সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ভেন্না বা রেঢ়ী চাষ

ভেন্না, ভেরেন্ডা, রেঢ়ী বা ক্যাস্টর চাষ
ভেরেন্ডা, ভেন্না বা রেঢ়ী

ভেন্না, ভেরেন্ডা বা রেঢ়ী। এর তেলকে বলে ক্যাস্টর অয়েল। বৈজ্ঞানিক নাম : Ricinus Communis. Malpighiales বর্গের Euphorbiaceae পরিবারের Acalypheae গ্রোত্রের একটি উদ্ভিদ। যা কিনা আগাছা হিসাবেই সুপরিচিত। এই ভেন্নার বীজে তেলের পরিমান ৪৫-৬০% তেল থাকে যা ট্রাই গ্লাইসিরাইড যার বেশির ভাগ রাইসোলেনিক এসিড।

ভেন্না বহুবর্ষজীবি উদ্ভিদ। ভেন্না গাছ ১০-১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। প্রায় ডালপালাওহীন গাছ, উপরের দিকে অল্পকটি ডাল হতে দেখা যায়। গাছের কাণ্ডের ভেরতটা ফাঁপা থাকে। কাণ্ডের বেড় ৫-৬ ইঞ্চি হতে পারে। কাণ্ডে ৫-৬ ইঞ্চি দূরে দূরে একটি করে গিঁট থাকে। প্রতিটা গিট থেকে বেরোয় একটা করে পাতা।
কান্ড ধূসর প্রকৃতির এবং ফাঁপা হয়।

ভেন্না গাছ দেখতে কিছুটা পেঁপে গাছের মত, হালকা-পলকা গাছ পাতেও দেখতে অনেকটা ছোট পেঁপে পাতার মতই। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাতার উদ্ভিদের মধ্যে ভেন্না একটি। লম্বা বোঁটা বা ডাঁটা যুক্ত সবুজ এই পাতার ব্যস এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত হতে পারে। বোঁটা দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। বোঁটার ভেতরটাও পেঁপে ডাটার মতই ফাঁপা হয়। পাতার বাইরের কিনারে খাঁজকাটা খাঁজকাটা থাকে।

ভেড়েন্ডার আদি নিবাস সম্ভবত আফ্রিকা। এর ব্যাপক আবাদ হয় ভারত, মেক্সিকো ও ব্রাজিলে। বাংলাদেশে সর্বত্র জন্মে, গ্রামাঞ্চলে কেউ কেউ বসতভিটার আশেপাশেরোপণ করে, কিংবা বনেবাদাড়ে আপনিতে জন্মে। মার্চ-এপ্রিল মাসে বীজ বপন করতে হয়। গাছে ফুল ও ফল হয় আগস্ট-সেপ্টেম্বরে। ভেড়েন্ডা জলা জায়গায় বাঁচে না। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪৭৩ হেক্টর জমিতে ২৮০ মে টন ভেরেন্ডা ফলে।

ফরিদপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, পটুয়াখালী জেলায় বেশি চাষ হয়। বীজে তেলের পরিমাণ হয় ২০-৫০%। ভেরেন্ডার তেল ভোজ্য তেল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।তবে এ তেল কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে এবং বিভিন্ন শিল্পকার্যে ব্যবহূত হয়। বার্নিশে, উন্নতমানের সাবান তৈরিতে, কলকারখানার যন্ত্রপাতি পিচ্ছিলকরণে এবং কৃত্রিম চামড়া তৈরিতে ভেরেন্ডার তেল ব্যবহৃত হয়। তদুপরি প্রকৃত চামড়া ড্রেসিং এবং রং ও প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরিতেও কাজে লাগে। খৈলে বিষাক্ত রাইসিন (ricin) থাকায় পশুখাদ্যের অনুপযোগী, তবে সার হিসেবে ভাল। পাতা গবাদি পশু ও রেশমপোকার খাদ্য। কোন কোন এলাকার আদিবাসীরা মাথা ব্যথায় কপালে পাতার মন্ডের প্রলেপ লাগায়।

সাধারণত বর্ষাকালে ভেন্নার চারা গজায়। প্রতি বছর হেমন্ত ও শীতকালে ভেন্নার ফুল-ফল হয়। ভেন্না গাছের মাথায় থোকা থোকা লালচে ফুল হয়। ফলও হয় থোকা থোকা, একেকটা প্রায় এক ইঞ্চির মত। সবুজ ফলের গায়ে নরম নমর কাঁটা থাকে। কাটা এতোই নমর যে গায়ে ফোঁটে না।

ফলের ভিতরে ৩ বা ৪টা কালো বাদামী ছোপের বীজ থাকে। ভেন্নার এই বীজ থেকেই তৈরি হয় ক্যাস্টর অয়েল।

ভেন্নার তেলের উপকারী গুণ

১. কাচা ভেন্না সবজি হিসাবে খাওয়া যায়( পরিপক্ক বীজ এবং ফল খাওয়া উচিত নয়)
২. চুল পরা রোধ করতে
৩. চুলকে ঘন করতে
৪. চোখের আইব্রো কে ঘন এবং কালো করতে
৫. ত্বক কে মোলায়েম করতে ব্যবহার করতে ভেন্নার তেল
৬. স্কিন থেকে ময়লা দূর করতে
৭. ডার্ক সার্কেল থেকে মুক্তি পেতে ব্যবহার করুন ভেন্নার তেল
৮. শুস্ক ত্বক কে মোলায়েম করে
৯. ত্বকের বর্নবিলোপ দূর করে
১০. বলিরেখা দূর করে
১১. ত্বকের কালো দাগ দূর করে
১২. মাথার স্ক্যাল্প কে সুস্থতা দান করে
১৩. চুলের কন্ডিশন করতে
১৪. গোলাকৃমির চিকিৎসার জন্যে এই তেল উপকারী
১৫. কাটা ঘায়ে জীবানুমুক্ত করতে
১৬. ব্যাক পেইন কে দূর করতে
১৭. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কে শক্তিশালী করে
১৮. জয়েন্ট পেইন কে ধ্বংস করে
১৯. ফুড এডিটিভস হিসাবে ব্যবহৃত হয়
২০. ফুডের ফ্লেভার করতে ভেন্নার তেলের বিভিন্ন রেসিপি আছে
২১. ফাংগাস প্রতিরোধে করে ফলে মোল্ড প্রতিরোধ করে
২২. বীজ সংরক্ষণ করতে এর জুড়ি মেলা ভার
২৩. ফুড প্যাকেজিং করতে ভেন্নার তেল ব্যবহৃত হয়
২৪. আধুনিক ফার্মা কোম্পানিতে বিভিন্ন মেডিসিন বানাতে ভেন্নার তেল একটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
যেমন – এন্টি ফাংগাল(মাইকোনাজোল)
– আলসার চিকিৎসায়
– ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে
– প্যাক্লিক্যাক উপাদান হিসেবে
– আরও অন্যান মেডিসিনের প্রিকারসর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২৫. ঠোঁট ফাটা রোধ করতে
২৬. পা ফাটা রোধা করে
২৭. নখের অসুস্থতা য় ব্যবহৃত হয় ভেন্নার তেল
২৮. বায়োফুয়েল হিসাবে ভেন্নার তেল সাশ্রয়ী।
২৯. এয়ারক্র্যাফট এর জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
৩০. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রোটারি মেশিন এর ইঞ্জিন ওয়েল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ভেন্নার তেল
৩১. লুব্রিকেশন এর কাজে উত্তম লুব্রিকেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়
৩২. খাদ্য সামগ্রী কোটিং করতে ব্যবহৃত হয় ভেন্নার তেল
৩৩. ইটলীর মুসোলিনি শত্রুদের শাস্তি দিতে এর তেল ব্যবহার করেছিলেন
৩৪. এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসকেরা এই তেল খাইয়ে এদেশের মানুষ দের শাস্তি দিত
৩৫. ক্যাস্টর ওয়াক্স বানাতে ক্যাস্টর ওয়েল
৩৬. এই তেলে রয়েছে ভিটামিন ই, মিনারেল, প্রোটিন এবং অন্যান্য পুস্টি উপাদান
৩৭. আইল্যাশ ঘন করতে এই তেল ব্যবহৃত হয়
৩৮. গর্ভাবস্থার দাগ দূর করতে ব্যবহৃত হয়
৩৯. চোখের ছানি পড়া দূর করতে ব্যবহৃত হয়
৪০. ফোড়া সারাতে এই তেল দারুন কার্যকরী
৪১. গায়ের আচিল দূর করতে এই তেলের অসাধারন গুন রয়েছে
৪২. নাকডাক বন্ধের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এই তেল
৪৩. পেট ফাপা দূর করতে এই তেল বেশ উপকারী
৪৪. তারুণ্য ফিরে পেতে ক্যাস্টর অয়েল দারুন
৪৫. হেপাটাইটিস এর চিকিৎসা য় ব্যবহৃত হয়
৪৬. কন্ঠের কর্কশ ভাব দূর করতে এই তেল ব্যবহৃত হয়।
৪৭.এলার্জির চিকিৎসার উপাদান হিসাবে ব্যবহার হয়
৪৮. ত্বকে পুষ্টি যোগাতে এই তেলের তুলন নেই
৪৯. মালিশের কাজে ব্যবহৃত হয়
৫০. ভেন্নার খইল অর্গানিক সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
( ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত কে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে হবে।)

 জাত এবং চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশে অনুমোদিত জাত নেই কিন্তু লাল এবং সবুজ নামে দুইটি স্থানীয় জাত রয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়ার রয়েছে ৮ টি উফশী জাত এরমধ্যে NPH-1, TMV5, TMV6, CO1 ইত্যাদি প্রসিদ্ধ।

চাষাবাদ :  বাংলাদেশের জলবায়ু এবং আবহাওয়া ক্যাস্টর চাষের উপযোগী। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ৫০০-৮০০ মিমি.

মাটি :  যেকোন অনুর্বর মাটিতে ভেন্না চাষ হতে পারে। তবে মাটির পিএইচ ৫.৫-৬.০ হলে ভাল। বেলে দো আশ মাটিতে ভেন্না ভাল হয়।

রোপণ সময় :  বর্ষার আগে জুন মাসে / বছরের যে কোন সময়। সেচ এবং বৃষ্টি নির্ভর পদ্ধতি চাষ করা যায়।

জমি তৈরি : আগাছা পরিষ্কার করে ৩-৪ চাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে।

বীজের হার এবং বপন:  ১০-১২/হেঃ, চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪০-৬০ সেঃ মিঃ এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০-১২০ সেমি।

সার ব্যবস্থাপনা:  তেমন সার লাগে না তবে ভাল ফলনের জন্যে N: P: K অনুপাত হবে ৪০কেজি : ৪০কেজি : ২০কেজি হেক্টর
প্রতি। ইউরিয়া অর্ধেক শেষ চাষের সময় বাকি সার এক সাথে আর বাকি অর্ধেক ইউরিয়া চারা গজানোর ৩০ -৪০ দিন পর দিতে হবে। অধিক ফলনের জন্যে ২০কেজি/হেঃ সালফার ব্যবহার করলে ভাল হয়।

রোগ বালাই: তেমন হয় না তবে পড বোরার দেখা যায় মাঝে মাঝে।

ফসল সংগ্রহ: ১৪০-১৭০ দিনের মধ্যে ফল পাকতে শুরু করে এবং ২-১ টি ফল পেকে শুকিয়ে গেলেই সংগ্রহ করতে হবে এবং মাড়াই করে সংরক্ষণ করতে হবে।

ফলন: বৃষ্টি নির্ভর ৩৫০-৫০০ কেজি/হেঃ এবং সেচ নির্ভর পদ্ধতিতে ৭০০-৮০০ কেজি ক্যাস্টর বীজ পাওয়া যায়। আন্তঃফসল হিসেবে বাদাম, ছোলা ইত্যাদি চাষ করে বাড়তি আয় সম্ভব হয়।

Post a Comment

2 Comments

  1. ভেন্না সম্পর্কে দারুন তথ্য দিয়েছেন, অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি নিজেই এই তেলের প্রোডাকশন করি। এর খৈল দারুন জৈব সার হিসেবে কাজ করে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ

      Delete