সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

পাঁচ হাজার বছর আগের এক উন্নত কৃষি প্রযুক্তি: মিলপা

মিলপা: একসঙ্গে ভুট্টা, শিম বা বরবটি আর মিষ্টি কুমড়া বা স্কোয়াশ চাষ
ভুট্টা-শিম-মিষ্টি কুমড়া একসঙ্গে চাষ
মিলপা, অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগের একটি কৃষি প্রযুক্তি। আধুনিককালে যেটিকে বলা হয় সাথি ফসল বা আন্তঃফসল। দুই বা ততোধিক ফসল একসঙ্গে চাষ করার মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীলতা ও ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির কৌশল এটি। এ কারণে সাধারণত ক্ষুদ্র বা মাঝারি চাষীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ফসল উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধির জন্য এ কৃষি প্রযুক্তির বিস্তারে উৎসাহ দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে ফসল বুনলে বিরূপ আবহাওয়া বা পোকামাকড়-রোগবালাইয়ে কৃষকের নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ নিদেনপক্ষে কোনো একটি ফসল টিকে যায়। বাংলাদেশের পাহাড়ে জুমচাষ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আধুনিক কৃষিতে সাথি ফসল হিসেবে বৃক্ষ বা গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের (সুপারি, তুলা) সঙ্গেও হলুদ, আদা, মরিচ, ক্যাপসিকাম, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি চাষ করা হয়। কিন্তু এতে মাটির গুণাগুণ ও ফসলের আন্তঃসহযোগিতার পরিবেশ সেভাবে রক্ষিত হয় না। প্রাচীনকালের মানুষ এর চেয়ে অনেক কার্যকর আন্তঃফসল আবিষ্কার করতে পেরেছিল। তাতে যেমন একটি ফসলের সহযোগিতায় অন্যটি পুষ্ট হতো, তেমনি রক্ষিত হতো মাটির গুণাগুণ।

মেসো আমেরিকা অঞ্চলে (মধ্য মেক্সিকো থেকে বেলিজ, গুয়াতেমালা, এল সাভাদর, হুন্ডুরাস, নিকারাগুয়া ও উত্তর কোস্টারিকা) এ ধরনের চাষাবাদের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেই উত্তর আমেরিকার আদিবাসীরা এ কৌশলে ফসল আবাদ করতেন। মেসো আমেরিকা অঞ্চলে এ কৌশল মিলপা নামে পরিচিত।

মিলপা শব্দটি নাহুয়াতল (ইউটো-আজটেক ভাষা শ্রেণী) ভাষার শব্দ। এর অর্থ ভুট্টাক্ষেত। এ চাষ পদ্ধতিতে প্রাচীন মেসো আমেরিকান আদিবাসীরা তিনটি ফসল একসঙ্গে আবাদ করতেন। এ ফসল তিনটিকে বলে থ্রি সিস্টার বা তিন বোন। এতে যেমন প্রতিটি ফসলের ফলন বাড়ে, তেমনি বাড়ে জমির উর্বর শক্তি। আদিবাসীরা টানা দুই বছর মিলপা পদ্ধতিতে চাষ করার পর টানা আট বছর আর আবাদ করতেন না। মেক্সিকোর ইউকাতান উপদ্বীপজুড়ে মিলপা প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ছিল।

কৃষিবিদরা বলেন, আন্তঃফসল হিসেবে একবর্ষজীবী ফসলের সঙ্গে বহুবর্ষজীবী ফসলের চাষ করা যেতে পারে। আবার একবর্ষজীবীর সঙ্গে একবর্ষজীবী এবং বহুবর্ষজীবীর সঙ্গে বহুবর্ষজীবী প্রজাতির ফসলও আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করা যায়। আধুনিক আন্তঃফসল পদ্ধতি মোটামুটি চার ধরনের হতে পারে:

১. সারি: একটি ফসল সারিবদ্ধভাবে রোপণ করে আরেকটি বা অন্য একাধিক ফসল সারি বা ছড়ানো ছিটানোভাবে রোপণ বা বোনা।

২. মিশ্র-আন্তঃফসল: দুই বা ততোধিক ফসল জমিজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বোনা। ভুট্টা ও শিমজাতীয় ফসল এভাবে ভালো হয়।

৩. স্ট্রাইপ বা কান্দি: কাছাকাছি নিয়মিত ব্যবধানে প্রশস্ত সারিতে (কান্দি) আলাদা করে দুয়ের অধিক ফসল ফলানো। লম্বালম্বি প্রতিটি খণ্ডে প্রতিটি ফসল আলাদা কান্দিতে থাকলেও একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব খুব কম থাকে।

৪. রিলে: ফসলের জীবত্কাল বিবেচনায় একসঙ্গে একাধিক ফসল চাষ পদ্ধতি এটি। একটি ফসল যখন তোলার সময় হয়, তখন দ্বিতীয় ফসলটি প্রায় ফল দেয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।

প্রাচীন আন্তঃফসল চাষ পদ্ধতি মিলপায় তিনটি প্রজাতির ফসল বেছে নেয়া হতো। এ তিন ফসলকে আধুনিক কৃষিবিদরা বলেন ‘তিন বোন’। খাড়া লম্বা ঘাসজাতীয় ফসল ভুট্টা, নাইট্রোজেন ধারক লিগিউম জাতীয় ফসল শিম বা বরবটি এবং লতানো উদ্ভিদ স্কোয়াশ বা মিষ্টি কুমড়া হলো এ তিন বোন।

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, বহু আগেই আমেরিকার আদিবাসীরা একসঙ্গে ফসল চাষ করার সুফল আবিষ্কার করেছিলেন। অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে এমন চাষ পদ্ধতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ধরনের চাষ পদ্ধতির সুফল সম্পর্কে কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।

ঐতিহাসিক নানা তথ্যপ্রমাণে ভুট্টা, শিম ও মিষ্টি কুমড়া চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেছে। কৃষকরা জমিতে গর্ত করে শস্যের বীজ পুঁতে দিতেন। ভুট্টা দ্রুত লম্বা হয়। তখন শিমজাতীয় ফসল ভুট্টাগাছ বেয়ে বড় হয়, ফলে পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেতে পারে। আর স্কোয়াশ বা মিষ্টি কুমড়ার লতা ভুট্টা ও শিমের ছায়ার মধ্যে মাটিতে হামাগুড়ি দিতে দিতে বড় হয়। মিষ্টি কুমড়ার লতার কারণে বাকি ফসল দুটি অনাকাঙ্ক্ষিত আগাছা থেকে মুক্ত থাকে।

মাটির পুষ্টি সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতি
তিন বোনের সমন্বয়ে জমিতে যে একটি ক্ষুদ্র প্রতিবেশ তৈরি হয়, তা উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য খুবই উপযোগী। ভুট্টা সাধারণত মাটি থেকে দ্রুত নাইট্রোজেন শুষে নেয়। কিন্তু শিমজাতীয় ফসল শিকড়ের নডিউলে জমা করে নাইট্রোজেন ও তা মাটিতে উন্মুক্ত করে। এটি অনেকটা শস্য পর্যায় কৌশলের মতো। অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে শস্য আবাদ না করেও সে সুফল পাওয়া যায়।

কৃষি বিজ্ঞানীরা মনে করেন, একই জমিতে একসঙ্গে এ তিন ফসল চাষের মাধ্যমে আধুনিক এক ফসলের তুলনায় বেশি পরিমাণে আমিষ ও কার্বোহাইড্রেট উৎপাদন সম্ভব।

এভাবে ফসল আবাদ করলে ভুট্টা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে দেয়। এতে ভুট্টাগাছ আরো সোজা ও লম্বা হয়। শিম, বরবটি বা শুঁটিজাতীয় ফসল ওই ভুট্টাগাছ বেয়ে ওঠে; ফলে আরো বেশি পরিমাণে সূর্যালোক পেতে পারে, সেসঙ্গে পরিবেশ থেকে নাইট্রোজেন আহরণ করে। শিমের নডিউল থেকে সেই নাইট্রোজেনের ভাগ পায় ভুট্টা। মিষ্টি কুমড়াজাতীয় ফসল ভালো হয় ছায়াযুক্ত, আর্দ্র স্থানে। ভুট্টা ও শিম যৌথভাবে সে পরিবেশটাই নিশ্চিত করে।

তাছাড়া মিষ্টি কুমড়া মাটির ক্ষয় রোধ করে। আধুনিক একক ফসল চাষ পদ্ধতিতে ভূমিক্ষয় এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মিলপা চাষ পদ্ধতি নিয়ে ২০০৬ সালে একটি গবেষণা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ভুট্টার সঙ্গে আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করলে শিম বা বরবটির নাইট্রোজেন ধারক নডিউলের সংখ্যা যেমন বাড়ে, তেমনি ফলের শুষ্ক ওজন (ড্রাই ওয়েট) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

তাছাড়া এ তিন বোন একসঙ্গে উত্কৃষ্ট খাদ্য। ভুট্টা কার্বোহাইড্রেট এবং কিছু অ্যামাইনো অ্যাসিডের উৎস, শিমে রয়েছে বাকি অ্যামাইনো অ্যাসিডের পাশাপাশি ফাইবার, ভিটামিন বি২ ও বি৬, জিংক, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস। আর মিষ্টি কুমড়ায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ।

মিলপার প্রত্ন ও নৃতাত্ত্বিক কাল
তিনটি ফসল একসঙ্গে চাষ করার কৌশল মানুষ ঠিক কবে আবিষ্কার করেছিল, তা বলা মুশকিল। গবেষকদের মতে, কৃষিকাজ শুরু করে মানুষ মোটামুটি ১০ হাজার বছর আগে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন শস্য ও পশু-পাখি মানুষ চাষ ও পালন করতে শুরু করে। মূলত লেভান্ত অঞ্চলের মানুষই প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। বর্তমান সিরিয়াকেই সাধারণত লেভান্ত অঞ্চল ধরা হয়।

আন্তঃফসল হিসেবে ভুট্টা, শিম ও মিষ্টি কুমড়া চাষের শুরুটা জানা না গেলে এগুলো মানুষ কবে থেকে আবাদ শুরু করল, তা জানা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, শিমজাতীয় ফসল আবাদের শুরু দক্ষিণ আমেরিকায় প্রায় ১০ হাজার বছর আগে। মধ্য আমেরিকায় একই সময় শুরু মিষ্টি কুমড়া বা স্কোয়াশ চাষ। আর মধ্য আমেরিকায় ভুট্টা চাষ শুরু হয় এর এক হাজার বছর পর। যদিও প্রায় সাত হাজার বছর আগে মধ্য আমেরিকার কোথাও শিম চাষের প্রমাণ নেই। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়, মেসো আমেরিকা অঞ্চলে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আন্তঃফসল হিসেবে এ তিন ফসলের চাষ ব্যাপক বিস্তৃতি পায়।

মিলপা চাষ পদ্ধতি
চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাতে বোঝা যায়, আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে কৃষিকাজে লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবণ্টন ছিল। পুরুষদের কাজ ছিল নতুন আবাদযোগ্য জমি সৃষ্টি করা, ঘাস পুড়িয়ে ফেলা ও ফসল আবাদের জন্য সমতল করা। নারীরা জমি চাষ, ফসল বোনা, আগাছা দমন এবং ফসল সংগ্রহের কাজ করত।

ওই সময় ফসলের ফলনও বেশ কম ছিল। হেক্টরপ্রতি ফসল পাওয়া যেত ৫০০ থেকে ১ হাজার কেজি। এ ফসল থেকেই আসত পরিবারের প্রয়োজনীয় ক্যালরির ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ। মিসিসিপি অঞ্চলে মানুষ সামাজিক গোলায় ফসল সংরক্ষণ করত।

ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস, থটকোডটকম, উইকিপিডিয়া অবলম্বনে

Post a Comment

0 Comments