সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

জন্ম থেকে দুধ ছাড়া পর্যন্ত বাছুরের যত্ন

নবজাতক বাছুরের যত্ন
নবজাতক বাছুরের যত্ন
খামারকে দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক করতে চাইলে অবশ্যই বাছুরের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। নিজস্ব জাত তৈরি করতে চান যারা তাদের আজকের বকনা বাছুরটিই পরবর্তীতে দুধেল গাভী হবে। আর এঁড়ে বাছুরটি হবে প্রজননে সক্ষম ষাঁড়। আর নিজস্ব জাত তৈরির লাভ হলো, আপনার জাতটি ক্রমেই নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে উঠবে।

ফলে দীর্ঘমেয়াদে খামার করার পরিকল্পনা থাকলে বাছুরের প্রতি আলাদা নজর দিন। তা না হলে ভালো দুধেল গাভী, উর্বর ষাঁড় বা জোঁয়াল টানা শক্তিশালী বলদ বা মোটাতাজাকরণের উপযুক্ত একটি ষাঁড় হাতের কাছে পেয়েও হেলায় হারিয়ে ফেলবেন।

মায়ের গর্ভে থাকতেই পরোক্ষভাবে বাছুরের যত্ন আরম্ভ করতে হবে। গর্ভধারণের শেষ তিন মাসে পর্যাপ্ত সুষম পুষ্টিকর খাদ্য গর্ভবতী গাভীকে খাওয়াতে হবে। গাভীর নাড়ীর মাধ্যমে বাছুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে সুস্থ সবল অবস্থায় শারিরীকভাবে বৃদ্ধি পাবে। গর্ভকালের শেষ তিন মাসে ধীরে ধীরে দুধ দোহন বন্ধ করতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং পরিচ্ছ্ন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। গর্ভবতী গাভীকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে।  প্রসব ঘরে গাভীকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে।  পরিষ্কার শুকনা আলো-বাতাস-সমৃদ্ধ জায়গায় বাছুরের জন্ম হলে বাছুর স্বস্তিকর অবস্থায় থাকবে। প্রসবে অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই নিকটস্থ পশু চিকিৎসকের সহযোগিতা নিতে হবে।  শুকনো খড় পুরু করে বিছিয়ে খুব কাছাকাছি পর্যাপ্ত পরিমাণে হালকা ঠান্ডা বিশুদ্ধ পানি রাখতে হবে।

বাছুর ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথেই শুকনো খড়কুটা, চট বা ছালার উপর রাখতে হবে। নাক ও মুখ হতে নিঃসৃত লালা পরিষ্কার করতে হবে। নাকের ও মুখের লালা পরিষ্কার না করলে বাছুর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বাছুর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই বাছুরকে মায়ের মুখের  সামনে দিতে হবে। মা চেটে চেটে বাছুর নাক মুখ গা পরিষ্কার করে দেবে।

শুকনা নরম খড় বা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া যেতে পারে। তবে গরম পানি বা জীবাণুনাশক-মিশ্রিত পানি দিয়ে বাছুরের শরীর মুছে দেবেন না।

যদি দেখেন বাছুরের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে না সেক্ষেত্রে বাছুরের নাকে ও মুখে এবং নাভীতে ফুঁ দিলে সাধারণত শ্বাসপ্রশ্বাস চালু হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী শ্বাস বৃদ্ধির ওষুধ ব্যবহার করা ভালো।

বাছুরের নাড়ি কাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অসাবধানতার কারণে অনেকে নাড়ি কাটতে গিয়ে ইনফেকশন ঘটিয়ে ফেলেন। এতে বাছুরের নাভীতে পচন ধরতে পারে। নিয়ম হলো-  চামড়া থেকে ১-১.৫ ইঞ্চি রেখে নাড়ি কাটতে হবে। নাড়ি কাটা ছুরি বা ব্লেডটি অবশ্যই জীবাণুমক্ত করে নিতে হবে। পানিতে ফুটিয়ে অথবা স্যাভলন বা এ জাতীয় জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। নাড়ি কাটার পর ক্ষতস্থানে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা জরুরি। ২০% আয়োডিন সল্যুশান নাভীতে লাগালে নিশ্চিত থাকা যায়। এতে যেমন ইনফেকশন প্রতিরোধ করা যাবে, তেমনি নাড়িও দ্রুত শুকাবে। নাভীতে যেন ধুলাবালি কিংবা ময়লা না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্তত প্রথম সাত দিন দৈনিক খেয়াল রাখতে হবে। নাভীতে হাত দিলে বাছুর যদি ব্যথা পায়, তাহলে ডাক্তার দেখান। এছাড়া নাভী দিয়ে তরল বের হলে বা কটূ গন্ধ হলে দ্রুত ডাক্তার ডাকুন।

বাছুর দাঁড়ানোর চেষ্টা করার সাথে সাথেই তাকে শালদুধ খাওয়াতে হবে। এইটা খুব জরুরি। শালদুধ খেলে বাছুর দ্রুত শরীরে শক্তি পাবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।  বাছুর যদি দাঁড়িয়ে দুধ টানতে না পারে তাহলে পাঁজা করে ধরে গাভীর ওলানে মুখ লাগাতে হবে। এরপরও বাছুর যদি মুখে বাঁট  নিয়ে দুধ না টানে তাহলে দুধ টেনে ফিডারে ভরে খাওয়াতে হবে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৩ থেকে ৪ বার শালদুধ খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।

এরপর বাছুরের জন্য আলাদা স্থান করতে হবে। আলাদা স্থানে রাখলে বাছুর নানা ধরনের ইনফেকশন থেকে বেঁচে যায়। এতে বাছুরের প্রতি খেয়াল রাখতেও সুবিধা হবে। বাছুরের জন্য যাতে অন্তত ৬×৪ ফুট মাপের জায়গা থাকে সেটি খেয়াল করুন। প্রসূতি গাভীর ঘর শুষ্ক হতে হবে। যথেষ্ট আলো-বাতাস চলাচল করে এমন ঘরে গাভী ও বাছুরকে রাখুন। নরম শুকনো খড় বিছিয়ে দিতে হবে যাতে কোনোক্রমেই ঠাণ্ডা না লাগে। প্রতিদিন খড় পরিবর্তন করতে হবে। বাছুর প্রসবের পরপরই গাভীকে কুসুম গরম পানিতে লবণ, কালোজিরা, চিটাগুড় মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এতে গরু যেমন আরাম পাবে, দুধই দ্রুত আসবে।

বাছুরের বিছানাটি শুকনো ও নরম হওয়া জরুরি। ঘরের চোনা-গোবর সকাল বিকাল নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। অন্তত এক সপ্তাহ ঘর ধোয়া বা ঘরে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করবেন না। তবে মলমূত্র পরিষ্কারের পর শুকনো ছাই ছিটানো যেতে পারে।

জন্মের পর সাত দিন যথেষ্ট দুধ খেলে অন্য খাবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এসময় অতিরিক্ত দুধ খেলে বা অনিয়মিত খেলে বাছুরের ডায়রিয়া হতে পারে। তাই নিয়ম করে বাছুরকে দুধ খাওয়াতে হবে।

দুই মাস বয়স হলে বাছুরকে তার মাসহ অন্য গরুর সঙ্গে রাখা যাবে।

বাছুরের প্রস্রাব পায়খানা ও খাওয়ায় কোনো পরিবর্তন বা অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।

দিনের বেলা গাভী ও বাছুরকে একসঙ্গে রাখুন। এতে ইচ্ছেমতো দুধ খেতে পারবে এবং মায়ের দেখা দেখি ঘাস খড় ইত্যাদি খাবার খেতে শুরু করবে। এতে বাছুরের পাকস্থলী শক্ত খাবার হজমের জন্য দ্রুত তৈরি হবে। রাতের বেলা গাভী ও বাছুর আলাদা রাখতে হবে। তবে দিনে দুবার (সকাল-বিকাল) দুধ দহন করা হয় তাহলে গাভী ও বাছুর আলাদা স্থানেই রাখতে হবে। কাছাকাছি রাখাই ভালো। দুধ দোহনের সময় কিছু দুধ ওলানে রেখে দিয়ে বাছুরটিকে মায়ের কাছে যেতে দিতে হবে। এভাবে  আলাদা করে রাখলে বাছুরকে অবশ্যই বাড়তি খাবার ও পানি দিতে হবে।

এসময় আমিষ (১৬-১৮%), আঁশ-জাতীয় খাবার (৭-১০%), ক্যালসিয়াম (০.৬-০.৭%), ফসফরাস (০.০৪-০.০৫%), ম্যাগনেসিয়াম (০.১৫-০.২০%) এবং লবণ (০.০৭-০.০৮%) সমৃদ্ধ প্রাথমিক খাদ্য (কাফ স্টার্টার) খাওয়াতে হবে।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাছুরকে দুধ ও বাড়তি খাবার দেয়ার নিয়ম নিম্নবর্ণিত হতে পারে:
• প্রথম সপ্তাহের শেষ থেকে প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ কেজি হারে প্রতি সপ্তাহে ২ কেজি হিসাবে কমিয়ে ১২ সপ্তাহে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫০০ গ্রাম হিসাবে দানাদার খাদ্য বাড়াতে হবে এবং এর সাথে পর্যাপ্ত কচি ঘাস দিতে হবে।

• প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৮ কেজি হিসাবে দুধ খাওয়াতে হবে অর্থাৎ ৪০ কেজি ওজনের বাছুরকে ৩-৩.৫ কেজি দুধ খাওয়াতে হবে। এবাবে তিন মাস পর দুধ ছাড়াতে হবে।

• দৈহিক ওজনের ১.৫% হিসাবে তিন মাস পর থেকে ঘাস/খড় খাওয়াতে হবে।

• ছয় মাসের পর থেকে বাড়ন্ত বাছুরকে দৈহিক ওজনের ১% হিসাবে দানাদার খাদ্য হিসাবে ইউ.এম.এস.(ইউরিয়া-মোলাসেস-স্ট্রসহযোগে প্রস্তুত সংরক্ষিত খড়) খাওয়ানো যেতে পারে।

বাছুরের সাধারণ রোগ
• পেট ফাঁপা, ডিপথেরিয়া, এফএমডি, বদহজম, উদরাময়, নিউমোনিয়া, পাতলা পায়খানা, কোষ্ঠকাঠিন্য, সর্দি কাশি, উঁকুন, আঁঠালি, কৃমি, গলাফুঁলা ইত্যাদি।

• খাদ্যনালীতে কিছু আটকে গেলে বা কাদা-ধুলা-বালি খাদ্যের সাথে খেলে পেট ফাঁপে বা বদ হজম দেখা দিতে পারে। পেট ফাঁপলে বাছুর জাবরকাটা বন্ধ করে দেয়, তাপমাত্রা বেড়ে হয় ১০২-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট।

পেট ফাঁপলে বাড়তি খাবার দেওয়াবন্ধ রাখতে হবে ও শ্বাসকষ্ট যাতে না  হয় সে ঢালু জায়গায় রাখতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে পারগেটিভ বা কারমিনেটিভ মিশ্রণ খাওয়ানো যেতে পারে। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা পেট ফুটো করে গ্যাস বের করতে হবে।

পাতলা পায়খানা আর উদরাময়
• জীবাণুঘটিত বা বিষক্রিয়াজনিত কারণে পাতলা পায়খানা আর উদরাময় রোগ হতে পারে। পাতলা পায়খানা হলে বাছুরের শরীর তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য গাভী নিজেই জিহ্বা দিয়ে চাটে। পানিশূন্যতার কারণে বাছুর দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। পানিশূন্যতা রোধে স্যালাইন খাওয়ানো যেতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শে সালফার ট্যাবলেট খাওয়ানো যেতে পারে। দূর্বলতার জন্য স্যালাইন অথবা গ্লুকোজ ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্য
• বাছুরের পায়খানা আটকে যেতে পারে। পায়খানা শক্ত ও পরিমাণে কম হয়। পেটে ব্যথা হবে ও ফুলে যায়। বাছুরের কোষ্ঠকাঠিন্য হলে  ভেরেন্ডার (ভেন্না বা ক্যাস্টর) তেল এবং তিষির তেল খাওয়ালে উপকার পাওয়া যাবে। এছাড়া লবণ ও পানিসহ ম্যাগসালফ, ম্যাগকারব বা অন্যান্য সহজপ্রাপ্য পারগেটিভের মিশ্রণ বাছুরকে খাওয়ানো যেতে পারে।

বাছুরের সর্দি-কাশি
• প্রতিকূল আবহাওয়ায় অতি ঠান্ডা, বৃষ্টিতে ভেজা, প্রখর রোদে চলাচল, রোগ-জীবাণুর প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি কারণে সর্দি-কাশি হতে পারে।
বাছুরের সর্দি-কাশি হলে শরীরে ব্যথা ও জ্বরসহ নাক দিয়ে পানি পড়া এবং মাঝে মাঝে হাঁচি দেখা দিতে পারে। সর্দি-কাশি হলে শুকনো জায়গায় ও আলো-বাতাসে বাছুরকে রাখতে হবে, বাজারে সহজপ্রাপ্য সালফার-জাতীয় ট্যাবলেট চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাওয়াতে হবে। এছাড়া সামান্য গরম সরিষার তৈল, ক্যামফর বা তারপিন মলম দুই পাজরে মালিশ করা যেতে পারে।

বাছুরের উঁকুন
• উঁকুন এক প্রকার বহিঃপরজীবি যা থাকলে শরীরের লোম উসকোখুসকো দেখায় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে লোম ঝরে পড়ে, চুলকানির ফলে শরীর ঘষাঘষি করে চামড়ার বেশ ক্ষতি হয়, স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে এবং রক্তশূণ্যতা দেখা দিতে পারে।

• উকুন তাড়াতে নেগুভন, নাগামেন্ট, গ্যামাক্সিন, এসানটল বা অন্যান্য ওষুধ পশু-চিকিৎসকের পরামর্শ মতে খাওয়ানো যেতে পারে।

আঁঠালী
• আঁঠালী এক প্রকার বহিঃপরজীবি যা বাছুরের শরীরের রক্ত চুষে খায় এবং এর ফলে বাছুরের চরম স্বাস্থ্য হানি ঘটে।

• আঁঠালী এবং উঁকুন উভয় দ্বারা আক্রান্ত হলে পশুকে ৫% ম্যালাথিয়ন বা অন্য যেকোন কীটনাশক দ্রবণে খামারের সকল বাছুরকে একই সাথে গোছল করাতে হবে। খামার পরিষ্কার করে সব আবর্জনা পুড়িয়ে খামারে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

কৃমি
• জন্মের আগে বা পরে বাছুর বিভিন্ন প্রকার কৃমি দ্বারা (লম্বা, গোল, সুতা, চ্যাপ্টা বা ফিতা কৃমি উল্লেখযোগ্য) আক্রান্ত হতে পারে।

• পাকস্থলী, খাদ্যনালী, কলিজা ও ফুসফুসে কৃমি বসবাস করে।

• চারণ-ভূমির ঘাস বা বাসস্থানের আক্রান্ত পশুর পায়খানা থেকে কৃমি বিস্তার লাভ করে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে চামড়া ভেদ করে কৃমি শরীরে প্রবেশ করে।

• কৃমি আক্রান্ত হলে বাছুরের স্বাস্থ্যের অবনতিতে ওজন কমে যায়। খাদ্য হজম কমে যায়, লোম উস্কোখুসকো হয়ে যায়, রক্তশূণ্যতা দেখা যায়, দূর্বলতা বাড়ে ও খাওয়া কমে ক্রমাণ্বয়ে হাড্ডিসার হয়ে যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয় ও চোয়ালের নিচে পানি জমে যায়।

• কৃমির ধরণ অনুসারে চিকিৎসকের পরামর্শমতে বাজারেপ্রাপ্ত ওষুধ খাওয়াতে হবে। সুস্থ ও অসুস্থ সব বাছুরকে একই সাথে ওষুধ খাওয়াতে হবে।

বাছুরের সাদা উদরাময়
• সাধারণত দু’সপ্তাহের কম বয়সের বাছুরের সাদা পাতলা পায়খানা হলে তাকে সাদা উদরাময় বা কাফ স্কাউয়োর রোগ বলা হয়।
• খারাপ ব্যবস্থাপনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নিয়ম বহির্ভূত কৃত্রিম উপায়ে খাওয়ানো, শালদুধের অভাব, অতিমাত্রায় ও অনিয়মিতভাবে দুধ খাওয়ানো, অত্যধিক ঠান্ডা দুধ খাওয়ানো, রসদে সবুজ খাদ্যের স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে এবং এসকারেসিয়া কলাই নামক জীবাণু দ্বারা সাধারণত মানুষ বা পশুর খাদ্যনালীতে এ রোগ হতে পারে।

• এ রোগের লক্ষণগুলো হলো- ঘনঘন মল ত্যাগ, চালের পানির মত পাতলা দূর্গন্ধযুক্ত পায়খানা, প্রথম দিকে জ্বর হয়ে পরে স্বাভাবিক মাত্রার নিচে তাপমাত্রা নেমে যায়, খাওয়াতে অরুচি এবং আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে বাছুর মারা যায়।

• লক্ষণ বুঝার সাথে সাথে ২৪ ঘন্টার মধ্যে খাদ্য বন্ধ করতে হবে। সামান্য গরম পানিতে গম অথবা ভূট্টার কুঁড়া খাওয়ানোর পাশাপাশি দুধ খাওয়ানোর পরিমাণ বাড়াতে হবে। স্যালাইন ও পরামর্শ অনুযায়ী সালফার-জাতীয় ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে বা ইনজেকশন দিতে হবে। জন্মের পরপরই শালদুধ খাওয়াতে হবে এবং জীবাণুমুক্ত ও পরিষ্কার জায়গায় বাছুরকে রাখতে হবে।

নিউমোনিয়া
• ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক এবং রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা এ রোগ হতে পারে।

•  নিউমোনিয়া রোগের সাধারণ লক্ষণসমূহ হলো- শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা বাড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বাভাবিক শব্দ হয়, জ্বর হয়, সর্দি বাড়ে ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে। নিউমোনিয়ার অপর নাম শ্বাস রোগ বা পাঁজর ব্যথা।

• নিউমোনিয়া হলে পশু-চিকিৎসকের পরামর্শমতে অতি সাবধানতায় বাছুরের শিরায় অথবা মাংসপেশীতে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে ও একই সাথে এন্টিহিস্টামিনিক ইনজেকশন নির্ধারিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।

ডিপথেরিয়া
• ডিপথেরিয়া রোগটি স্ফেরোফোরাস নেক্রোফেরাস জীবাণুর সৃষ্ট একটি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি যার মাধ্যমে তিন মাসের বাছুরের মুখগহ্বর এবং বেশি বয়সের বাছুরের ল্যারিংস আক্রান্ত হয়।

• ডিপথেরিয়ার লক্ষণ হলো-  জ্বর ও মুখে লালা পড়ে, দুধ খেতে পারে না, মুখে গোঙানির মত ঘড় ঘড় শব্দ হয়। শেষ পর্যায়ে নাক থেকে পানি পড়ে, জিহ্বা বের হয়ে থাকে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়।

• ডিপথেরিয়া হলে শক্ত খাবার বন্ধ করতে হবে এবং পশু-চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সালফানিলামাইড ও এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা যেতে পারে।

ক্ষুরা
• ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ যার ফলে মুখে ও পায়ে এক সাথে ঘা বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। চার ধরণের ভাইরাস দ্বারা এ রোগের সৃষ্টি হয়।
• এলাকা ভেদে ক্ষুরা রোগের প্রচলিত নাম জ্বরা, পাতা, তাপা, ক্ষুরা পাকা ইত্যাদি।

• দূষিত খাদ্য, পানি, বাতাস বা আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শের মাধ্যমে সুস্থ দেহে এ রোগ সংক্রমিত হয়।

• ক্ষুরা রোগ হলে, প্রথমে জ্বর দেখা দেয়, তাপমাত্রা বেড়ে ১০৫ ডিগ্রি ফা. উঠে, মুখে বিরামহীন লালা পড়ে, কোন কোন সময় মুখে চপচপ শব্দ হয়, জিহ্বা, মুখ ও ক্ষুরের মাঝখানে ফোঁসকা পড়ে, পরে ফেঁটে ঘা বা ক্ষত সৃষ্টি হয়, আক্রান্ত বাছুর অনেক ক্ষেত্রেই মারা যায়।

• বাছুর ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হলে ফিটকিরির পানিতে মুখ ও পায়ের ঘা ধুতে হবে, একটি ট্রাইসালফার ট্যাবলেট ৩৫ লিটার পানিতে গুলিয়ে দিনে একবার খাওয়াতে হবে, পরের দিন হতে অর্ধেক মাত্রায় পর পর তিন দিন খাওয়াতে হবে, আক্রান্ত বাছুরকে তরল বা নরম খাবার খাওয়াতে হবে, গুরুতর অবস্থায় পশু-চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

• এ রোগের প্রতিষেধক টিকা দেওয়াই সবচেযে বুদ্ধিমানের কাজ। আক্রান্ত গরু থেকে সুস্থ গরুকে বা অন্যান্য পশুকে আলাদা রাখতে হবে। রোগ বিস্তারের সকল বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

বাদলা
• ক্লস্ট্রিড়িয়াম সোভিয়াই নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা ৬-২৪ মাস বয়সের গরুতে সৃষ্ট একটি মারাত্মক ব্যাধি। এ ব্যাধিতে মাংসে প্রদাহ ও রক্তশূণ্যতা দেখা দেয়। বিকিউ, ব্লাকলেগ এবং ব্ল্যাক কোয়াটার নামেও এ রোগ পরিচিত।

• দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে সুস্থ বাছুরের দেহে এ রোগ সংক্রমিত হয়।

• বাদলা রোগ হলে- তাপমাত্রা বেশ (১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফা.) বেড়ে যায়, সামনের বা পিছনের একটি বা দুটি পায়ের সামনে বা পিছনের উপরে মাংসালো জায়গা ফুলে যায়। প্রথমে গরম ও বেদনাদায়ক থাকে, পরে ঠান্ডা ও ব্যথাহীন হয়, ফুলা জায়গায় চাপ দিলে পচপচ বা ফড়ফড় শব্দ করে। এ রোগের প্রধান লক্ষণ কোষ্ঠকাঠিন্যতা, পশু খুড়িয়ে হাটে, আস্তে আস্তে দূর্বল হয়ে অবশেষে মারা যায়।

• সময়মত সালফার-জাতীয় ঔষধ বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এন্টিবায়োটিক শিরায় প্রয়োগ করলে আক্রান্ত গরুটি ভালো হতে পারে, ফুলা স্থানে গরম ছেক দিলে এবং পশু চিকিৎসক দ্বারা চামড়া কেটে দিলে রোগের প্রখরতা কমে থাকে।

• রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে সময়মত প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে।
• তিন থেকে ৩৬ মাস বয়সী গরুকে ৫ মি.লি. হিসাবে কাঁধ বা ঘাড়ের চামড়ার নিচে টিকা প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ছয় মাস পরপর এই টিকা প্রদান করতে হবে। টিকার বোতল খোলার ২৪ ঘন্টা পর এই টিকা আর প্রয়োগ করা যাবে না। রেফ্রিজারেটরে ৪-৮ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণ করতে হবে।

গলাফুলা বা হেমরহেজিক সেপটিসেমিয়া
• পাষ্টুরেলা মালটোসিডা এবং পাস্টুরেলা হিমোলাইটিকা নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা এই রোগটি সংক্রমিত হয়। আমাদের দেশে সাধারণত বর্ষার আগে বা শেষে অতি তীব্র পর্যায়ে এ রোগ পরিলক্ষিত হয়। ছোঁয়াচে এবং সংক্রমিত উক্ত রোগটি এলাকা ভেদে বাংলা, ঘটু, গলঘুট, ঘলবেরা ইত্যাদি নামে পরিচিত।

• দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে সুস্থ দেহে রোগের জীবাণু প্রবেশ করে।

• গলাফুলা রোগের লক্ষণ- তীব্র রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই গরু মারা যায়। দৈহিক তাপমাত্রা ১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফা. বাড়ে, গলা ফুলে যায়, ফুলা জায়গা গরম হয়, ফুলা আস্তে আস্তে বেড়ে বুক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয় এবং আওয়াজ শোনা যায়, জিহ্বা ফুলে যায়, সময় সময় হা করে জিহ্বা বের করে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে, অনেক সময় কাশি হয়, চোখে পিচুটি দেখা যায়, নাক থেকে সাদা শ্লেষা পড়তে থাকে, পানাহার বন্ধ করে দেয় এবং ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে পশু মারা যায়।

• আক্রান্ত গরুকে মাংসপেশীতে প্রতি ১০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ মি.লি. অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ইনজেকশন দিতে হবে এবং ৭২ ঘন্টা পরে আর একটি ইনজেকশন দিতে হবে। গলার পাশে ঢিলা চামড়ার নিচে ১ মি.লি. হিসাবে ১ বছর পর পর টিকা দিতে হবে। তবে শুধু সুস্থ গরুকেই গলাফুলা রোগের টিকা দেয়া উচিত।

তড়কা
• তড়কা একটি অতি তীব্র সংক্রামক রোগ যার লক্ষণ মারা না-যাওয়া পর্যন্ত বুঝা যায় না। ব্যাসিলাস এনথ্রোসিস নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা এ রোগ সংক্রমিত হয়।
• তড়কা রোগ হলে পশু মারা যাওয়ার আগ মুহূর্ত বা পরে নাক, মুখ, মলদ্বার ইত্যাদি দিয়ে আলকাতরার মতো তরল রক্তমিশ্রিত রস নির্গত হতে থাকে, তড়কা রোগে মৃত পশুর রক্ত জমাট বাঁধে না।

• দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে এবং সঠিক জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তড়কা রোগ বিস্তার লাভ করে।

• তড়কা রোগের লক্ষণ- তীব্র রোগে আক্রান্ত হয়ে পশু হঠাৎ মারা যায়, অনেক সময় কোন লক্ষণ দেখা যায় না, অত্যধিক জ্বর (১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফা.) উঠে, লোম দাঁড়িয়ে থাকে, শরীর কাঁপে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত মাত্রায় বাড়ে এবং গভীর হয়। মাথা নিচু করে দাঁড়ায়, কিছুটা উত্তেজিত দেখায়, এক সময় নিস্তেজ হয়ে খিচুনি হয় এবং মারা যায়।

• আক্রান্ত গরুকে পশু-চিকিৎসকের পরামর্শমতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এন্টিবায়োটিক দিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। তড়কা রোগাক্রান্ত পশু কোন চিকিৎসাতে সুস্থ হয় কিনা তা জানা নেই।

• সুস্থ পশুকে যথাসময়ে টিকা প্রদান করতে হবে, গলার চামড়ার নিচে ০.৫ মি.লি. হিসাবে টিকা প্রয়োগ করতে হবে এবং প্রতি বছর টিকা দিতে হবে। টিকা প্রদানের স্থান কয়েকদিন ফুলা থাকতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। ৪-৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণ করতে হবে।

[গর্ভবতী গাভীর যত্ন]

Post a Comment

0 Comments