সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অনুর্বর জমি ও খরার ফসল জোয়ার বা সরগম চাষ পদ্ধতি

জোয়ার বা সরগম চাষ
জোয়ার বা সরগম

সরগম (Sorghum bicolor L. Moench) আফ্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দানাদার ফসল, যা পৃথিবীব্যাপী জন্মে। বাংলাদেশ এবং ভারতে জোয়ারের জনপ্রিয় নাম ‘জোয়ার’। বিভিন্ন দানাদার শস্য যেমন- ধান, গম, ভুট্টা, বার্লি, কাউন, রাই, ওট ইত্যাদি শস্যগুলোর মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণের দিক থেকে জোয়ার ৫ম স্থান দখল করে আছে এবং পৃথিবীতে এর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৬ কোটি টন। জোয়ার মানুষের এবং পশুপাখির খাদ্য হিসেবে পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত। বাংলাদেশেও বিক্ষিপ্তভাবে এর চাষ হয়ে থাকে। খরাপীড়িত এলাকায় চাষের ব্যাপক উপযোগিতা থাকায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এর ব্যাপক চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। ফসলটি খরাসহিষ্ণু হওয়ায় বাংলাদেশে সাধারণত চরাঞ্চলে অথবা কম উর্বর জমিতে স্বল্প আয়েশে জোয়ারের চাষ করা যায়। জোয়ার প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গরিবের খাদ্য হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং এসব এলাকায় ভুট্টার চেয়ে এর পারিবারিক ব্যবহার বেশি এবং এ ফসল খাদ্য নিরাপত্তায় মূল্যবান অবদান রাখছে। প্রতি বছর দক্ষিণ আফ্রিকাতে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টন জোয়ার উৎপন্ন হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে জোয়ার আফ্রিকার শুষ্ক পশ্চিম এলাকা থেকে আর্দ্রতাপূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এটি ব্যাপকভাবে প্রায় বৃষ্টিহীন এবং গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে জন্মে। বর্তমানে প্রায় ১০০টি দেশে জোয়ার উৎপন্ন হয় এবং এর প্রায় ৬৬টি প্রজাতি রয়েছে।

জোয়ার ঘাস পরিবারের (Gramene) একটি দানাদার ফসল। এর শিকড় মটির নিচের দিকে এবং পাশাপাশি যথাক্রমে ২ মিটার ও ১ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। পাতা সবুজ প্রশস্ত কিন্তু ভুট্টা পাতার মতো তত প্রশস্ত নয়। প্রতি গাছে ৮-২২টি পাতা থাকে। পাতায় পাতলা মোমের আবরণ থাকে। কা- শক্ত এবং শুষ্ক থেকে সরস এবং মিষ্টি। এ গাছ আড়াই থেকে তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। জোয়ারের বীজ ডিম্বাকৃতি থেকে গোলাকার এবং রঙ লাল, সাদা, হলুদ, বাদামি রঙের হতে পারে।  প্রতি পুষ্পমঞ্জুরিতে প্রায় ৮০০-৩০০০টি বীজ থাকে।

জোয়ার সাধারণত কম উর্বর, বেলে দো-আঁশ ও কাদামাটিতে ভালো জন্মে। মূলত এটি গ্রীষ্মম-লী ও উষ্ণ আবহাওয়া পছন্দের একটি ফসল। অঙ্কুরোদগম এবং গাছ বৃদ্ধির জন্য উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। ১৫-১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে ৮০ ভাগ বীজ অঙ্কুরিত হয়। ২৫ থেকে ৩২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সর্বোত্তম বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন সাধিত হয়। জোয়ার স্বল্প দিনের উদ্ভিদ বিধায় এ উদ্ভিদের প্রজননের জন্য স্বল্প দিন এবং দীর্ঘ রাতের প্রয়োজন হয়।

উপযোগী জমি ও মাটি : জোয়ার প্রধানত উঁচু, মাঝারি উঁচু ও মাঝারি জমি এবং বেলে-দো-আঁশ ও অগভীর কাদামাটিতে ভালো জন্মে। পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকতে হবে। জোয়ার চাষের জন্য মাটির আদর্শ পিএইচ মান ৬-৭.৫।

বীজ বপনের সময় : রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমেই জোয়ার চাষ করা যায়। রবি মৌসুমে ১৫ অক্টোবর-নভেম্বর (কার্তিক-পৌষ) এবং খরিফ মৌসুমে ১৫ এপ্রিল-মে (ফাল্গুন-চৈত্র) মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।

বীজের হার : সাধারণত হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ কেজি বীজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বীজ গজানোর ক্ষমতা ৮৫% এর বেশি হলে ভালো হয়। বীজ লাইন করে বপন করা উত্তম।

বপন পদ্ধতি : ভিটাভেক্স-২০০ অথবা থিরাম প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। সারিতে বা ছিটিয়ে জোয়ার বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরির পর সরু নালা তৈরি করে ২৫-৩০ সেমি. দূরত্বের সারিতে জো অবস্থায় ২-২.৫ সেমি. গভীরে বীজ বপন করতে হয়। ২৫-৩০ সেমি. দূরত্বে সারিতে বপন করা হলে গাছের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২.৫ লাখ এবং হেক্টরপ্রতি ৩ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

রাসায়নিক সারের মাত্রা : সাধারণত হেক্টরপ্রতি ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ২০০ কেজি টিএসপি এবং ৮০ কেজি এমওপি সার ব্যবহার করা হয়। সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে জমি তৈরির সময় ৫০ ভাগ ইউরিয়া এবং সম্পূর্ণ টিএসপি এবং এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ৫০ ভাগ ইউরিয়া ২ কিস্তিতে ১৫ দিন ও ৩০ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সার অর্থাৎ ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। গন্ধক সারের অভাবজনিত মাটিতে হেক্টরপ্রতি ২৩০-২৫০ কেজি জিপসাম সার এবং ১০-১২ মে.টন জৈবসার ব্যবহার করা হলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এতে শুধু ফলনই বাড়ে না, বীজের পুষ্টিগত মানও উন্নত হয়।

সেচ : সাধারণত জোয়ার চাষে সেচ প্রয়োজন হয় না। তবে বেশি ফলন পেতে চাইলে কয়েকবার সেচ দিতে হবে। সাধারণত বীজ বোনার ২০-৩০ দিন পর ১ম সেচ (গাছে ফুল আসার আগে ইড়ড়ঃরহম ংঃধমব) এবং ২য় সেচ বীজ বপনের ৫০-৬০ দিন পর প্রদান করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনোক্রমেই জমিতে পানি না জমে।

পরিচর্যা : সারিতে সমান দুরত্বে বীজ বোনা সম্ভব হয় না বিধায় চারা গজানোর পর পাতলা করার প্রয়োজন হতে পারে। বপনের ৩০-৩৫ দিন পর চারাগুলোর দূরত্ব ৬-৮ সেমি. রেখে বাকি চারা উঠিয়ে পাতলা করে দিতে হয়। আগাছা দেখা দিলে নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

পোকামাকড় : জোয়ার সাধারণত পোকামাকড় দ্বারা অন্যান্য ফসলের তুলনায় কম আক্রান্ত হয়।
Sorghum Midge দেখা দিলে কার্বোফুরান/মেলাথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক ১২৫ মি.লি/হে. হারে ব্যবহার করতে হবে।

রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা : জোয়ার সাধারণত রোগবালাই দ্বারা কম আক্রান্ত হয়। তবে জোয়ারের বেশ কিছু রোগবালাই রয়েছে।
রোগ প্রতিরোধের জন্য বীজ শোধন করা জরুরি। থিরাম/ভিটাভেক্স-২০০ প্রতি কেজি বীজের জন্য ৩ গ্রাম হারে ব্যবহার করে বীজ শোধন করতে হয়। ফসল এনথ্রাকনোস ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হলে কারবেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। জোয়ার ফসল পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হলে তা জৈব দমনের মাধ্যমে দমন করা শ্রেয়। রোগবালাইয়ের ব্যাপকতা বেশি হলে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক এবং বালাইনাশক প্রয়োগ করে পোকামাকড় ও রোগ দমন করতে হবে।

ফসল কাটা ও মাড়াই : বপনের ৯৫-১১০ দিন পরে গাছের পাতা কিছুটা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে ফসল কাটার উপযুক্ত সময় হবে। বীজ দাঁত দিয়ে কাটলে কট করে শব্দ হলে বুঝতে হবে ফসল কাটার উপযুক্ত সময় হয়েছে। ফসল পেকে গেলে দিনের প্রথম ভাগে জোয়ার কাটা উচিত তা না হলে দানা ঝরে যেতে পারে। ২-৩ দিন শুকানোর পর মাড়াই করে ভালো করে শুকিয়ে ঠা-া করে টিন, ড্রাম অথবা মোটা পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

ফলন : প্রথম সারির ১০টি দেশের গড় ফলন- ১৩৩৬.০ কেজি/হেক্টর। অপর পক্ষে ভারত এবং পাকিস্তানের হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৮১৮.৬ এবং ৬২০.০ কেজি। ভালো জাতের বীজ ব্যবহার ও উপযুক্ত পরিচর্যা করা হলে গড় ফলন ২০০০ কেজি/হেক্টরের ওপরে পাওয়া যাবে।

জোয়ারের পুষ্টিমান
জোয়ার প্রধানত একটি শ্বেতসার সমৃদ্ধ দানাদার ফসল, এতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ, ১১% উঁচু মানের প্রোটিন এবং ৭৪% কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। তাছাড়া খনিজ পদার্থ ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম, ফসফরাস এবং প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-বি যেমন- থায়ামিন ও রিবোফ্লাবিন বিদ্যমান,যা দেহ সুস্থ রাখার জন্য অপরিহার্য।

জোয়ারের ব্যবহার : মানুষের খাদ্য ছাড়াও জোয়ার পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া জোয়ার হতে ইথানল, অ্যালকোহল, স্টার্চ, আঠা, কাগজ, জৈব জ্বালানি তৈরি করা যায়। জোয়ার হতে চাল, আটা, বিস্কুট, কুকিস, বেকড বিনস, পপড জোয়ার, মোয়া, নাড়ু, পায়েশ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন টিনজাত খাদ্য প্রস্তুত করা হয়।
বাংলাদেশে এ ফসলটি দীর্ঘদিন ধরে স্বল্প পরিসরে চাষ হয়ে আসছে। ছোট দানা হিসেবে এ শস্যটি গরিবের খাদ্য হিসেবে পরিগণিত। ক্রমান্বয়ে এ ফসলের চাষাবাদ কমে যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সমগ্র বাংলাদেশে মাত্র ৪০০ হেক্টর জমিতে এ ফসলের চাষ হচ্ছে। জোয়ার খরা প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং তুলনামূলকভাবে বেশ কম খরচে এর চাষ করা যায়। চাল, গম, ভুট্টার মতোই জোয়ার পুষ্টি সমৃদ্ধ। খরা সহিষ্ণু হওয়ায় ফসলটি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলসহ দেশের চরাঞ্চল ও অন্যান্য উঁচু ও মাঝারি জমিতে আবাদ বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

Post a Comment

0 Comments