সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

গরমকালে গরু-ছাগলের পরজীবী: আটালি, উকুন, মাছি

আটালি আক্রান্ত গরু
পশুপাখির শরীরের বাইরে বাস করে ও পুষ্টি শোষণ করে জীবন ধারণ করে জীবের নামই বাহ্য পরজীবী। এর মধ্যে উকুন, আটালি, মাইট, মেঞ্চ, মশা-মাছি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও মুরগির খামারে অর্থনৈতিক ক্ষতির জন্য বাহ্য পরজীবী একটি অন্যতম কারণ। বাহ্য পরজীবী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রাণীর ক্ষতি করে থাকে।

প্রত্যক্ষ ক্ষতিগুলো
সরাসরি রক্ত চুষে খায়, ফলে প্রাণী রক্তশূন্য হয়ে পড়ে ও সব ধরনের উৎপাদন কমে যায়। উকুন, আটালি, মশা-মাছি দংশন করার সময় প্রাণী অস্থির ও অস্বস্তি বোধ করে ফলে পেট ভরে খেতে পারে না, এতে করে উৎপাদন কমে যায়।

পরজীবীর কামড়ের কারণে প্রাণীটি শক্ত কোনো কিছুর সাথে (যেমন: ইটের দেয়াল, চৌকাঠ) শরীর ঘষাঘষি করে ফলে চামড়া ও লোম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পরজীবীর কামড়ের কারণে প্রাণীর চামড়ায় pruritis Allergic (এক ধরনের এলার্জি) ক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।

শীতকালে নবজাত বাছুর, ছাগলছানা অতিরিক্ত উকুন, আটালি দ্বারা আক্রান্ত হলে রক্তশূন্য হয়ে মারাও যেতে পারে।

বিশেষ প্রজাতির আটালির লালাগ্রন্থি থেকে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত হয়, যা পোষক প্রাণীটিকে প্যারালাইসিস (অচল) করে ফেলে।

বাহ্য পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত খামারে একসঙ্গে সব প্রাণীকেই চিকিৎসা দিতে হয়। ফলে চিকিৎসা খরচ বেড়ে যায়।

পরোক্ষ ক্ষতি
কতকগুলো বাহ্য পরজীবী অসুস্থ প্রাণী থেকে সুস্থ প্রাণীতে রোগ ছড়াতে সাহায্য করে। যেমন-

ক. আটালি : বেবিসিওসিস, এনাপ্লাজমোসিস, Dermatophilosis,,  থেইলেরিওসিস, Heart water diease.
খ. ফ্লি/ মাছি : ওলান প্রদাহ, KeratoconJnuctivitis, Trypanosomiasis ও অন্যান্য রোগ।
গ. Midges : Blutongve, African horse sicknes অন্যান্য রোগ।
ঘ. Culicoides midges : Blutongue, কিছু বাহ্য পরজীবী ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে (Vector of viruses),   যেমন-
১. Blurongue
২. Africon horse sickrum
৩. Epigootic Hemorrhagic diease
৪. Akabune
৫. Bovine ephimeral fever.

কতকগুলো বাহ্য পরজীবী অন্তঃপরজীবীর (যেমন: কৃমি) বাহক হিসেবে কাজ করে যেমন,
ক. Haemoprotevs
খ. Leucocy togoon
গ. Onchocerca
ঘ. Mansonella ইত্যাদি।

উকুন
আমাদের দেশে গরু, ছাগল ভেড়া, মুরগি শীত কালের শেষের দিকে উকুন দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে, প্রাণীর তলপেট, কান গলকম্বল, লেজের মাথ, থুতনির নিচে, পায়ের কুচকির মধ্যে বেশি হতে দেখা যায়। বয়স্ক প্রাণী অপেক্ষা অল্প বয়স্ক প্রাণীকে বেশি আক্রান্ত করে।

প্রতিটি প্রজাতি প্রাণীয় উকুন আলাদা আলাদা, অর্থাৎ গরুর উকুন কখনই মুরগিকে ধরবে না।

উকুন ২ প্রকার

ক. শোষক উকুন : কামড়ায় ও রক্ত শোষণ করে।
খ. দংশনকারী উকুন : শুধু কামড়ায়।

আটালি
আমাদের দেশের গবাদিপ্রাণী গরমকালে আটালি দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। আটালির আকার কতগুলো খুব বড় আবার কতগুলো খুব ছোট। আটালি প্রাণীর কানে, ওলানে, পায়ে, তলপেটে, পায়ের কুচকির মধ্যে, মলদ্বারের চারপাশে ও লেজের মাথায় বেশি দেখা যায়। আটালি সব সময় পোষকের দেহে লেগে থাকে না। রক্ত খেয়ে দিনে গোশালার বিভিন্ন জায়গা যেমন- ছোট গর্ত, ফাটা স্থান, বেড়ার ফাঁক ও বিভিন্ন আবর্জনার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। বর্ষাকালে, বন্যার পরে আটালির আক্রমণ বেড়ে যায়। বন্যার পর অবশ্য মশা-মাছির আক্রমণও বাড়ে।

একটি প্রাপ্তবয়স্ক আটালি না খেয়ে (পোষক ছাড়া) ২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, আটালির শক্ত বহিরাবরণের কারণে কীটনাশক প্রয়োগে নিধন করা সম্ভব হয় না। আটালি সারা বিশ্বেই গবাদিপশুকে আক্রমণ করে।   

আটালি ২ প্রকার
ক. Ixodids- hard tick
খ. Argadis – Soft tick

আবার পোষক (Host)  সংখ্যার ওপর ভিত্তি করেও আটালিকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
যথা- ১. একক পোষক (Monohost)  আটালি।
      ২.  বহু পোষক (Multi host)   আটালি।

আটালির জীবন চক্র
ডিম => লার্ভা =>  নিম্ফ =>  প্রাপ্তবয়স্ক আটালি

মাইট ও মেঞ্চ
প্রাণী দেহে মাইট সংক্রমণের ফলে মারাত্মক চুলকানি ও অস্বস্তি বোধ তৈরি করে। খাদ্য গ্রহণ খুব কমে যায়। চামড়া ও লোমের মারাত্মক ক্ষতি করে। গরু বা ছাগলের লোম ঝরে গিয়ে চামড়া বেরিয়ে পড়ে। ফলে অনেক সময় পুষ্টি ঘাটতিজনিত লোম ঝরে যাওয়ার সঙ্গে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। মাইটগুলো প্রাণির শরীরের লোমের ফলিকুল এবং ত্বকের সিবাসিয়াম গ্রন্থিকে আক্রান্ত করে। মাইট খালি চোখে দেখা যায় না। চামড়া থেকে Scrapping নিয়ে স্লাইডে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায়।

মানুষসহ সব প্রাণীর চর্মরোগকে মেঞ্চ বলে। মেঞ্চ শরীরের যে কোনো অংশে বা সমস্ত শরীরে হতে পারে। চামড়া চাকা চাকা ও পুরু হয়ে ফুলে যায় বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জডুল হয়। মেঞ্চ আক্রান্ত স্থানের লোম কমে যায়। চর্ম প্রদাহ বেশি এলাকাজুড়ে হলে প্রাণীর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায় ও উৎপাদন কমে যায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংস্পর্শে সংক্রামিত হয়।

ছাগল, ভেড়ার চামড়া পুরু হয়ে লোমশূন্য হয়ে পড়ে। গরুর লেজে, উরুতে ও ওলানে, ঘোড়া পায়ে হতে দেখা যায়। মাইট চামড়ায় ক্ষত সৃষ্টি করে ফলে খুব চুলকায় ও জ্বালাপোড়া হয়। ক্ষতের উপায় সিরাম ক্ষরিত রস জমে মাসড়ি পড়ে। কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালের কানে আক্রান্ত করে ফলে পা দিয়ে কান চুলকায়।

মাইট ও মেঞ্চ সাধারণত শীতকালে বেশি হয়। তবে গরম শুরু হলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব কমে যায়। তবে একবার খামারে এ রোগ দেখা গেলে আক্রান্ত পশুকে আলাদা করতে হবে। কারণ এটি সংক্রামক। সংস্পর্শে থাকলে বা একই পাত্রে খাবার দিলে বা একই জিনিসের স্পর্শের কারণেও এটি সুস্থ পশুর শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

চিকিৎসা
১. ইনজেকশন Ivertin/ Ivermactin- : ১/৫০  কেজি ওজন S/C অথবা, Ivermectin pour on - প্রাণীর মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে প্রয়োগ করতে হবে।

Cypermelthrin/ pyremethrin/ Bifenthrin/ Carbaryl/Negutox - এসব ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নির্দেশনা, মাত্রা, নিরাপত্তা বিষয়ে পড়ে ব্যবহার করতে হবে।

প্রতিরোধ ব্যবস্থা
> শেডের ভেতরে ও বাইরে পরিষ্কার রাখতে হবে। ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করতে হবে।
> গরমকালে মশা, মাছি, উকুন ও আটালির আক্রমণ বেশি হয়, তাই এ সময় নজরদারি বাড়াতে হবে। আক্রমণ  দেখা মাত্র নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে।
> গাভীর শেড থেকে দূরে গোবরের স্তূপ স্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে গাভীর শেডে Acaricide জাতীয় ওষুধ স্প্রে করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পরামর্শের জন্য ভেটেরিনারিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
> গবাদিপ্রাণী বাহ্য পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া মাত্রই ওষুধ প্রয়োগ করে নিধন করে বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

Post a Comment

0 Comments