে ওঠে পেঁয়াজ। গরীব-ধনী সব শ্রেণীর মানুষই এটি সবজি হিসেবে খেত। ইউরোপীয়রা এ সবজিকে খাদ্যের পাশাপাশি মাথাব্যথা, সাপে কামড়ানো এবং চুল পড়ার উপশমে কার্যকর বলে বিশ্বাস করতো। এছাড়া বিভিন্ন ভাড়া পরিশোধে দেয়া হতো পেঁয়াজ। এমনকি উপহার সামগ্রী হিসেবেও পেঁয়াজের একটা মর্যাদা ছিল।
মধ্যযুগে ইউরোপে পেঁয়াজের অনেক কদর ছিল |
১৬২০ সালে বিখ্যাত মেফ্লাওয়ার জাহাজে চেপে প্রথম ব্রিটিশ পিউরিটানরা (প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান) সঙ্গে করে পেঁয়াজ নিয়ে গিয়েছিল আমেরিকায়। কিন্তু নতুন ভূমিতে পা ফেলেই তারা দেখতে পায় উত্তর আমেরিকারজুড়ে বুনো পেঁয়াজের একটি জাত চাষাবাদ হচ্ছে। নেটিভ আমেরিকানরা এ পেঁয়াজ নানা কাজে ব্যবহার করতো। তারা কাঁচা অথবা সেদ্ধ করে খেতো। ব্যথা, জ্বালাপোড়া ও প্রদাহের চিকিত্সায় পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। এমনকি খেলার সামগ্রির মধ্যেও পেঁয়াজ ছিল। ঔপনিবেশিকদের ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৬৪৮ সালে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে পেঁয়াজ চাষ শুরু করে ব্রিটিশ পিউরিটানরা, যাদের বলা হয় পিলগ্রিম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রুশ সেনারা সঙ্গে সব সময় পেঁয়াজ রাখতো। যুদ্ধাহতদের ক্ষততে এটি এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
উত্তেজক গুণ ও গন্ধের কারণে নানা ধর্ম ও সংস্কৃতিতে নানা সময় পেঁয়াজ খেতে নিরুত্সাহিত করা হয়েছে। যেমন: হিন্দুধর্মে সন্যাসীদের পেঁয়াজ খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। আবার ইসলাম ধর্মে এবাদতের আগে কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়া মাকরুহ বা অপছন্দনীয় বলা হয়েছে।
পেঁয়াজ নিয়ে অনেক লোককথাও প্রচলিত রয়েছে। ঝাঁঝালো গন্ধের কারণে এটি ছিল প্রাচীন মানুষের কাছে এক রহস্য। তুরস্কের এক কিংবদন্তীতে আছে, শয়তানকে যখন বেহেশত থেকে পৃথিবীতে ছুঁড়ে ফেলা হয়, তখন তার বাঁ পা-টি যেখানে পড়ে সেখান থেকে গজিয়ে ওঠে রসুন, আর ডান পায়ের স্থান থেকে গজায় পেঁয়াজ। পূর্ব ইউরোপে প্লেগ মহামারির সময় মানুষ জানালায় পেঁয়াজ ও রসুন ঝুলিয়ে রাখতো। এতে করে অশুভ আত্মা দূরে চলে যাবে বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। এছাড়া ইউরোপের মানুষ ভ্যাম্পায়ারের কবল থেকে বাঁচতে ঘরের প্রবেশপথ, জানালা এবং গলায় পেঁয়াজ-রসুনের মালা ঝুলিয়ে রাখতো।
আরো পড়ুন: [টবে পেঁয়াজ চাষ] [পাতা পেঁয়াজ চাষ]
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ থাকলেও অন্য যেকোনো সবজি বা মসলার মধ্যে পেঁয়াজের ব্যবহার সবচেয়ে দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে বিশ্ব্যাপী প্রতি বছর ৯২ লাখ হেক্টর জমিতে ৯ কোটি ৮৯ লাখ টন পেঁয়াজ উত্পাদন হয়। সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ চাষ হয় চীনে, এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। ইরান, মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান, রাশিয়া অন্যতম পেঁয়াজ উত্পাদক দেশ। ভারতে বর্তমানে প্রতিবছর গড়ে ২ কোটি ২৪ লাখ টন পেঁয়াজ উত্পাদন হয়।
তথ্যসূত্র: জাতীয় পেঁয়াজ সমিতি, যুক্তরাষ্ট্র; অরিজিন অ্যান্ড হিস্ট্রি অব অনিয়নস, ড. ইন্দু মেহতা; এফএও
0 Comments