সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

হারিয়ে যাওয়া বাংলার কৃষকদের উদ্ভাবিত নিড়ানী যন্ত্র

ঐতিহ্যবাহী নিড়ানী যন্ত্র
বিন্দা মই
কৃষিকাজের শুরুতেই সম্ভবত মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদকে আগাছা বলে শনাক্ত করতে পেরেছিল। কারণ সে অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে কাঙ্ক্ষিত ফসলের মধ্যে অন্যান্য উদ্ভিদ বা লতাপাতা জন্মালে তার ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তখন সে আগাছা পরিষ্কার করাটা অত্যাবশ্যকীয় কাজ বলে ঠিক করেছে। আর এ কাজটি সহজ করতে পরবর্তীতে উদ্ভাবন করেছে নানা যন্ত্রপাতি। প্রথমে হাত দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতো মানুষ। এরপর কাঠ, পশুর হাড়, পাথর, এরপর কোনো চোখা ধাতব অস্ত্র দিয়ে আগাছা পরিষ্কারের কৌশল উদ্ভাবন করেছে মানুষ। কৃষিযন্ত্র হিসেবে নিড়ানীর উদ্ভাবন ও এ ধারাবাহিকতাটাকে মানব সভ্যতার বিবর্তনের সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই মনে হয় ।

আমাদের দেশের মানুষও একসময় বিভিন্ন ধরনের নিড়ানী যন্ত্র ব্যবহার করতো। আধুনিক যন্ত্রের আগমন, পাশাপাশি নানা ধরনের হার্বিসাইড বা আগাছনাশক বাজারে আসার পর সেগুলো সবাই ভুলেই গেছে। তবে এর মধ্যে আগাছানাশক বিষ দামে সস্তা এবং জমিতে স্প্রে করা বা সারের সঙ্গে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিলেই আগাছা দমন করা যায়, এতে শ্রমিক খরচও বেঁচে যায়- এসব সুবিধার কারণে মানুষ এ বিষ ব্যবহারের দিকেই ঝুঁকেছে। এর ফলে এরই মধ্যে আমরা উপকারী বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি হারিয়েছি। বিশেষ করে ফসলের পোকা খাওয়া পাখি, ইঁদুর, সাপ, কেঁচো, ব্যাং, শামুক, নানা ধরনের জলজ পোকা, দেশীয় ছোট মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর ফলে আমরা আমাদের মাটি ও পরিবেশের যে ক্ষতি করেছি তা স্বাভাবিক অবস্থায় আদৌ কোনোদিন ফিরবে কি না সন্দেহ রয়েছে!

আগাছ দমনে আমাদের পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত কয়েকটি হারিয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো:

বিন্দা মই/ বিন্দা/ বিদা
আগাছা দমনের চমৎকার একটি যন্ত্র। এটি কৃষকরা বাড়িতেই বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি করতেন। বিনাখরচেই তৈরি করা যেত। বিশেষ করে ছিটিয়ে বোনা ফসলের আগাছা দমনে এ যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। এটি কৃষকদের কাছে বিন্দা মই, বিন্দা, বিদা বা বিদে নামে পরিচিত। পাঁচ /ছয় হাত লম্বা মোটা একটি বাঁশে নিয়মিত দূরত্বে ছিদ্র করে আধা ফুট লম্বা বাঁশের টুকরা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মাঝখাতে আড়াআড়ি আরেকটি বাঁশ লাঙ্গলের ঈশের মতো করে বেঁধে দিতে হয়। এ বাঁশ ধরেই বিন্দাটি টানা হয়।  এর সঙ্গে জোয়াল লাগিয়ে গরু জুড়ে দিয়েও টানা যায়। পাটের আগাছা নিড়ানী এবং বেশি ঘন পাট পাতলার করার কাজে বিন্দা ব্যবহার করা হয়।
গরুই টানা বিন্দা বা বিদা
গরুই টানা বিন্দা বা বিদা
হস্তাচালিত বিন্দা বা বিদা
হস্তাচালিত বিন্দা বা বিদা
আঁচড়া
এটিও এক ধরনের বিন্দা বা বিদে। একটি বাঁশ বা কাঠের দণ্ডের মাথায় একগুচ্ছ লোহার শিক/রড কোঁচার মতো করে বেঁধে দিতে হবে। লোহার রডগুলোর মাথা ফলার মতো করে নিতে হবে এবং রডগুলোর শেষের অংশ নিচের দিকে বাঁকানো থাকবে। একজন হাত দিয়ে টেনে নেওয়ার জন্য পাঁচটি রড দিয়ে একটি আঁচড়া বানানো যেতে পারে। এ ধরনের আঁচড়া দিয়ে সারি করে লাগানো ফসল যেমন: ভুট্টা, আলু, সয়াবিনের আগাছা নিড়ানী দেওয়া এবং একই সঙ্গে মাটি আলগা করার কাজ করা যায়।
কম খরচে তৈরি নিড়ানী আঁচড়া
আঁচড়া

নিড়ানী/ দাউলা
সামনের অংশ প্রসারিত কাস্তের মতো একটি যন্ত্র। এটি নিড়ানী, দাউল এরকম নানা নামে পরিচিত। বাজারে পাওয়া বা কামারের কাছ থেকে বানিয়ে নেওয়া যায়। দাউল দুই ধরনের হয়: একটির প্রসারিত মাথাটি বাম দিকে বাঁকানো, আরেকটির প্রসারিত মাথা নিচের দিকে বাঁকানো। এ ধরনের নিড়ানী দিয়ে বোনা ঘন ক্ষেতে দুই পায়ের উপর বসে আরামে নিড়ানী দেওয়া যায়। পাট, মুলা, ডাটাশাক, গাজর এ ধরনের ক্ষেতে নিড়ানী দিতে দাউল ব্যবহার করা হয়।
দাউল বা নিড়ানী

বাঁকামুখ দাউল
কাস্তে
এটি ঠিক ধান বা গম কাটার কাস্তে নয়। এ ধরনের কাস্তেতে ধার কাটা থাকে না। চোখা মাথার এ কাস্তে দিয়ে ঘন ফসলের আগাছা পরিষ্কার ও মাটি আলগা করার কাজে ব্যবহার করা হয়।
কাস্তে বা কাচি দিয়েও নিড়ানী দেওয়া হয়
কাস্তে বা কাচি
কোদাল
আলুর মতো ডারা করে যেসব ফসল চাষ করা হয় সেসব ফসল নিড়ানী ও মাটি আলগা করার জন্য কোদাল ব্যবহার করা হয়।
কোদল মাটি কাটার পাশাপাশি নিড়ানীও দেওয়া হয়
কোদাল

Post a Comment

0 Comments