বাকৃবির শিক্ষক মোহাম্মদ আল-মামুনের চাষ করা প্লানটেইন ঘাসের পরীক্ষামূলক প্লট |
অনভিজ্ঞ খামারিদের একটা বড় সমস্যা হলো পশুর যেকোনো সমস্যায় অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ান। সর্দি, জ্বর, পেটফাঁপা, পাতলা পায়খানা সবকিছুতে অ্যান্টিবায়োটিক। এতে তাৎক্ষণিকভাবে সস্তায় এবং দ্রুত সুফল হয়তো পান। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের যে ভয়াবহ সমস্যা ডেকে আনছেন সেইদিকেও একটু খেয়াল রাইখেন। যারা খামারেই উন্নত জাত উদ্ভাবনের চিন্তা করছেন তাদের জন্য এই ধরনের চিন্তাভাবনা খুবই বিপজ্জনক। কারণ অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার কারণে আপনার পশু ধীরে ধীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে। তার মানে হলো পরে আর কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেই কাজ হবে না। পশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। এই সমস্যা মা থেকে সন্তানে বাহিত হবে। আর যারা শুধু মাংসের জন্য পশু পালনের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের বেশি ব্যবহার করেন তারাও প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না কিন্তু জাতির বড় ক্ষতি করছেন। এই অ্যান্টিবায়োটিক মাংসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে চলে যাবে। যারা প্রচুর পরিমানে এই মাংস খাবেন তারাও এভাবে এক সময় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠবেন।
ইদানীং পশুখাদ্যে এবং পোল্ট্রি ফিডেও নাকি অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং আপনি ওষুধ হিসাবে না খাওয়ালেও আপনার ফিডের মাধ্যমে পশু-পাখির শরীরে ঠিকই অ্যান্টিবায়োটিক ঢুকে যাচ্ছে। খামারের পশু-পাখিকে এই অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার কুফল ইতিমধ্যেই টের পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন- এমন রোগী পাওয়া যাচ্ছে যাদের শরীরে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। আমার এরকম একটি নবজাতকের তথ্য আমরা জানা আছে। ওই বাচ্চার মা ভাতের মতো অ্যান্টিবায়োটিক খান।
তাহলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায়???
প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসাবে প্লানটেইন ঘাসের ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে দেশে গবাদিপশু প্রতিপালনে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে এই ঘাস অধিক পরিমাণে চাষের কথা বলছেন তারা।
প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা জানান, গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে দেশে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আশির দশকে শুরু হয়েছিল গ্রোথ প্রমোটার অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। এটি এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্নভাবে পশুর বিপাকের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু এসব কৃত্রিম অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রমোটার প্রাণিদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করে।
এসব ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত পশুপণ্য অর্থাৎ মাংস, দুধ খাওয়ার ফলে মানুষের মাঝে ব্যবহার পরবর্তী (রেসিডিউয়াল) ক্ষতিকারক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। দেখা দেয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। হার্ট ডিজিস, ডায়াবেটিস, অটিজমসহ বিভিন্ন ভয়াবহ রোগের কারণ এটি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে পশুখাদ্যে এসব ব্যবহার নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ উন্নত বিশ্বে প্রায় তিন দশক ধরে গ্রোথ প্রমোটার ব্যবহারের পর এর ক্ষতির দিক অনুধাবন করে ২০০৬ এর ১ জানুয়ারি থেকে পশুখাদ্যে এর ব্যবহার বন্ধ করে। তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা গ্রোথ প্রমোটারের বিকল্প পশুখাদ্য উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, ঔষুধি উদ্ভিদ বা প্রাকৃতিক ভেষজ হতে পারে বিকল্প পশুখাদ্য। যদিও ঔষুধি উদ্ভিদের ব্যবহার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে খুব পুরানো। ঔষুধি উদ্ভিদ এরই মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রিন গ্রোথ প্রমোটার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন ঔষুধি উদ্ভিদ রয়েছে। যেমন সজিনা, পেঁয়াজ, গার্লিক ইত্যাদি ভেষজ জাতীয় উদ্ভিদ।
প্লানটেইন ঘাস |
প্লানটেইন (Plantago lanceolata L.) একটি নতুন আবিষ্কৃত বহুবর্ষজীবী ঘাসজাতীয় ঔষুধি উদ্ভিদ। যা বিরূপ প্রভাব ছাড়াই পশুর শরীর অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রমোটার কিংবা তার চেয়ে বেশি হারে বর্ধিত করবে। জাপান এবং চীন এ ভেষজ নিয়ে গবেষণায় অনেকদূর এগিয়েছে। সাধারণ ঘাসের তুলনায় এর মধ্যে অধিক পরিমাণ ভিটামিন `সি` এবং `ই` আছে, যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ ছাড়া এর মাঝে এমন কিছু উপাদান আছে যা সাধারণ ঘাসে নেই।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবেও রয়েছে এর চমৎকার কার্যক্ষমতা। যা ফ্রি র্যাডিকেলের কার্যকারিতা বন্ধ করে প্রাণিদেহের কোষ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্লানটেইন খাইয়ে উৎপাদিত মাংস কম চর্বিযুক্ত হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপুষ্টি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ আল-মামুন এই ঘাস দেশীয় আবহাওয়ায় জন্মানোর চেষ্টা করেন এবং সফলতা পান। শীতপ্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় তিনি শীতকালকে বেছে নেন তার গবেষণার উপযুক্ত সময় হিসেবে। এটি ৬-২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। তবে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে বেশি ঔষধি গুণাগুণ থাকে। উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় দেশের কৃষকরা এটি ব্যবহার করলে খুব কম খরচেই অধিক লাভবান হতে পারেন। যে কোনো ধরনের মাটিতে এই ঘাস জন্মে। খরা সহ্য ক্ষমতা সন্তোষজনক। নভেম্বরের শুরুতে বীজ ছিটিয়ে দিলে তেমন কোনো যত্ন নেওয়া ছাড়াই এটি যেকোনো ধরনের মাটিতে জন্মায়। বীজ বপনের ৪৫-৫৫ দিন পর প্রথম কাটিং দেওয়া যায়। এর এক মাস পর দ্বিতীয় কাটিং এবং দ্বিতীয় কাটিং এর এক মাস পর তৃতীয় কাটিং দেওয়া যায়। বছরে এক হেক্টরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার কেজি উৎপাদন হয়।
রোমন্থক প্রাণী (Ruminant)যেমন : গরু, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদিকে স্বাভাবিক খাবারের সাথে খুব সামান্য পরিমাণে (পোলট্রিতে ১%, ভেড়ায় ৪%, গরুতে ৫-১০%) ফ্রেশ প্লান্টেইন (কাঁচা সবুজ) এবং এর পাউডার মিশিয়ে খাওয়ালে প্রাণীর হিট স্ট্রেস কমিয়ে প্রোটিনের সংশ্লেষণ বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় মাংসের উৎপাদন, স্বাদ ও রঙ উন্নত হয় এবং পচন রোধ করে। এটি হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে দুগ্ধবতী ও গর্ভবতী প্রাণীর দুধের উৎপাদনক্ষমতা বাড়ায় এবং সুস্থ-সবল বাচ্চা জন্ম দেয়।
একই সাথে ফ্যাটি এসিডের (ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩) অনুপাত কমাতে সহায়তা করে। এতে করে হার্ট ভালো থাকে। বয়স ধরে রাখতে সহায়তা করে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও আয়ুষ্কাল বাড়ায়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ক্যান্সার ও অটিজম প্রতিরোধ করে।
তবে পশুর সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণের জন্য শুধু এই ঘাস ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ পূর্ণবয়স্ক ঘাসে লিগনিনের (Lignin)পরিমান বেশি ফলে একে হজম করা কঠিন। তাছাড়া নেপিয়ার বা এই জাতীয় ঘাসের তুলনায় প্রোটিন বা আমিষের পরিমানও কম। তবে প্রচুর পরিমান খনিজ লবণ যেমন : calcium, magnesium, sodium, phosphorus, zinc, copper and cobalt থাকে।
0 Comments