উন্নত প্রজাতির ঘাসগুলো যেমন : নেপিয়ার, পারা, জার্মান, ইপিলইপিল, আলফালফা ইত্যাদি মোটামুটি নিরাপদ। তবে কচি অবস্থাতে অথবা বেশি পরিমাণে নাইট্রোজেন সার যেমন- ইউরিয়া প্রয়োগে এগুলোও বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে।
আকন্দ, কাঁটা বেগুন, অধিকাংশ ফুলগাছ যেসব বাগানে লাগানো হয়, শরগম বা জোয়ার, সুদান ঘাস, সুদান শরগম হাইব্রিড ঘাস, ভেলভেট বা কার্পেট ঘাস, বাকহুইট বা বাজরা, কিছু জংলি লতা, ক্লোভার বা চারপাতা বা তিনপাতা ঘাস (জমিতে হয়, শাক হিসেবে খাওয় যায়) , ভেন্না বা ভেল্লা, এমনকি দূর্বা জাতীয় ঘাসেও (জনসন গ্রাস, বার্মুডা গ্রাস ইত্যাদি) বিষাক্ত উপাদান আছে।
তিন ধরনের বিষক্রিয়া হতে পারে
প্রুসিক এসিড পয়জনিং
এটা সায়ানাইড পয়জনিংও বলে। এই ধরনের বিষক্রিয়া ছাগল এই বিষযুক্ত খাবার গ্রহণের ১৫ মিনিটের মধ্যে লক্ষ্যণ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে মুখ দিয়ে লালা ঝরা, দ্রুত ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেয়া, পাঁচ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করবে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে। পেশী শক্ত হয়ে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। এসব দেখা দেওয়ার শুরু করার দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ছাগল মারা যাবে।
এখানে উল্লেখ্য, রুমিন্যান্ট পশু ননরুমিন্যান্টের চেয়ে বেশি প্রুসিক এসিডে (সায়ানাইড) আক্রান্ত হয়। এর একটি কারণ হলো রুমেনে প্রচুর হাইড্রোসায়ানাইড এসিড তৈরি হয়।
সায়ানাইড যেসব ঘাস বা উদ্ভিদে থাকে : তিসি, বাবলা, দূর্বা জাতীয় ঘাস যেমন : জনসন গ্রাস ও বার্মুডা গ্রাস,আকন্দ, কাঁটা বেগুন, অধিকাংশ ফুলগাছ যেসব বাগানে লাগানো হয়, শরগম বা জোয়ার, সুদান ঘাস, সুদান শরগম হাইব্রিড ঘাস, ভুট্টা বা ভুট্টা জাতীয়।
২০% সোডিয়াম নাইট্রেট (sodium nitrite, 20%) দিয়ে সায়ানাইড পয়জনিং এর চিকিৎসা করা যেতে পারে। এই ইনজেকশন শিরায় দিতে হবে। সেই সঙ্গে সোডিয়াম থায়োসালফেট (sodium thiosulfate) মুখে খাওয়ালে দ্রুত উপশম হতে পারে।
এই ধরনের পয়জনিং থেকে বাঁচতে ছাগল চরিয়ে ঘাস খাওয়ানোর চেয়ে প্রক্রিয়াজাত ফিড দেওয়া ভালো। তাছাড়া ভেজা বা ছত্রাক ধরা (ছাতা পড়া) শুকনো খড়/ঘাস এবং দানাদার খাবার অবশ্যই ছাগলকে দেওয়া যাবে না।
নাইট্রেট বা নাইট্রাইট পয়জনিং
সব উদ্ভিদেই কমবেশি নাইট্রেট বা সামান্য পরিমানে পটাশিয়া নাইট্রেট থাকে। হাতে গোনা কিছু উদ্ভিদে নাইট্রেটের পরিমান থাকে অনেক বেশি। তবে বিশেষ কিছু কারণে উদ্ভিদে নাইট্রেটের পরিমান বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যেতে পারে। তখন খেলে ছাগল মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
গরু-ছাগলে এমন ঘাসে নাইট্রেট বিষাক্ততার মাত্রা বাড়ে যখন এসব বাড়ন্ত অবস্থায় থাকে। যেমন : গ্রীষ্মকালে গরম ও খরার পর বৃষ্টি হলে এবং আবাদ করা ঘাসে ইউরিয়া দিলে। এর কারণ হলো- এই সময়টাতে দ্রবনীয় চিনির পরিমান কমে যায়, ফলে নাইট্রেট পরিপাক হয়ে অ্যামোনিয়া তৈরির হার কমে যায় আর এতে রুমেনে নাইট্রেটের পরিমান বেড়ে যায়।
খরার সময় উদ্ভিদে নাইট্রেটের পরিমান বেড়ে যায়। এছাড়া যেসব উদ্ভিদ/ঘাস গ্রীষ্মকালে পতিত জমিতে হয় সেসবে নাইট্রেট কনসেন্ট্রেশন বেশি হয়। সে তুলনায় নিয়মিত আবাদ হয় এমন জমিতে এই হার কম।
শুকনো ঘড় বা ঘাস বৃষ্টির পানিতে ভেজা বা আর্দ্রতার মধ্যে থাকার কয়েক দিনের মধ্যে নাইট্রেট পয়জনিং শুরু হয়ে যায়। আর উদ্ভিতের ড্রাই ওয়েটের ১.৫% এর বেশি পটাশিয়াম নাইট্রেট থাকলে সেটি ছাগলের জন্য মারাত্মক।
অর্থাৎ পটাশ ও নাইট্রোজেন সার বেশি বেশি প্রয়োগ করলে এই নাইট্রেট বিষ বেড়ে যেতে পারে।
এ ধরনের উদ্ভিদ/ঘাস : ডাটা শাক, বথুয়া শাক, শিকড় লাল এমন ঘাস বা শাক, বিন্না জাতীয় কিছু ঘাস, গিমা শাক, ভেলভেট বা কার্পেট ঘাস, বাকহুইট বা বাজরা, জই (ওট), কিছু জংলি লতা, ক্লোভার বা চারপাতা বা তিনপাতা ঘাস (জমিতে হয়, শাক হিসেবে খাওয় যায়) , ভেন্না বা ভেল্লা, বিট, সয়াবিন, তিসি, আলফালফা, জব, সুদান ঘাস, গম, ভুট্টা ইত্যাদি।
অগভীর খাল বা গর্তের পানি পান করলে নাইটাইট বিষক্রিয়া হতে পারে। তাছাড়া অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করা মাটির কারণেও ভূগর্ভস্থ পানি বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে।
এই বিষক্রিয়ার লক্ষণ হঠাৎ করেই দেখা দিতে পারে। প্রথম লক্ষণ শ্বাসকষ্ট। মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়, দুর্বল হয়ে যায়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, শরীরের তাপমাত্রা কমে যাবে, খুব উদ্বিগ্ন দেখাবে, পেশী দুর্বল হয়ে যাবে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হবে, গর্ভপাত। মিথেমোগ্লোবিনের কারণে রক্তের রঙ বাদামী হয়ে যায়। তির চার ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয়। এই ধরনের বিষক্রিয়ার পর বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে সেই ছাগলের শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে।
এই বিষক্রিয়া টেস্ট করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ডিফিনাইলামাইন ব্লু (dephenylamine blue, DPB) টেস্ট। চিকিৎসা হলে মিথিলিন ব্লু, ২% (2%, methylene blue)। এটি দেওয়ার জন্য অবশ্যই ডাক্তার সহায়তা নিতে হবে।
অ্যাফলাটক্সিন
কোথাও ছত্রাক (mold) জন্মালে সেখানে বাই-প্রোডাক্ট (উপজাত) হিসেবে এই বিষ তৈরি হয়। দানাদার খাবার যেমন : গম, ভুট্টা, বাদাম, ধান/চাল, তুলাবীজ। দুধেও হতে পারে। একবার আক্রান্ত হলে খাবার ছত্রাকমুক্ত করলেও এই বিষ মুক্ত হয় না।
এই ধরনের ছত্রাক মূলত মাটিতে থাকে। তবে পুষ্টিবহুল বীজের মধ্যে এগুলো ভালো জন্মে। এটি চারণভূমিতে যেমন থাকে তেমন সংরক্ষিত খাবারেও খাবারে থাকতে পারে। চরম আবহাওয়া অর্থাৎ তাপমাত্রার খুব ওঠানামা, ঘন ঘন খরা ও আর্দ্র আবহাওয়া এই ধরনের ছত্রাক জন্মানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। এই ছত্রাক জন্মানোর জন্য ১৪ শতাংশের উপর আর্দ্রতা এবং ৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপর তাপামাত্রা দরকার। বদ্ধ এবং বাতাস চলাচলের যথেষ্ট সুযোগ নেই এমন ঘরে ফিড সংরক্ষণ করলে এ ধরনের ছত্রাক জন্মাবেই। অ্যাফলাটক্সিন আক্রান্ত ছাগলের দুধের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
এ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, হজমে সমস্যা হয়, ওজন কমে যায়, লিভার ড্যামাজ, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, দুধ উৎপাদন হ্রস, গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু, টিউমার, বিকলাঙ্গা বাচ্চার জন্ম। অল্প বয়সী ছাগল/বাচ্চা অ্যাফলাটক্সিনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
যাইহোক, চরম আবহাওয়ার সময় আপনার সংরক্ষিত দানাদার খাবার, রেডি ফিড বা শুকনো খড় বা ঘাস ছাগলকে দেওয়ার আগে অবশ্যই পরীক্ষা করবেন। ড্যাম্প (আর্দ্র) হয়েছে কি না অথবা ছত্রাক জন্মেছে কি না। ছাগলকে নিচু জমিতে বা পতিত জমিতে চরতে দেবেন না। আর এই বিষক্রিয়ার ঝুঁকি এড়াতে ছাগলকে সাইলেজ না খাওয়ানোই নিরাপদ।
উন্নতজাতের ঘাস বিশেষ করে সুদান বা সুদান-শরগম জাতীয় ঘাস কাটার পর ইউরিয়া দিয়ে অন্তত ২০ দিন অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী কাটিংএর জন্য। আর প্রথম কাটিং বা বীজ লাগানোর পর ঘাসের উচ্চতা অন্তত ১৮-২৪ ইঞ্চি হলে এসব উন্নত জাতের ঘাস গরু-ছাগলের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ।
বিশেষ করে ছাগলের খামারিদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাবার হচ্ছে, গ্রাস হে বা শুকনো ঘাস এবং সাপ্লিমেন্টযুক্ত রেডি ফিড। যদিও বাংলাদেশের রেডি ফিড কতোটা স্বাস্থ্যকর সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে।
0 Comments