সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

যে পদ্ধতিতে গম চাষে ভালো ফলন নিশ্চিত


গম কীভাবে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়
একটি সুস্থ গম ক্ষেত
মাটি
উঁচু ও মাঝারী দোআঁশ মাটি গম চাষের জন্য বেশী উপযোগী। লোনা মাটিতে গমের ফলন কম হয়।

বপনের সময়
বপনের সময় উপযুক্ত সময় হলো কার্তিক মাসের শেষ থেকে অগ্রহায়ণের তৃতীয় সপ্তাহ ( নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত )। যে সব এলাকায় ধান কাটতে ও জমি তৈরী করতে বিলম্ব হয় সে ক্ষেত্রে  কাঞ্চন, আকবর , অঘ্রাণী, ও গৌরব বপন করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

বীজের হার 
হেক্টর প্রতি ১২০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। বীজ গজানোর ক্ষমতা ৮৫% এর বেশী  হলে ভাল হয়।

বীজ শোধন
ভিটাভেক্স ২০০ প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। এতে বীজ ছত্রাকমুক্ত হবে।

বপন পদ্ধতি 
সারিতে বা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরীর পর লাংগল দিয়ে সরু নালা তৈরী করে ২০ সেমি দূরত্বের সারিতে ৪-৫ সেমি গভীরে বীজ বুনতে হয়।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সেচ সহ চাষের ক্ষেত্রে নির্ধারিত  ইউরিয়া সারের দুই তৃতীয়াংশ এবং সম্পূর্ন টিএসপি, এমপি ও জিপসাম শেষ চাষের পূর্বে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে  হবে। বাকী এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া প্রথম সেচের সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সম্পূর্ন সার অর্থাৎ ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি ও জিপসাম শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।

গম চাষে নীচে ঊল্লিখিত হারে সার ব্যবহার করা প্রয়োজন  
সারের নাম সারের পরিমান/ হেক্টর
        সেচ সহ         সেচ ছাড়া
ইউরিয়া         ১৮০-২২০ কেজি ১৪০-১৮০ কেজি
টিএসপি ১৪০-১৮০ কেজি ১৪০-১৮০ কেজি
এমপি           ৪০-৫০ কেজি         ৩০-৪০ কেজি
জিপসাম ১১০-১২০ কেজি         ৭০-৯০ কেজি
গোবর/ কম্পোস্ট       ৭-১০ টন ৭-১০ টন

পানি সেচ
মাটির প্রকারভেদে সাধারণত ২-৩ টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭-২১ দিন পরে), দ্বিতীয় সেচ গমের  শীষ বের হওয়ার সময় (বপনের ৫৫-৬০ দিন পরে) এবং  তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পরে) দিতে হবে।

ফসল সংগ্রহ
চৈত্র মাসের প্রথম থেকে মধ্য চৈত্র (মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম) পর্যন্ত কেটে গম সংগ্রহ করতে হয়।

অন্যান্য পরিচর্যা

গমের পাতার মরিচা রোগ দমন:
পাকসিনিয়া রিকন্ডিটা নামক ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে। প্রথমে পাতার উপর ছোট গোলাকার হলুদ দাগ পড়ে। শেষ পর্যায়ে এই দাগ মরিচার মত বাদামী বা কালচে রংয়ে পরিনত হয়। হাত দিয়ে আক্রান্ত পাতা ঘষা দিলে লালচে মরিচার মত গুড়া হাতে লাগে। এ রোগের লক্ষণ প্রথমে নীচের পাতায় , তারপর সব পাতায় ও কান্ডে দেখা যায়। দেশের উত্তরাঞ্চলে এ রোগ বেশী হয়ে থাকে।

প্রতিকার
১। রোগ প্রতিরোধী গমের জাত  কাঞ্চন, আতবর , অঘ্রাণী, প্রতিভা, সৌরভ ও গৌরবের চাষ করতে হবে।
২। সুষম হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
৩। টিল্ট ২৫০ ইসি ছত্রাক নাশক ০.০৪%) ১ মিলি আড়াই লিটার পানিতে মিশিয়ে ১২-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

গমের পাতার দাগ রোগ দমন
বাইপোলারিস সরোকিনিয়ানা নামক ছত্রাক এ রোগ ঘটায়। গাছ মাটির উপর আসলে প্রথমে নীচের পাতাতে ছোটছোট বাদামী ডিম্বাকার দাগ পড়ে। পরবর্তীতে দাগসমূহ বাড়তে থাকে এবং গমের পাতা ঝলসে দেয়। রোগের জীবাণু বীজে কিংবা ফসলের পরিত্যাক্ত অংশে বেঁচে থাকে। বাতাসের অধিক আর্দ্রতা এবং উচ্চ তাপমাত্রা ( ২৫ ডিগ্রী সে. ) এ রোগ বিস্তারের জন্য সহায়ক।

প্রতিকার:
১। রোগমুক্ত জমি হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
২। গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৩।প্রতি কেজি গম বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম ভিটাভেক্স ২০০ মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
৪। টিল্ট ২৫০ ইসি (০.০৪%) ১ মিলি  প্রতি আড়াই লিটার পানিতে মিশিয়ে ১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

গমের গোড়া পচা রোগ দমন:
স্ক্লেরোশিয়াম রলফসি নামক ছত্রাক দ্বারা গমের এ রোগ হয়। এই রোগের ফলে মাটির সমতলে গাছের গোড়ায় হলদে দাগ দেখা যায়। পরে তা গাঢ় বাদামী বর্ণ ধারণ করে এবং আক্রান্ত স্থানের চারদিক ঘিরে ফিলে। পরবর্তীতে পাতা শুকিয়ে গাছ মারা যায়। রোগের জীবাণু মাটিতে কিংবা ফসলের পরিত্যাক্ত অংশে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। সাধারণত বৃষ্টির পানি কিংবা সেচের পানি দ্বারা এক জমি হতে অন্য জমিতে বিস্তার লাভ করে ।
প্রতিকার
১।রোগ প্রতিরোধী  কাঞ্চন, আকবর , অঘ্রাণী, প্রতিভা, সৌরভ ও গৌরব জাতের চাষ করতে হবে।
২। মাটিতে সবসবয় পরিমিত আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন।
৩। ভিটাভেক্স ২০০ নামক ঔষধ  প্রতি কেজি  বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

গমের আলগা ঝুল রোগ দমন:
আসটিলাগো ট্রিটিসি নামক ছত্রাকের আত্রমনে এ রোগ হয়। গমের শীষ বের হওয়ার সময় এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। উক্ত ছত্রাকের আত্রমনের ফলে গমের শীষ প্রথম দিকে পাতলা পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। পরে তা ফেটে যায় এবং দেখতে কালো ঝুলের মত দেখায়।  ছত্রাকের বীজকণা সহজেই বাতাসের মাধ্যমে অন্যান্য গাছে এবং অন্য জমির গম গাছে সংক্রমিত হয়। রোগের জীবাণু বীজের ভ্রুণে জীবিত থাকে। পরবর্তী বছর আত্রান্ত বীজ জমিতে বুনলে বীজের অংকুরোদ্‌গমের সময় জীবাণু সক্রিয় হয়ে ওঠে।

প্রতিকার
১।রোগ প্রতিরোধী   কাঞ্চন, আকবর , অঘ্রাণী, প্রতিভা, সৌরভ ও গৌরব জাতের চাষ করতে হবে।
২। রোগমুক্ত জমি হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
৩। ভিটাভেক্স ২০০ নামক ঔষধ  প্রতি কেজি  বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

গমের আলগা ঝুল রোগ দমন:
ড্রেক্সলেরা প্রজাতি ও অলটারনারিয়া প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা গমের এ রোগ হয়। এ রোগের ফলে গমের খোসায় বিভিন্ন আকারের বাদামী অথবা কালো দাগ পড়ে। বীজের ভ্রুণে দাগ পড়ে এবং পরবর্তীতে দাগ সম্পূর্ণ বীজে ছড়িয়ে পড়ে।  এ রোগের জীবাণু বীজের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে থাকে।

প্রতিকার
১। সুস্থ বীজ সংগ্রহ করে বপন করতে হবে।
২। ভিটাভেক্স ২০০ নামক ঔষধ  প্রতি কেজি  বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

গমের ইঁদুর দমনে বিষ টোপের ব্যবহার:
ইঁদুর গমের একটি প্রধান শত্রু । গম ক্ষেতে বিশেষ করে শিস আসার পর ইঁদুরের উপদ্রব বেশী দেখা যায়। গম পাকার সময় ইঁদুর সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করে । বিএআরআই উদ্ভাবিত ২% জিঙ্ক সালফাইড বিষ টোপ ইঁদুর দমনে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বিষটোপ প্রস্তুত পদ্ধতি:
এক কেজি বিষটোপ তৈরীর জন্য নিম্নরুপ হারে দ্রব্যাদি মেশাতে হবে।
উপাদান পরিমান
গম ৯৬৫ গ্রাম
বার্লি ১০ গ্রাম
জিঙ্ক ফসফাইড (সক্রিয় উপাদান ৮০%) ২৫ গ্রাম
পানি ১০০ গ্রাম

একটি এলুমিনিয়ামের পাত্রে ১০ গ্রাম বার্লি ও ১০০ এমএল পানি মিশিয়ে ২-৩ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। বার্লি আঠালো হয়ে গেলে পাত্রটি নামিয়ে ফেলতে হবে। ঠান্ডা হওয়ার পর ২৫ গ্রাম  জিঙ্ক ফসফাইড আঠালো বার্লির সাথে ভালোভাবে মেশাতে হবে। জিঙ্ক ফসফাইড মেশানোর পর ৯৬৫ গ্রাম গমের দানা পাত্রে ঢেলে এমন ভাবে মেশাতে হবে যেন প্রতিটি গমের দানার গায়ে কালো আবরণ পড়ে। এরপর গম দানা এক ঘন্টা রোদে শুকালে তা বিষটোপে পরিণত হবে। পরে তা ঠান্ডা করে পলিথিন ব্যাগ বা বায়ুরোধক পাত্রে রাখতে হবে।

ব্যবহার পদ্ধতি:
গমের জমিতে সদ্য মাটি উঠানো গর্ত সনাক্ত করতে হবে। ৩-৫ গ্রাম জিঙ্ক ফসফাইড বিষটোপ কাগজে রেখে শক্ত করে পুটলি বাঁধতে হবে। গর্তের মুখের মাটি সরিয়ে এ পুটলি ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে অথবা সতেজ গর্তের আশে পাশে কাগজে বা মাটির  পাত্রে বিষটোপ রেখে দিতে হবে। বিষটোপ খেলে  ইঁদুর সাথে সাথে মারা যাবে।

সূত্র: কৃষিপ্রযুক্তি হ্যান্ডবুক, বারি

Post a Comment

0 Comments