সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ইরি বোরো ধানের উন্নত চাষ পদ্ধতি

ইরি বা বোরো ধানে বেশি ফলন পেতে যা করতে হবে
কৃষকের কার্তিক মাসের অভাব দূর করেছে ইরি-বোরো ধান

হাওর বা বাঁওড় শব্দ থেকে বোরো শব্দের উৎপত্তি। বোরো ধানগুলো এককালে আমাদের দেশে হাওর ও বাঁওড় এলাকায় চাষ হতো। বর্তমানে সেচের বিস্তার হওয়ায় অন্যান্য উঁচু জমিতেও এর চাষ হচ্ছে। বোরো মওসুমে ধানগাছ প্রচুর সূর্যকিরণ পায়, সার বেশি গ্রহণ করে অথচ গাছ ও পাতা হেলে পড়ে না, ফলবান কুশি বেশি হয় এবং অধিক ফলন পাওয়া যায়। তাই এ মওসুমে আধুনিক জাতের বোরো ধানের চাষ সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। বোরো ধানের ভালো ফলন পেতে হলে জমি তৈরি, সুষম মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার এবংসময়মতো চারা রোপণ করে অন্যান্য পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে হবে।

জমি তৈরি
ধানের চারা রোপণের জন্য জমি কাদাময় করে উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে। এ জন্য জমিতে প্রয়োজনমতো পানি দিয়ে মাটি একটু নরম হলে ১০-১৫ সেন্টিমিটার গভীর করে সোজাসুজি ও আড়াআড়িভাবে চার-পাঁচটি চাষ ও মই দিতে হবে যেন মাটি থকথকে কাদাময় হয়। প্রথম চাষের পর অন্তত সাত দিন জমিতে পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচনের ফলে গাছের খাদ্য বিশেষ করে অ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেন জমিতে বৃদ্ধি পায়।

মূল সার প্রয়োগ
বোরো মওসুমে ধানের আশানুরূপ ফলন পেতে জমিতে পরিমাণমতো জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা দরকার। সারণিতে বোরো ধানের জাতভিত্তিক সারের মাত্রা (ইউরিয়া ছাড়া) উল্লেখ করা হলো। জাতভেদে বোরো ধানের সারের পরিমাণ (কেজি/হেক্টরে)

চারা রোপণ
বীজতলা থেকে ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা সাবধানে তুলে এনে সারি করে রোপণ করতে হবে। এ মওসুমে সারি থেকে সারি ২০-২৫ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারা ১৫-২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাগাতে হবে। জমির উর্বরতা ও জাতের কুশি ছাড়ানোর ওপর ভিত্তি করে এ দূরত্ব কম বা বেশি হতে পারে। প্রতি গোছায় দু-তিনটি সুস্থ ও সবল চারা ২.৫-৩.৫ সেন্টিমিটার গভীরে রোপণ করতে হবে। খুব গভীরে চারা রোপণ করা ঠিক নয়। এতে কুশি গজাতে দেরি হয়। কুশি ও ছড়া কম হয়। কম গভীরে রোপণ করলে তাড়াতাড়ি কুশি গজায়, কুশি ও ছড়া বেশি হয় ও ফলন বাড়ে। তাই কম গভীরে চারা রোপণের জন্য রোপণের সময় জমিতে ১.২৫ সেন্টিমিটারের মতো ছিপছিপে পানি রাখা ভালো। কাদাময় অবস্থায় রোপণের গভীরতা ঠিক রাখার সুবিধা হয়। রোপণের পর জমির এক কোনায় কিছু বাড়তি চারা রেখে দিতে হয়। এতে রোপণের ১০-১৫ দিন পরে যেসব জায়গায় চারা মরে যায় সেখানে বাড়তি চারা থেকে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। ফলে জমিতে একই বয়সের চারা রোপণ করা হয়।

সেচব্যবস্থা
গাছের প্রয়োজনমাফিক সেচ দিলে সেচের পানির পূর্ণ ব্যবহার হয়। বোরো ধানের জমিতে সব সময় পানি ধরে রাখতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। বোরো মওসুমে সাধারণত ধানের সারা জীবনকালে মোট ১২০ সেন্টিমিটার পানির প্রয়োজন। তবে কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের দুধ হওয়া পর্যন্ত পানির চাহিদা দ্বিগুণ হয়। এ সময় জমিতে দাঁড়ানো পানি রাখতে হয়। কারণ থোড় ও ফুল অবস্থায় মাটিতে রস না থাকলে ফলন কমে যায়।

সেচ নিয়ে আরো কথা
ধান গাছ কোনো জলজ উদ্ভিদ নয় তবে পানি বেশি পছন্দ করে। এজন্য সারাক্ষণ পানিতে ভাসিয়ে জমি টইটম্বুর করে রাখা ঠিক নয়। পানি বেশি হলে বিভিন্ন ছত্রাকজনিত রোগ, রোগের জীবাণু ছড়ায়, গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফুল/ফল ঝড়ে পড়ে ও দানা পুষ্ট হয় না। পরিশেষে  ফলন কম হয়। আবার অন্যদিকে পানি কম হলে খাদ্য গ্রহণ বা পরিবহনে ব্যাহত হয়, খাদ্য তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়, গাছ মরে যেতে পারে,  ফুল-ফল দেরিতে আসে,  আগাছা বেশি হয় এবং দানা পুষ্ট হয় না। ফলশ্রুতিতে ফলন কম হয়। ধানে বৃদ্ধির কোন পর্যায়ে কী পরিমাণ পানি লাগে তা জানিয়ে দিচ্ছি। চারা লাগানো সময় ছিপছিপে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পানি লাগে। এর কম বা বেশি হলে রোপণে অসুবিধা হয়। চারা লাগানোর থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত  দেড় থেকে দুই ইঞ্চি। পানি কম হলে রোপণ ঝুঁকি সামলে উঠতে বেশি সময় লাগে আর বেশি হলে চারা হেলে পড়ে। চারা লাগানোর ১১ দিন পর থেকে থোড় আসা পর্যন্ত এক থেকে দেড় ইঞ্চি। এর কম বা বেশি হলে কুশি কম হয়। কাইচ থোড় হওয়ার সময় থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত দুই থেকে চার ইঞ্চি। এ সময় রসের ঘাটতি হলে দানা গঠন পুষ্ট হবে না, দানার সংখ্যা কম হবে। আর পানি বেশি হলে গাছ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ধানে দানা শক্ত ক্ষীর হলে অর্থাৎ ধান কাটার ১০-১২ দিন আগ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পানি বের করে দিতে হবে।

ধানের জমিতে সেচের মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে লেদা পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, থ্রিপস, ছাতরা পোকা, কাটুই পোকা, উড়চুঙ্গা আর রোগের মধ্যে ব্লাস্ট, বাদামি দাগ এবং অধিকাংশ আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যদিকে নিষ্কাশন বা পানি সরিয়ে দেয়া মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে পাতা মাছি, চুংগি পোকা, বাদামি গাছফড়িং, সাদাপিঠ গাছফড়িং, রোগের মধ্যে বিভিন্ন ছত্রাক রোগ, পাতা পোড়া রোগ এবং আগাছার মধ্যে শেওলা, পানিকচু, কচুুরিপানা বা চেচড়া জাতীয় আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

বোরো মৌসুমে ধান আবাদে খরচের অন্যতম প্রধান খাত হলো সেচ। আগামীতে সেচের খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। পানি সাশ্রয়ী একটি কার্যকর পদ্ধতির নাম পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতি বা এডব্লিউডি। জমিতে একটি পর্যবেক্ষণ পাইপ বা চোঙ বসিয়ে সহজেই সেচ দেয়ার সময় নির্ধারণ করা যায়। গভীর নলকূপে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি বিতরণে করা হলে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ অপচয় রোধ করা যায়, সময় শতকরা ৩০ ভাগ কম লাগে, উঁচু-নিচু জমিতে সহজেই পানি বিতরণ করা সম্ভব। এর ফলে সেচ এলাকা শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। নিশ্চিত

ধান কাটার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি বের করে দিতে হবে। এছাড়া জমি শুকিয়ে নিতে হবে। এতে মাটিতে জমে থাকা দূষিত বাতাস বের হয়ে যাবে এবং চারাগুলো মাটির জৈব পদার্থ থেকে সহজে খাবার গ্রহণ করতে পারবে।

Post a Comment

0 Comments