সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

গাঁজা সম্পর্কে কতোটুকু জানেন: পুরোটাই কি ক্ষতিকর!


পূর্ণবয়স্ক গাঁজা গাছ

আমাদের দেশে গাঁজাখোর বলে একটা গালি আছে। গাঁজা সেবনের কারণেই এক শ্রেণীর সাধু সন্যাসীদের আমরা অপছন্দ করি, এমনকি গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও আছে। কারণ গাঁজা মানেই আমরা নেশাদ্রব্য বলেই জানি। কিন্তু আসলে এ জিনিসটা কী, গাঁজা, সিদ্ধি, হাসিস, চরস এগুলোও তো আগেকার দিনের সাধ্য সন্যাসীরা খাইতেন। এসব জিনিস কী আলাদা নাকি একই? এগুলো কীভাবে প্রস্তুত ও সেবন করা হয়? মাদক হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি আর কি কোনো উপকারী দিক আছে? সেগুলোই জানার চেষ্টা করবো এ লেখায়।

ব্যথানাশক চিকিৎসায় গাঁজার ব্যাবহার নিয়ে এখন সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা একমত। ফলে বিশ্বব্যাপী গাঁজা নিয়ে মানুষের খারাপ ধারনা পাল্টে যাচ্ছে। কানাডা ও নেদারল্যান্ডের মতো অনেক দেশই এখন গাঁজা বৈধ করছে। কানাডা এখন গাঁজা রফতানি করেই বিলিয়ন ডলার আয় করছে। যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকার গাঁজা বিক্রয় এবং সেবন নিষিদ্ধই রেখেছে তবে দেশটির অন্তত ২০টি অঙ্গরাজ্য চিকিৎসা এবং অনেকে বিনোদনের জন্যও গাঁজার ব্যবহার বৈধ করেছে। আরো কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বৈধ করা নিয়ে আলোচনা চলছে।

গাঁজা নিয়ে যুদ্ধ
আফিমের নিয়ে চীনে এক সময় টালমাটাল অবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা চীনে জাহাজ ভর্তি করে আফিম নিয়ে যেত, বিনিময়ে আনা হতো রৌপ্যমুদ্রা। এর ফলে ওই সময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে আফিমের চাষ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, সরকারি উদ্যোগে ভারতে তখন আফিম চাষ করা হতো। ব্রিটিশ রাজের এ ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে ক্ষেপে যায় চীন। এমনকি তা যুদ্ধ অবধি গড়ায়। এটি ইতিহাসে আফিমের যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়ে আছে। মূলত এ যুদ্ধের পরপরই সারা বিশ্বে মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। অনেক দেশ মাদক নিষিদ্ধ করে নানা আইন করে। কিন্তু ২০১০ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলনের জেরে ২০১২ সালে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে গাঁজা বৈধ করার পর মাদক নিয়ে এতোদিনের ধারনা আবার ধাক্কা খায়। 

গাঁজা আসলে কী?
মাদক হিসেবে গাঁজার ব্যাবহার খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে। হিন্দুধর্মের অথর্ব বেদ এবং পুরাণেও গাঁজার কথা উল্লেখ আছে। পুরাণে উল্লেখ আছে দেবতারা গাঁজা গাছের জন্ম দিয়েছেন এবং সমুদ্র মন্থনকালে অমৃত থেকে গাঁজা গাছের উৎপত্তি। ইউরোপে গাঁজা ব্যাবহারের তথ্য পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ সালে গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাসের লেখায়।

গাঁজার জাত/প্রজাতি
গাঁজার বিভিন্ন প্রজাতিকে একত্রে মারিজুয়ানা বলে। পশ্চিমে এটিকে উইডও বলা হয়। দেশে তরুণ গঞ্জিকাসেবনকারীরা বলেন সবজি, কেউ বলেন শুকনা! ধারনা করা হয় মারিয়া ও জুয়ানার নামানুসারে গাঁজার এই নামটি প্রথম দেয় মেক্সিকানরা। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। গাঁজা সেবনে স্নায়ু উত্তেজিত হয় বলে এর আরেক নাম ‘হর্ষিণী’।' এছাড়া চার্জ , ড্যাগো (দক্ষিণ আফ্রিকা), গ্রাস, হাস, হেম্প, কিয়েফ ( উত্তর আফ্রিকা), পট, টি, জয়েন্ট, উইড (উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা), গাজে, গাঞ্জো (ওয়েস্ট ইন্ডিস) ইত্যাদি নাম রয়েছে।

গাঁজা সংগ্রহ করা হচ্ছে

গাঁজা গাছ
গাঁজা গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Canabis sativa Linn . স্ত্রী-পুরুষ গাছ আলাদা। দুই গাছেই ফুল বা মঞ্জুরি হয়। কিন্তু শুধু স্ত্রী গাছ থেকেই গাঁজা, ভাং বা চরস তৈরি করা হয়। পুরুষ গাছ থেকে মাদক হয় না! এটা অনেক মশার মতো। শুধু স্ত্রী মশাই রক্ত খায়। 
Cannabis sativas L.এর দুটো উপ-প্রজাতি (subspecies) আছেঃ
১। Cannabis sativa ssp sativa
২। Cannabis sativa ssp indica
Indica এর পাতা চওড়া আর sativa এর পাতা চিকন হয়। sativa গাছ indica এর চেয়ে লম্বা হয়। গাঁজা, ভাং, সিদ্ধি, চরস, হাসিস এসবের মধ্যে পার্থক্য আছে। 

গাঁজা: স্ত্রীফুলকে ৪৮ ঘণ্টা রৌদ্রে শুকালে ফুলগুলো জমাট বেঁধে যায়। এই জমাটফুলই গাঁজা নামে বিক্রি হয়। সাধারণত কল্কিতে গাঁজা ভরে অগ্নিসংযোগ করে এর ধোঁয়া গ্রহণ করা হয়। এছাড়া সিগারেট বা বিড়ির মতো করে গাঁজা ভরে (পুরিয়া, স্টিক) এর ধুমপান করা হয়।

ভাং: স্ত্রী উদ্ভিদের ভূ-উপরিস্থ অংশ (পাতা ও কাণ্ড) শুকিয়ে বা কাঁচা অবস্থায় পিষে পানির সাথে মিশিয়ে শরবত বানিয়ে পান করা হয়। নেশাকারক উপাদান কম থাকে বলে গাঁজা অপেক্ষা ভাং কম দামে বিক্রয় হয়। ভাং এর শরবত পুরানো ঢাকায় খুব বিখ্যাত। হিন্দুদের কালি পূজায় ভাং এর সরবত তৈরি করা হয়।

সিদ্ধি: গাঁজা গাছের পাতা শুকিয়ে সিদ্ধি তৈরি করা হয়। সিদ্ধি থেকে অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে ঔষধ তৈরি করা হয়। এছাড়া সিদ্ধি মুখে পুরে চিবিয়ে নেশা করে অনেকে।

চরস: গাছের আঠা থেকে চরস তৈরি হয়ে থাকে। অনেক সময় গাঁজার ফুল শুকানোর সময় যে গুঁড়া উৎপন্ন হয়, তা আঠার সাথে যুক্ত করে চরস তৈরি হয়ে থাকে। অনেক সময় এই আঠা পাওয়ার জন্য গাঁজার গাছ কেটে দেওয়া হয়। সাধারণত indica দিয়ে চরস তৈরি করা হয়।

হাসিস: গাঁজার স্ত্রীফুলের নির্যাস থেকে হাসিস তৈরি করা হয়। গাঁজা গাছ থেকে উৎপন্ন সকল নেশা দ্রব্যের মধ্যে হাসিসকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়।

রোগ নিরাময়ে গাঁজা
গাঁজা বলতেই একটা নেতিবাচক ধারনা মাথায় চলে আসে। আঁতকে ওঠি মাদকের কথা ভেবে। অথচ রোগ নিরাময়ে গাজার ব্যবহার আমাদের হয়ত অতটা জানা নেই। অনেক রোগে গাঁজার ব্যবাহারের কথা শোনা যায়।

গাঁজা সেবন ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমায় না বরং বাড়ায়। Journal of the American Medical Association এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে। ৫,১১৫ জন রোগীর উপর ২০ বছর চালানো ও্ই গবেষণায় দেখা গেছে তামাক সেবনকারীদের ফুফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে অথচ গাঁজা সেবনকারীদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

Robert J. DeLorenzo, of Virginia Commonwealth University তে ইঁদুরের উপর পরিচালিত এক নিরীক্ষায় দেখা গেছে গাঁজার নির্জাস এবং কৃত্রিম গাঁজা মৃগী রোগ উপশমে যথেষ্ট অবদান রাখে। গাঁজা সেবনের ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত ইঁদুরগুলো খিচুনি (seizure) মুক্ত ছিল।

Dravet Syndrome চিকিৎসায় গাজার উপকারিতা অতুলনী। Dravet Syndrome মৃগি রোগের একটা প্রকটতম রুপ। Dravet Syndrome এ আক্রান্ত শিশু শার্লটের গাজাঁ সেবনে সুস্থ্য হয়ে উঠার কাহিনী গণমাধ্যমে এ বহুল প্রচারিত হওয়ার ফলে রাতারাতি গাজা সম্পর্কে মানুষের ইতিবাচক ধারনা বাড়তে শুরু করেছে।

গ্লুকোমার (glaucoma) চিকিৎসায় গাজার ব্যবহার হয়ে থাকে।

২০০৭ সালে California Pacific Medical Center in San Francisco তে গবেষনা করে দেখা গেছে CBD (cannabidiol) ক্যান্সার বিস্তৃতি প্রতিরোধ করতে যথেষ্ঠ সহায়তা করে। কেমোথেরাপি নেয়ার ফলে সৃষ্ট ব্যাথা এবং বমি বমি ভাব দূর করতে গাঁজার ব্যবহারে উপকৃত হয়েছেন বলে অনেকে জোর দাবী করেন।

Scripps Research Institute এর মতে গাজা আলঝেইমার বা স্মৃতিভ্রম (Alzheimer’s disease) রোগের অগ্রগতি রোধে (রোগ আর বাড়ে না) ভূমিকা রাখে।

গাজা হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসার পার্শ প্রতিক্রিয়া কমিয়ে চিকিৎসাটিকে আরও কার্যকর করে তোলে। তাছাড়াও গাজা ব্যথা উপশমে, ঘুমাতে সাহায্য করে এবং প্রদাহ কমিয়ে গেঁটে বাত জনিত অস্বস্তি দূর করে।

ইসরাইলে গবেষনা করে দেখা গেছে গাজা পারকিনসন্স (Parkinson’s disease) রোগের কারনে সৃষ্ট দেহের কাপুনি এবং ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে।

কঙ্কাশন এবং ট্রমা নিরোধে গাজা সক্রিয় ভুমিকা রাখে।

অনিদ্রা রোধ এবং বিচলন নিয়ন্ত্রনহীনতা (ইনসোমনিয়া) উপশমে গাজার ব্যবহার আছে।

Post a Comment

2 Comments